কে এই বাঘা যতীন?
১৯০৭ সালের এপ্রিলের কোনো এক দিনে বর্তমান ভারতের শিলিগুড়ির জনাকীর্ণ রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে অসুস্থ হয়ে পড়া এক সহযাত্রীর জন্য পানি নিয়ে বগির দিকে ছুটে যাচ্ছিলেন বাঙালি এক যুবক। তবে, এ সময় নিজের অজান্তেই এক ব্রিটিশ ক্যাপ্টেনের সাথে তার ধাক্কা লেগে যায়। বাঙালিদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপরায়ণ সেই ক্যাপ্টেন ওই যুবককে মারধর করেন। এর কিছুক্ষণ পরে সেই সাহসী বাঙালি যুবক ফের ব্রিটিশ ক্যাপ্টেনের কাছে ফিরে আসেন এবং উদ্ধত আচরণের বিষয়ে জানতে চান। এ সময় আরও তিন ব্রিটিশ সেনার সাথে তিনি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন।
আরও পড়ুন: কুষ্টিয়ায় বাঘা যতীনের ভাস্কর্য ভাঙচুর: যুবলীগ নেতাসহ গ্রেপ্তার ৩
এ ঘটনার পরে কী হয়েছিল তার ইতিহাস সকলেরই জানা। চার ব্রিটিশ সেনাকে প্ল্যাটফর্মের মেঝেতে ফেলে আচ্ছা করে উত্তম-মধ্যম দেন সেই বাঙালি যুবক। চারজনের চোয়াল ভেঙে ধরাশায়ী করার অপরাধে তার বিরুদ্ধে মামলা রুজ্জু করা হয়। পরে অবশ্য বিপুল সমালোচনার মুখে সরকার চাপে পড়ে মামলা প্রত্যাহার করে নেয় এবং আদালত কক্ষে সৈন্যদের সর্তক করে দেয়া হয়। তখনকার সময়ে ইংরেজ সামরিক কর্মকর্তাদের এক বাঙালি যুবকের কাছে নতি স্বীকার করা ব্রিটিশ শাসনের খ্যাতিতে কালিমা লাগিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। এতক্ষণ ধরে যার সাহসিকতার গল্প শুনছিলেন তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের মহানায়ক যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। যিনি বাঘা যতীন নামেই বেশি পরিচিত।
বাঘা যতীনের শৈশব
বিপ্লবী বীর বাঘা যতীন বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কয়ায় ১৮৭৯ সালের ৭ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই শারীরিক শক্তির জন্য বিখ্যাত ছিলেন তিনি। ইতিহাস বলে শুধুমাত্র ছোট একটি ছোরা দিয়ে এক বাঘের হাত থেকে তিনি তার এক খালাতো ভাইকে বাঁচিয়েছিলেন এবং একাই ওই বাঘটিকে হত্যা করেন। এ ঘটনার পর থেকে শক্তিমত্তার জন্য লোকমুখে তিনি ‘বাঘা যতীন’ নামে পরিচিতি পান।
আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধুর পর কুষ্টিয়ায় এবার বিপ্লবী বাঘাযতীনের ভাস্কর্য ভাঙচুর
ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের মহানায়ক বাঘা যতীন খুব ছোটবেলায় তার বাবা উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় হারান। বিধবা মা, স্বভাবকবি ও নিবেদিত সমাজসেবিকা শরৎশশী দেবীর আদরযত্নে বড় হতে থাকেন যতীন। ছোটবেলা থেকেই বাঘা যতীনকে সাহসী করে তোলার পেছনে ছিলেন তার মা শরৎশশী। ১৮৯৫ সালে এন্ট্রান্স পাস করার পর তিনি শর্টহ্যান্ড ও টাইপরাইটার ব্যবহার শিখেন এবং পরবর্তী সময়ে বেঙ্গল গভর্নমেন্টের অর্থ সচিব হেনরি হুইলের স্টেনোগ্রাফার হিসেবে নিযুক্ত হন। চাকরি করে যে টাকা মাইনে পেতেন তার কিছু অংশ নিজের জন্য রেখে বাকিটা তার পরিবার ও অসহায় মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিতেন। ১৯০০ সালে যতীন কুমারখালীর ইন্দুবালা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। এ দম্পতির চার সন্তান ছিল।
বিপ্লবী কর্মী হয়ে উঠা
বাঘা যতীন কলকাতা সেন্ট্রাল কলেজে (বর্তমান ক্ষুদিরাম বোস সেন্ট্রাল কলেজ) পড়াশোনার সময় এক ত্রাণ শিবিরে স্বামী বিবেকানন্দের সাথে সাক্ষাত হয় তার। বিবেকানন্দের সংস্পর্শে এসে যতীন দেশের স্বাধীনতার জন্য আধ্যাত্মিক বিকাশের কথা ভাবতে শুরু করেন। এ সময়ে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। বিবেকানন্দের আহ্বানে যতীন তার বন্ধুদের দল নিয়ে এ রোগে আক্রান্তদের সেবায় নিয়োজিত হন। যতীনের প্রবল উত্সাহে মুগ্ধ হয়ে বিবেকানন্দ তাকে আম্বু গুহ জিমনেসিয়ামে পাঠিয়েছিলেন, যেখানে তিনি কুস্তি শেখেন।
আরও পড়ুন: ভাস্কর্য ভাঙচুরকারীদের সমূলে উৎপাটন করা হবে: কৃষিমন্ত্রী
স্থানীয় যুব গোষ্ঠী এবং জিম (আখড়া)-এর জোট হিসেবে ১৯০২ সালে বঙ্গীয় অঞ্চলে ‘অনুশীলন সমিতি’ গঠিত হয়। যা পরবর্তীতে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের জন্য বিপ্লবী ও সহিংসতার অনুশীলনকে সমর্থন জানিয়েছিল। পরের বছর ১৯০৩ সালে অত্যন্ত দৃঢ় আত্মমর্যাদা ও জাতীয়তাবোধসম্পন্ন যতীন জাতীয়তাবাদী নেতা অরবিন্দ ঘোষের সংস্পর্শে আসেন। যিনি বাঘা যতীনের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বীজ গেথে দেন।
কেউ কেউ বলে থাকেন যে যতীন সে সময় বিভিন্ন জেলায় ‘অনুশীলন সমিতি’ স্থাপনের নেতৃত্ব দিযেছিলেন। যারা বয়স্কদের জন্য রাতের স্কুল, হোমিওপ্যাথিক দোকান, ক্ষুদ্র শিল্প এবং কৃষি কাজের মতো বিভিন্ন সামাজিক কাজ করত। এছাড়াও মেধাবী শিক্ষার্থীদের সামরিক জ্ঞান অর্জনের জন্য নিজেই বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন যতীন।
বিভিন্ন উপশহরগুলোতে ‘যুগান্তর’ নামে এক গোপন বৈপ্লবিক দল গঠনের কাজ করে অনুশীলন সমিতি। যারা ব্রিটিশবিরোধী তরুণদের প্রশিক্ষিত করে তোলার কাজ করত। এ দলে কাজ করার সময় নরেনের (মানবেন্দ্র নাথ রায়) সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং অচিরেই তারা একে অপরের আস্থাভাজন হয়ে উঠেন।
ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লব
ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেসের প্রস্তাবিত কাঠামোর বিরোধিতা করে ‘পূর্ণ স্বরাজ’ বলে অভিহিত ভারতের ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ অর্জনের জন্য নিবেদিত এক প্রাণ হয়ে উঠেন বাঘা যতীন। ১৯১২ সালে কলকাতা সফরকালে জার্মান ক্রাউন প্রিন্সের সাথে দেখা করেছিলেন যতীন এবং তাকে ভারতে সমাজতান্ত্রিক সরকার গঠনের বিপ্লবের জন্য অস্ত্র সরবরাহের অনুরোধ করেন।
আরও পড়ুন: কুষ্টিয়ায় ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনায় যুবলীগ নেতাসহ ৩ আসামি রিমান্ডে
১৯১৫ সালের এপ্রিল মাসে যতীনের প্রধান সহযোগী মানবেন্দ্রনাথ রায় অস্ত্র সংগ্রহের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। তারা জার্মান জাহাজে করে সুমাত্রা বন্দরে অস্ত্র নিয়ে এসে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। তারপরে উড়িষ্যা উপকূলে বালেশ্বরে এক মুক্তিবাহিনী গঠন করেন। ওই সময় যতীনকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল যে গোলাবারুদে ভরা জাহাজটি গন্তব্যের পথে ছেড়ে গেছে। তবে, অস্ত্রের ওই চালানটি ভারতের উপকূলে পৌঁছানোর আগেই আন্তর্জাতিক গুপ্তচর এবং গোপন সংস্থা এটিকে জব্দ করে নেয়। পরে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃপক্ষকে এ চক্রান্ত সম্পর্কে অবহিত করা হয়।
বালেশ্বর যুদ্ধ
যতীন ও তার অনুসারীরা জার্মান থেকে আসা অস্ত্রের চালান গ্রহণের জন্য বালেশ্বরের নিকট উড়িষ্যার মায়ূরভঞ্জ জেলার কাপ্তিপদা গ্রামে অবস্থান নেন। ব্রিটিশ সরকারের কাছে এ তথ্য পৌঁছে গেলে তারা কোনো দেরি না করে অভিযানে নেমে পড়ে। কলকাতা থেকে খবর এল, একের পর এক বিপ্লবীদের কেন্দ্রগুলোতে তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ। বালেশ্বরের সন্ধান পেতে দেরি নেই। যতীন ও তার দল ময়ূরভঞ্জের রুক্ষ ভূখণ্ড দিয়ে দুই দিন পায়ে হেঁটে বালেশ্বর রেলওয়ে স্টেশন পৌঁছেছিল। তারা বালেশ্বরের চশখন্ড গ্রামের একটি টিলাতে ১৯১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আশ্রয় নিয়েছিলেন। দলের অন্য সদস্যরা যতীনকে নিরাপদে জায়গাটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। অন্যদিকটা দিয়ে তারা পাহারা দিচ্ছিলেন। তবে সাহসী যতীন তার অনুসারীদের ছেড়ে যেতে অস্বীকৃতি জানান।
এরপরে, কলকাতা এবং বালেশ্বরের শীর্ষ ইউরোপীয় পুলিশ কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে ও ব্রিটিশ পুলিশের এক বিশাল ব্যাটালিয়ন চারদিক থেকে পাঁচ বিপ্লবীর ওপর আক্রমণ চালায়। এ সময় ব্রিটিশ এবং বিপ্লবীদের মধ্যে প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী বন্দুকযুদ্ধ হয়। আধুনিক রাইফেল সজ্জিত ব্রিটিশ পুলিশ এবং সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যতীনদের দলের সদস্যরা ঐতিহ্যবাহী মাউসার পিস্তল দিয়েই লড়াই চালিয়ে গেছেন।
এ যুদ্ধে যতীনের তলপেটে গুলি লাগে এবং পরের দিন ১০ সেপ্টেম্বর ৩৫ বছর বয়সে পরপারে পাড়ি জমান বিপ্লবী এ মহানায়ক। মৃত্যুর আগে দিয়ে যাওয়া এক বিবৃতিতে কর্মকাণ্ডের দায়িত্বভার নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন এবং তার অনুসারীরা যাতে ন্যায়বিচার পায় সে আহ্বান জানিয়ে যান। যদিও, তার মৃত্যুর দুই মাস পরে তার অনুসারী মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত এবং নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল।
আরও পড়ুন: কুষ্টিয়ায় বাঘা যতীনের ভাস্কর্য ভাঙচুর: যুবলীগ নেতাসহ গ্রেপ্তার ৩
বিখ্যাত ব্রিটিশ পুলিশ কর্মকর্তা চার্লস টেগার্ট তার সহকর্মীদের একটি কথা বলতেন। তা হলো- বাঘা যতীন যদি একজন ইংরেজ হতেন তবে তার মূর্তিটিকে সেন্ট্রাল লন্ডনের ট্রাফলগার স্কয়ারে নেলসনের কলামের পাশে তৈরি করা হতো।
বাঘা যতীনের ভাস্কর্য ভাঙচুর
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এ সাহসী বীরের প্রতি কি আজও আমরা যথেষ্ট শ্রদ্ধা জানাতে পারছি? সম্প্রতি কিছু দুর্বৃত্ত কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলায় বাঘা যতীনের ভাস্কর্য ভাঙচুর করেছে। যা বাংলাদেশের মতো একটি সার্বভৌম দেশের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। বাংলাদেশের স্বর্ণালী অতীত ইতিহাস আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। বরং ভুলে যাওয়া ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের মহানায়ক বাঘা যতীনকে সম্মান জানাতে হবে এবং সেই সাথে ঘৃণ্য, অসহিষ্ণু ও চরমপন্থীদের সব অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।