গাড়ি চালানোর জন্য একটি ড্রাইভিং লাইসেন্সের মালিকানা সব কিছু নয়। এর সাথে প্রয়োজন গাড়ি চালানো শেখার জন্য একজন পেশাদারের নিকট প্রশিক্ষণ। রাজধানী ঢাকায় অনেক ড্রাইভিং স্কুল আছে যারা এই পেশাদার প্রশিক্ষণ প্রদান করে। গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে স্টিয়ারিং ঘুরানো এবং অ্যাক্সেলারেটার ও ব্রেক কন্ট্রোলের মাঝেই এই প্রশিক্ষণ সীমাবদ্ধ নয়। গাড়ি চালানোর সময় অন্য ড্রাইভারদের দিকে খেয়াল রাখা, চালক হওয়ার দায়িত্ব বোঝা, ট্র্যাফিক সিগন্যাল এবং মহাসড়কে গাড়ি চালানোর নিয়মগুলো সম্পর্কে প্রত্যেক ড্রাইভারকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। আজকের ফিচারটিতে তাই ঢাকার কয়েকটি নির্ভরযোগ্য ড্রাইভিং ট্রেনিং সেন্টারকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
ঢাকার সেরা ১০টি ড্রাইভিং ট্রেনিং সেন্টার
বিআরটিসি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট
এটি বিআরটিসি (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন) কর্তৃক পরিচালিত দেশব্যাপি ড্রাইভিং প্রশিক্ষণের একটি উদ্যোগ। এই সরকারি প্রতিষ্ঠানের কোর্সগুলোর প্রশিক্ষকদের সবাই ড্রাইভিং ইন্সট্রাক্টর লাইসেন্স প্রাপ্ত। কোর্স শেষ হওয়ার পর লাইসেন্স-এর জন্য টেস্ট তেজগাঁওয়ের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটিতেই দেয়া যায়। টেস্ট পরিচালিত হয় ড্রাইভিং কম্পেটেন্সি টেস্ট বোর্ডের অধীনে।
হাল্কা গাড়ির জন্য ৪ সপ্তাহের বেসিক ড্রাইভিং কোর্স ফি ৬,০০০ টাকা, যেখানে ৮ সপ্তাহের ভারী গাড়ি চালানো শিখতে প্রয়োজন হবে ৯,০০০ টাকা। অ্যাডভান্স্ড শিখতে হলে ২ সপ্তাহের হাল্কা গাড়ি ড্রাইভিং কোর্স ফি ৩,৫০০ টাকা এবং ভারী গাড়ি ড্রাইভি কোর্স ফি ৪,৫০০/=। ৩,৫০০ টাকা লাগবে ২ সপ্তাহের মোটর সাইকেল ড্রাইভিং কোর্সের জন্য।
পড়ুন: মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমানোর ১০টি উপায়
মা টেকনিক্যাল ড্রাইভিং ট্রেনিং সেন্টার
গুলশান ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল কেন্দ্রিক এই ট্রেনিং সেন্টারটির কোর্সগুলো বিআরটিএ (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ) প্রশিক্ষিত মাস্টার দ্বারা পরিচালিত। পুরুষদের পাশাপাশি মহিলাদের জন্যও আছে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। দেড় থেকে দুই মাসের কোর্সগুলোতে ইঞ্জিনের কর্মক্ষমতা সহ লাইসেন্স প্রাপ্তির জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা হয়ে থাকে।
ফুল, মিডিয়াম এবং শর্ট এই তিন ক্যাটাগরির ড্রাইভিং কোর্স-এ ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা ফি নেয়া হয়। প্রশিক্ষণার্থীদের পছন্দের ভিত্তিতে অটো বা ম্যানুয়েল অথবা উভয় গিয়ারের গাড়িতেই ট্রেনিং দেয়া হয়। এই কোর্সগুলো মর্নিং ও ইভিনিং দুই শিফটে করানো হয়ে থাকে। মর্নিং শুরু হয় সকাল ৬টা থেকে আর ইভিনিং শুরু হয় সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ।
বাংলাদেশ ড্রাইভিং ট্রেনিং ইন্সটিটিউট (বিডিডিটিআই)
বিডিডিটিআই সারা রাজধানী জুড়ে ধানমন্ডি, গুলশান, উত্তরা, মিরপুরস্থ এলাকায় ড্রাইভিং শেখানোর কাজ করে আসছে। এখানে আছে প্রশিক্ষণকালীন হোস্টেলে থাকার সুবিধা। সুসজ্জিত বড় শ্রেণীকক্ষগুলো যথেষ্ট সংখ্যক প্রার্থীকে প্রশিক্ষণ দানের জন্য উপযুক্ত। প্রশিক্ষকদের প্রত্যেকে বন্ধুত্বের সহিত প্রতিটি সমস্যার সমাধান করে থাকে। এমনকি দুর্বল প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য আলাদাভাবে অতিরিক্ত যত্নের সাথে শেখানো হয়।
পড়ুন: চুরি হওয়া বা হারিয়ে যাওয়া স্মার্টফোন খুঁজে পাওয়ার উপায়
অবশ্য ব্যক্তিগত বা ওয়ান টু ওয়ান সেশনের জন্য কোর্স ফি তুলনামূলক ভাবে বেশি। এদের বিশেষত্ব হচ্ছে কোর্স শেষে প্রার্থীকে নিজেদের ইনস্টিটিউটেই এরা চাকরির সুযোগ করে দেয়। বিডিডিটিআইয়ের কোর্সগুলো প্রাথমিক, মধ্যম ও অভিজ্ঞ; এই তিন স্তরে বিভক্ত। বাইক, ম্যানুয়াল ও অটো; তিন গাড়ির জন্যই তারা ড্রাইভিং শিখিয়ে আসছে। গাড়ি ও কোর্সের ধরনের উপর ভিত্তি করে কোর্স ফি ২,৫০০ থেকে ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত।
পাথওয়ে ড্রাইভিং ট্রেনিং স্কুল
মিরপুর কেন্দ্রিক এই ট্রেনিং স্কুলটি বিআরটিএ নিবন্ধিত স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান পাথওয়ের একটি কার্যক্রম। ব্যবহারিক ক্লাসের পাশাপাশি থিওরি ক্লাস তো আছেই; তার সাথে প্রতিটি ড্রাইভিং ব্যবহারিক ক্লাস গ্রুপ ভিত্তিক হয় না বরং প্রত্যেকের জন্য পৃথকভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। দেশের সর্বস্তরের নারী-পুরুষের সাথে সাথে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্যও আছে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। প্রতিটি যানবাহনের ইঞ্জিন মেকানিক্যাল এবং রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে সরেজমিনে শেখানো হয়।
প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিনামূল্যে শেখারও সুযোগ আছে। পাথওয়ের প্রতিটি প্রশিক্ষক বিআরটিএ কর্তৃক অনুমোদিত এবং এদের মাধ্যমে সড়কে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তামূলক ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়ে থাকে। কোর্স ও গাড়ি ভেদে কোর্স ফিগুলো ৩০০০ থেকে ৯০০০ টাকা।
পড়ুন: ভ্রমণের উপকারিতা: দেশ বিদেশ ভ্রমণ আপনার মধ্যে কি পরিবর্তন আনতে পারে?
শিমু ড্রাইভিং স্কুল
ঢাকার প্রসিদ্ধ ড্রাইভিং ট্রেনিং সেন্টারগুলোর মধ্যে শিমু ড্রাইভিং স্কুল একটি পরিচিত নাম। মিরপুর ও ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন এলাকা কেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠিত সেন্টারটি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত। শুরু থেকেই সড়ক নিরাপত্তাকে একটি প্রধান উদ্বেগ হিসাবে বিবেচনা করে এটি সর্বোত্তম ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ প্রদান করে আসছে। তাই সঠিকভাবে ড্রাইভিং শেখার জন্য প্রতি মাসে এখানে অনেক নারী-পুরুষ ভর্তি হচ্ছেন।
জনসাধারণকে প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি শিমু ড্রাইভিং স্কুল অনেক সরকারি-বেসরকারি কর্পোরেট কোম্পানির জন্য ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ সরবরাহ করেছে। ড্রাইভিং স্কুলটির পরিচালক নূর নবী শিমুর লেখা ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ বইটিও বেশ নামকড়া। এর দুটি কোর্সের মধ্যে ১ মাস ব্যাপি গোল্ডেন কোর্স ফি ৮,০০০ টাকা এবং ২০ দিনের সিলভার কোর্সটির মূল্য ১০,০০০ টাকা।
ব্র্যাক ড্রাইভিং স্কুল
দেশ বরেণ্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ২০১২ সালের নভেম্বর থেকে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ সুবিধা দিয়ে আসছে। রাজধানীর প্রধান এলাকা গুলশান ও উত্তরাকে কেন্দ্র করে তারা বিস্তার করেছে তাদের এই কার্যক্রমটি। এদের ট্রেনিং সমূহের মধ্যে আছে ১২ দিনের আবাসিক প্রশিক্ষণ এবং ৩৫ দিনের অনাবাসিক প্রশিক্ষণ। এদের ড্রাইভিং সিমুলেটর সম্পূর্ণ আধুনিক পদ্ধতিতে প্রগতিশীল ধারায় গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা দেয়।
পড়ুন: চাকরির পাশাপাশি অনলাইনে কাজ করে বাড়তি আয়ের উপায়
প্রশিক্ষণে গাড়ির চালানোর সময় দারুণ ভাবে ব্লাইন্ড সাইট কাটিয়ে ওঠা রপ্ত করানো হয়। মোট ৩৩টি ক্লাসের মধ্যে ২৮টি ড্রাইভিং ক্লাস এবং ৩টি সিমুলেটর সহ ৫টি তত্ত্বীয় ক্লাস। শুধু ড্রাইভিং-এর জন্য ফি ৮,৫৫০ টাকা যেখানে লার্নিং কার্ড সহ শিখতে গেলে ৯৯৪০ টাকা খরচ করতে হবে। আর অপেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স সহ খরচ ১৫,৬০০ টাকা এবং পেশাদারের ক্ষেত্রে ১৪,৬০০ টাকা।
এশিয়া ড্রাইভিং স্কুল
পুরান ঢাকার ড্রাইভিং স্কুলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই ড্রাইভিং স্কুলটি। ড্রাইভিং পরীক্ষার প্রতিটি সেকশন একদম হাতে ধরে ধরে বুঝানোর জন্য লাইসেন্স পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে সবাই ভীড় জমান আজিমপুর রোডের সলিমুল্লাহ এতিমখানা মার্কেটের এই ট্রেনিং সেন্টারটিতে।
বিআরটিএ এবং ট্রাফিক পুলিশ অনুমোদিত এই ড্রাইভিং ট্রেনিং সেন্টারের কোর্স ফি বিভিন্ন ক্যাটাগরির উপর ভিত্তি করে ২,০০০ থেকে ৫,৫০০ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়ে থাকে। কোর্সগুলোতে গাড়ি চালনার প্রাথমিক ধারণা থেকে শুরু করে যাবতীয় গাড়ির ইঞ্জিন বোঝানো হয়ে থাকে।
পড়ুন: এটিএম বুথে কার্ড আটকে গেলে কি করবেন ? এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় কি?
তালতলা মোটর ড্রাইভিং ট্রেনিং স্কুল
খিলগাঁও এলাকায় গাড়ি চালানো শেখার সেরা মাধ্যমগুলোর মধ্যে এই ট্রেনিং সেন্টারটি অন্যতম। মালিক মোহাম্মদ আলী হোসাইন নিজে একজন দক্ষ গাড়ি চালক এবং তিনিই এখানে প্রধান প্রশিক্ষক। গাড়ির লাইসেন্স ও রেজিষ্ট্রেশনের ক্ষেত্রে স্থানীয় ড্রাইভিং সেন্টারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় এই প্রশিক্ষকের কাছ থেকে।
৬,০০০ টাকায় প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে অল্প সময়ের মধ্যেই প্রশিক্ষণার্থীরা গাড়ি নিয়ে সাবলীল ভাবে সড়কে উঠে যেতে পারেন। বিআটিএ অনুমোদিত এই প্রশিক্ষণালয়ে রয়েছে মহিলাদের জন্যও ড্রাইভিং শেখার সুব্যবস্থা।
ন্যাশনাল ড্রাইভিং স্কুল
ধানমন্ডিতে ড্রাইভিং-এ হাত পাকাপোক্ত করার জন্য নির্ভরযোগ্য নাম হচ্ছে ন্যাশনাল ড্রাইভিং স্কুল। গাড়ি চালনার থিওরি ও ব্যবহারিক ক্লাসের পাশাপাশি এখানে রয়েছে যান্ত্রিক দক্ষতা অর্জনের সুযোগ। দীর্ঘ যাত্রায় নিরাপদে গাড়ি চালানোর জন্য সুযোগ্য করে গড়ে তোলার পর প্রশিক্ষণার্থীদেরকে সরবরাহ করা হয় ড্রাইভিং সনদ।
পড়ুন: পণ্য, সেবা ক্রয়ে প্রতারিত হলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার আইনে অভিযোগ করার উপায়
৮,৫০০ টাকার ৩০টি ক্লাসের কোর্সের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত আছে ২৪টি ব্যবহারিক ক্লাস এবং ৬টি থিওরি ক্লাস। সেন্টারটির অবস্থান ধানমন্ডি-২৭ নাম্বারে হওয়ার কারণে এর প্রশিক্ষণার্থীরা ছড়িয়ে আছেন আশেপাশের পান্থপথ থেকে শুরু করে লালমাটিয়া ও মোহাম্মদপুর পর্যন্ত। গাড়ির লাইসেন্স এবং ইন্সুরেন্স সম্পর্কিত কাজের জন্যও প্রশিক্ষণার্থীরা এখান থেকে অনেক সহায়তা পেয়ে থাকেন।
টিটিআই ড্রাইভিং ট্রেনিং সেন্টার
বিআরটিএ অনুমোদিত এবং বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক স্বর্ণপদকে ভূষিত হওয়া একমাত্র ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র টিটিআই। বিআরটিএ প্রত্যয়িত পেশাদার প্রশিক্ষক এম. এ. রব টিটিআই-এর পরিচালক এবং তিনি নিজের তত্ত্বাবধানেই গাড়ি চালানো শেখান।
পান্থপথের গ্রীণরোড সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত এই ড্রাইভিং স্কুলটিতে সাপ্তাহিক ৫ দিন ক্লাসের ১ মাসের কোর্স-এ ফি নেয়া হয় ১০,০০০ টাকা। ছাত্র-ছাত্রীরা বিশেষ ছাড়ে এখান থেকে ড্রাইভিং শিখে নিতে পারেন। নারীদের প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। টিটিআই-এর সফল প্রশিক্ষণার্থীরা শুধু দেশেই নয়, বিদেশের মাটিতেও নিজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছেন।
পড়ুন: রাতে হাইওয়েতে গাড়ি চালানোর সময় প্রয়োজনীয় কিছু সতর্কতা
শেষাংশ
গাড়ি চালানো শেখার জন্য ঢাকার এই ড্রাইভিং ট্রেনিং সেন্টারগুলোর মাধ্যমে অর্জিত দক্ষতা সাড়া জীবনের পাথেয় হয়ে থাকবে। তাছাড়া যন্ত্রাংশের কারিগরি জ্ঞান সহ গাড়ি চালানো শেখা স্বাধীনতার নামান্তর। দেশের যে কোন সড়কে একজন দক্ষ গাড়ি চালক স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে বিচরণ করতে পারেন। সড়ক দূর্ঘটনার আশঙ্কা কমাতে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ আবশ্যক। প্রতিটি গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে চালকের নিজের নিরাপত্তার পাশাপাশি অন্যান্য আরোহীদের জীবনের দায়িত্বও চালকের উপর থাকে। তাই জীবনের জন্য অত্যন্ত দরকারি এই দক্ষতাটি অর্জনের জন্য সঠিক ড্রাইভিং স্কুল নির্বাচন করা জরুরি।