সম্প্রতি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় তারেক রহমানের নির্দেশে তৃণমূলের ১৪২ জন নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করেছে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ঘটনা প্রমাণ করে পলাতক এই নেতার রাজপথে নামা ও নির্বাচন বর্জনের আহ্বান সুস্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে দলটির নেতা-কর্মীরা।
বিএনপির একের পর এক নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত দলটিকে ভোটারদের থেকে আরও বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। এই পদক্ষেপকে আত্মঘাতী ও অগণতান্ত্রিক হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষমতায় যেতে জনসাধারণের ম্যান্ডেট অর্জনে দলের অনীহাকে আরও উন্মোচিত করেছে বিএনপি শীর্ষ নেতাদের নির্বাচন বানচালের উদ্যোগ এবং পরে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে তাদের অপপ্রচার।
নির্বাচনের কয়েক মাস আগে তারেক রহমান 'ব্যালট নয়, রাজপথে দেশের গতিপথ নির্ধারণ' করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এরপর বিএনপি-জামায়াত জোট মাসব্যাপী অবরোধ ও অগ্নিসংযোগ অভিযান চালায়। এই কর্মকাণ্ডকে গণতন্ত্র ও অধিকার রক্ষার মুখে চপেটাঘাত বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মীরা।
আরও পড়ুন: বিএনপি যে কখন তাবিজ-দোয়ার ওপর ভর করে সেটিই প্রশ্ন: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
কয়েকদিন আগে বিএনপির এক স্থানীয় নেতা প্রকাশ্যে তারেক জিয়ার ভোট বর্জনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের নীতি প্রত্যাখান করে দুধ দিয়ে গোসল করে দল ছাড়েন। এটি প্রতীকী হলেও দলীয় প্রধানের মতাদর্শ প্রত্যাখ্যানের এটি শক্তিশালী প্রতিবাদ।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ২০১৪ সালে বিএনপি জাতীয় নির্বাচন বর্জনের যে সংস্কৃতি শুরু করেছিল, ২০২৪ সালেও তারা একই কৌশল অনুকরণ করেছে। কিন্তু এক দশকের মধ্যেও নির্বাচন বর্জনের নীতিতে জনসমর্থন পায়নি বিএনপি। তবুও তাদের মধ্যে সংশোধনের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে স্থানীয় নেতাদের চাপে তারেক রহমানের অনুগতদের দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের জন্য বরাদ্দ অর্থ আত্মসাতের যে অভিযোগ উঠেছে, তা চরম অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি করেছে। এ কারণে স্থানীয় পর্যায়ে তারেক জিয়ার পছন্দের নেতাদের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মেসবাহ কামাল বলেন, ‘দলীয় ক্যাডারদের নির্বাচন বন্ধ করতে বলার মাধ্যমে রাজনৈতিক ভুল করা হয়েছে। একই সঙ্গে তা মেনে নেওয়া এবং প্রথম দফার নির্বাচনে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের সাবেক ১৬ জন নেতার মাধ্যমে কলুষিত হওয়া ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা গ্রহণের পরিবর্তে তারেক ও তার অনুগতদের মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচন বানচালের আহ্বান দলকে আরও বিচ্ছিন্ন করে ফেলার আরেকটি বহিঃপ্রকাশ। এটিকে অগণতান্ত্রিক চর্চাও বলা চলে।’
১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে তারেক রহমানের বিদেশে অবস্থান প্রসঙ্গে মেসবাহ বলেন, ‘মনে হচ্ছে এক দশক ধরে তারেক রহমান দেশে নেই, মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা থেকে তারেক রহমানের অনুপস্থিতি বিএনপিকে গণ বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। পাশাপাশি বহিষ্কারের ধারা তৃণমূল পর্যায়ে দলকে আরও দুর্বল করেছে।’
আরও পড়ুন: উপজেলা নির্বাচন: ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার আহ্বান বিএনপির
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক অজয় দাশগুপ্ত নির্বাচন বর্জনের রাজনীতিকে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও তারেক রহমানের পিতা জেনারেল জিয়ার গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সঙ্গে তুলনা করেন। জেনারেল জিয়া জনগণের ম্যান্ডেট দিয়ে নয়, শক্তি দিয়ে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
অজয় আরও বলেন, দলের প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমানের সময় থেকে শুরু করে জনগণের ম্যান্ডেট না পেয়ে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের বৈশিষ্ট্য, শাসনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য একটি প্রহসনের গণভোট- গণতন্ত্র থেকে দলটির সরে দাঁড়ানোর প্রমাণ।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক গাজী নাসিরউদ্দিন খোকন বলেন, জনসমর্থন আদায়ে ব্যর্থতা ঢাকতে বিএনপি নির্বাচনকে কলঙ্কিত করতে মিথ্যাচার করছে।
জ্যেষ্ঠ গবেষক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক সৈয়দ বদরুল আহসান বলেন, নির্বাচন বর্জনের বেশ কিছু পরিণতি আছে। প্রথমত, এর ফলে দলীয় কর্মীদের মধ্যে মোহভঙ্গ হয়, যারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত হন এবং নিজেদের অপ্রাসঙ্গিক মনে করেন। দ্বিতীয়ত, যে দল অবিরাম নির্বাচন বর্জন করে, সেই দলকে নাগরিকরা গুরুত্বের সঙ্গে নেয় না।
সৈয়দ বদরুল বলেন, ‘এটি গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ, কারণ ক্রমাগত নির্বাচন বর্জনের ফলে সন্দেহ হয় যে দলটি ভোটকেন্দ্র থেকে দূরে থাকা অন্য রাজনৈতিক কৌশল থাকতে পারে, যা নির্বাচন এবং জনস্বার্থের পক্ষে অনুকূল নয়, কেবল ক্ষমতায় বসার জন্য এমন মনে করে।’
আরও পড়ুন: বিএনপির সমাবেশ মানেই অগ্নিসংযোগ-ধ্বংসযজ্ঞ-রক্তপাত: ওবায়দুল কাদের
২০১৪ সালের মতো, গত জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে, বিএনপি ও জামায়াত জোট এক মাসব্যাপী অবরোধ করে। এর মধ্যে যানবাহন ও ট্রেনে অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনাও ছিল। পাশাপাশি জামায়াতের সঙ্গেও সম্পর্ক শক্ত করে দলটি সব আইন বাতিল করে শরিয়াহ আইন প্রবর্তনের প্রকাশ্য হুমকি দিয়েছিল।
এছাড়াও খালেদা জিয়া ও তারেকের নির্দেশে দেশ চালানোর ঘোষণার মতো নির্বাচন ছাড়াই ক্ষমতা দখলের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন বিএনপির বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা।
আরও পড়ুন: দুধ দিয়ে গোসল করে দলত্যাগ বিএনপি নেতার