বিশ্ব দরবারে যে নামগুলো বাংলাদেশের সঙ্গীতকে প্রতিনিধিত্ব করছে তার একটি- ফকির আলমগীর। নিছক বিনোদনের গণ্ডি পেরিয়ে সঙ্গীত যে সমাজ পরিবর্তনের শক্ত হাতিয়ার হতে পারে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই প্রথিতযশা পল্লী গায়ক। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঊষালগ্ন থেকে শুরু করে এই পপ শিল্পী বিভিন্নভাবে তার জীবনভর অবদান দিয়ে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে পরিশিলিত করেছেন। ৭০-৯০ দশকের এক বিরাট সময় ধরে দেশ মাতিয়েছেন ফকির আলমগীর। অভিজাত সঙ্গীতজ্ঞদের পাশাপাশি দেশ জুড়ে লাখ লাখ গানপ্রিয় মানুষের মাঝে ছড়িয়ে আছে তার অগণিত ভক্ত।
চলুন, এই শক্তিমান সঙ্গীত শিল্পীর সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই।
ফকির আলমগীরের জন্ম ও শিক্ষাজীবন
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আর ফকির আলমগীরের জন্ম তারিখ একই। যদিও ভাষা আন্দোলনের বছর দুই আগে তার জন্ম; ১৯৫০ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি। ফকির আলমগীর ফরিদপুরের মানুষ। থানা ভাঙ্গা আর গ্রামের নাম কালামৃধা। পিতার নাম- মো. হাচেন উদ্দিন ফকির এবং মায়ের নাম- বেগম হাবিবুন্নেসা। তিন ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে তার স্থান অষ্টম। দাদী, বাবা-মা ও আট ভাইবোন নিয়ে স্বভাবতই বড় এক পরিবারে তাঁর বেড়ে ওঠা।
আরও পড়ুন: থেমে গেলো ফকির আলমগীরের কণ্ঠ
১৯৬৬ সালে ফকির আলমগীর কালামৃধা গোবিন্দ হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হন। অতঃপর জগন্নাথ কলেজে উচ্চ-মাধ্যমিকের জন্য ভর্তি হন। জগন্নাথ থেকে স্নাতক পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হন। পরবর্তীতে সেখান থেকে সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
ফকির আলমগীর ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত হন ১৯৬৬ সাল থেকে। সে সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপের সদস্য হন।
ব্যক্তি জীবনে এই ঝাঁকড়া চুলের মানুষটি খুবই সহজ সরল। ভাবের আদান-প্রদানের সময় এই গানের মানুষটাই যেন নিমেষেই প্রত্যেকের প্রাণের মানুষ হয়ে ওঠেন। শুধু গানের সময়েই নন, গানের বাইরেও তিনি গণমানুষের। পথে-ঘাটে যখন যেখানে যার সাথে দেখা হচ্ছে তার সাথেই সাধারণ মানুষের মত মিশে যেয়ে কথা বলেন। আর এই কারণেই যে কেউ অকপটেই তাকে নিজের মনের কথা বলে ফেলতে পারে।
পেশাগত জীবনে এই শিল্পী বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের জনসংযোগ বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ফকির আলমগীরের স্ত্রী সুরাইয়া আলমগীর এবং তিন সন্তান রানা, রাজীব ও রাহুল। তাঁর তিন নাতি ফারহান, ফারদিন, উজান এবং এক নাত্নী ফারিন।
সঙ্গীত জগতে ফকির আলমগীরের আবির্ভাব ও অবদান
ফকির আলমগীর ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী ও গণশিল্পী গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন। ফলশ্রুতিতে, তাকে ৬০-এর দশক জুড়ে কতিপয় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে হয়েছিলো। এরই পথ ধরে ক্রমশ গানের জগতে তাঁর পদার্পণ ঘটে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে তিনি ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী এবং গণ শিল্পী গোষ্ঠীর সক্রিয় সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় ফকির আলমগীর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেন এবং তার গায়কির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহিত করেন।
স্বাধীনতার পরবর্তীকালে ফকির আলমগীর তৎকালীন জনপ্রিয় সঙ্গীত তারকা ফেরদৌস ওয়াহিদ, আজম খান, ফিরোজ সাই, এবং পিলু মমতাজের পাশাপাশি পশ্চিমা সংগীতের সাথে দেশীয় সুরগুলি সমন্বিত করে বাংলা পপ সংগীতের বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। যুদ্ধাহত পুরো একটা দেশের মুষরে পড়া মানুষগুলোতে তাদের নতুন ধারার গান যেন প্রাণের সঞ্চার করেছিলো। প্রথম দিকে পপগানের সাথে জড়িত থাকলে পরবর্তীতে গণসঙ্গীতটাকেই ফকির আলমগীর তাঁর স্বাক্ষর হিসেবে বেছে নেন। ইতোমধ্যেই শহীদ আলতাফ মাহমুদ, আবদুল লতিফ, হেমাঙ্গ বিঃশ্বাস, আব্দুল আলীম, কামাল লোহানী, নিজামুল হক এবং অজিত রায়ের মত দেশ বরেণ্য সঙ্গীত ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের সান্নিধ্য তাকে সঙ্গীতাঙ্গনে নিজের অবাধ বিচরণে আরো বেশী উৎসাহিত করে তোলে।
সেই সূত্রে, একজন সাংস্কৃতিক দূত হিসেবে বাংলাদেশের গানকে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন এশিয়া সহ আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশগুলোতে।
১৯৭৬ তিনি সালে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠী’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদের (জিএসএসপি) সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। এছাড়াও তিনি বেতার টিভি শিল্পী সংসদ, আর্টিস্ট গিল্ট, বাংলা একাডেমী, আধুনিক বাংলাদেশ সঙ্গীত, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিষদ, বাংলাদেশ চীন-মৈত্রী সমিতি, এবং অফিসার্স ক্লাব সহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন।
গানের পাশাপাশি তাঁর লেখালেখিরও বেশ ভালো হাত ছিলো। তাঁর প্রথম বই বের হয় ১৯৮৪ সালে “চেনা চীন” নামে। তার প্রকাশনাগুলোর মধ্যে "গণসঙ্গীত এর অতীত ও বর্তমান", “গণসঙ্গীত ও মুক্তিযুদ্ধ”, "মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও বিজয়ের গান", "আমার কথা", "যারা আছেন হৃদয়পটে", “মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী বন্ধুরা”, “স্মৃতি আলাপনে মুক্তিযুদ্ধ” এবং “আবহমান বাংলার লোকসঙ্গীত” বইগুলো সুধীমহলে বেশ সমাদৃত হয়েছে।
ফকির আলমগীরের জনপ্রিয় গানগুলো
১৯৭৭ সালে প্রথম প্রকাশ পাওয়া বাংলা গান ফাকির আলমগীরের “মায়ের একধার দুধের দাম” দেশ জুড়ে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়। আশির দশকে ভারতীয় শিল্পী হেমাঙ্গ বিঃশ্বাসের গাওয়া “জন হেনরী” বা “নাম তার ছিলো জন হেনরী” গানটি গেয়ে সাংস্কৃতিক বিভিন্ন মহলগুলোতে বেশ সমাদৃত হন ফকির আলমগীর। কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকদের অধিকারের দাবী সুনিশ্চিতকরণ ছিলো গানটির বিষয়বস্তু।
১৯৮২ সালে তাঁর “ও সোখিনা” গানটি প্রথম বিটিভিতে ঈদ আনন্দ মেলায় সম্প্রচারিত হওয়ার পর পল্লী ও গণসঙ্গীতে তাঁর স্বাক্ষর রচিত হয়। গানটির গীতিকার ছিলেন আলতাফ আলী হাসু আর সুর করেছেন কন্ঠশিল্পী নিজেই। আশির দশকের শেষের দিকে ফকির আলমগীর নিজেরই লেখা, সুর ও গায়কিতে শ্রোতাদেরকে উপহার দেন “চল সোখিনা, দুবাই যাবো” গানটি।
১৯৯৭ সালে বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁর গাওয়া “নেলসন ম্যান্ডেলা” গানটি আজও লক্ষ প্রাণে দ্রোহের জাগরণ ঘটায়। সে বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে এসে নেলসন ম্যান্ডেলা গানটি শুনে খুব মুগ্ধ হন।
এছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য গানগুলোর মধ্যে "শান্তাহার জংশনে", "ব্যাংলার কমরেড বন্ধু", “আহারে কাল্লু মাতব্বর”, “ও জুলেখা” এবং “অন্তর কান্দে গো আমার গ্রাম” অন্যতম। এই ২১ শতকে এখনো মানুষ তার কন্ঠে “বনমালী তুমি”, “মন আমার দেহঘড়ি”, “মন তুই দেখলি নারে” গানগুলো শোনার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে থাকে। সর্বপরি, সাম্যবাদী শিল্পী ফকির আলমগীর দেশ, জাতি, বর্ণ, ধর্ম সব উপেক্ষা করে সর্বস্তরের মানুষের জন্য গান গেয়েছেন।
যে সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন ফকির আলমগীর
১৯৯৯ সালে সঙ্গীতাঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ফকির আলমগীরকে একুশে পদক প্রদান করে। এছাড়া তিনি শেরে বাংলা পদক, সিকোয়েন্স এ্যাওয়ার্ড অব অনার, ভাসানী পদক, গণনাট্য পুরষ্কার, জসীমউদ্দীন স্বর্ণপদক, বাংলাদেশ জনসংযোগ সমিতি পুরষ্কার, ক্রান্তি পদক, তর্কবাগীশ স্বর্ণপদক, এবং ত্রিপুরা সংস্কৃতি সমন্বয় পুরষ্কার সহ দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন পুরষ্কারে পুরষ্কৃত হয়েছেন। ফকির আলমগীর বাংলা একাডেমীর সম্মানজনক ফেলোশিফ, হলিউড বাংলাদেশ এসোসিয়েশন পুরষ্কার, এবং পশ্চিম বঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে সঙ্গীতে মহাসম্মান লাভ করেন।
আরও পড়ুন: ফকির আলমগীর লাইফ সাপোর্টে
ফকির আলমগীরের মৃত্যু
২০২১ সালের ২৩ জুলাই এই কালজয়ী সঙ্গীতশিল্পী কোভিড আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৪ জুলাই ২০২১ বুধবার করোনা সংক্রমণ ধরা পরলে শ্বাসকষ্ট বৃদ্ধি পাওয়ায় পরদিনই তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ধীরে ধীরে পুরো ফুসফুস করোনা সংক্রমিত হওয়ার মাধ্যমে অবস্থা অবনতির দিকে যেতে থাকে। অতঃপর আইসিইউতে থাকা অবস্থায় ২৩ জুলাই শুক্রবার রাত ১০:৫৬ মিনিটে হার্ট অ্যাটাকে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিলো ৭১ বছর।
শেষাংশ
ফকির আলমগীর চলে গেলেও তার কিংবদন্তি সঙ্গীত জগতে নবাগতদের জন্য পাথেয় হয়ে রইলো। তিনি দেখিয়ে গেছেন কি করে কতগুলো বাংলা শব্দকে কণ্ঠে ধারণ করে প্রতিরক্ষার অস্ত্রে পরিণত করা যায়। যুগে যুগে বিভিন্ন আন্দোলনের ক্রান্তিকালে সঙ্গীত শিল্পীরা তাদের গায়কির মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। বাংলাদেশের জন্য ফকির আলমগীর ঠিক সেরকমি একজন কণ্ঠযোদ্ধা। দেশের যে কোন গ্রহণকাল মোকাবিলার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে সকল কলাকুশলীদের কর্তব্যের ব্যাপারে তার জীবন চরিত একটি আদর্শ হয়ে রইলো।