রংপুরে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অনুপ্রবেশ করে মব সৃষ্টি ও অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে— এমন তথ্য রয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর হাতে। এনএসআইয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে জানান, কিছুদিন ধরে বিভিন্ন কর্মসূচিতে প্রবেশ করছে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এতে মব সৃষ্টিসহ নানা অরাজকতা সৃষ্টি হতে পারে।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় রংপুরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সামনের সারিতে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ নেতাদের অংশগ্রহণ নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় চলছে। এ ঘটনায় এখনো কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ঠাকুরগাঁও, রাজশাহী, গোপালগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কয়েকটি গ্রুপ রংপুরে এসে আন্দোলনের ভেতরে ঢুকে নাশকতা তৈরির চেষ্টা করছে।
পুলিশ জানিয়েছে, অনুপ্রবেশকারীরা চিহ্নিত। তাদেরকে গ্রেপ্তারে সাঁড়াশি অভিযান চলছে।
অন্যদিকে তদন্ত সংস্থাগুলো নিশ্চিত করেছে, এসব অনুপ্রবেশকারীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদে থাকা ছাত্রলীগ থেকে আসা কয়েকজন নেতা।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ট্র্যাজেডি ইস্যুতে বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) রংপুর মহানগরীতে আন্দোলন ঘোষণা করে শিক্ষার্থীরা। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে মহানগরীর কাচারি বাজারের ট্রাফিক পুলিশ বক্সের ভিতরে একজন কাফনের কাপড় পড়ে দাঁড়িয়ে যান। তাতে একহাতে উঁচিয়ে লেখা ছিল লাল প্লাকার্ডে বিচার। অপর হাতে নিচু করে তাতে দাড়িপাল্লার একপাশে একটি কফিন আরেক পাশে টাকা ও পিস্তল। এনিয়ে তোলপাড় তৈরি হয় পুরো নগরীতে।
পড়ুন: নারীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগে বিএনপি নেতাকে গাছের সঙ্গে বাঁধল গ্রামবাসী
ওই ছবিটি ফেসবুকে শেয়ার করে একটি পোস্ট দেন রংপুর মহানগর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক ইমতিয়াজ আহমেদ ইমতি। ওই পোস্টে ইমতি লেখেন ‘একটু আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা এভাবেই দাঁড়িয়েছিল রংপুর ডিসি অফিসের সামনে, এতো নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালানোর পরও যাদের মাঝে বিন্দু পরিমাণ অনুশোচনা বোধটুকু নেই। তারা আসছে বিচারের নামে প্রোপাগান্ডা চালাতে। ১০ মিনিট দাঁড়ায় থাকার হ্যাডাম হলো না?’
ইমতি লেখেন, ‘২৪ বিপ্লবে শহীদ হওয়া আমার ভাইবোনদের রক্তের সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করে বলছি, রংপুরের মাটিতে এভাবে আর কখনো ফ্যাসিস্ট কোনো শক্তি দাঁড়ানোর সাহস দেখালে পুলিশ প্রশাসনকে লাগবে না, আমি লড়বো তাদের বিপক্ষে, ইনশাআল্লাহ। বিশ্বাস রাখি, রংপুরের বিপ্লবী ছাত্র-জনতা পাশে থাকবে এবং তাদের সমূলে প্রতিহত করবে।’
পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ‘সেখানে যিনি দাঁড়িয়েছিলেন তার নাম মোহাম্মদ তানভীর হোসেন রিদম। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করছেন চলতি বছরে। তার বাসা নগরীর সেনপাড়া এলাকায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে কী পদবি—তা তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারেনি পুলিশ।’
এদিকে শিক্ষা উপদেষ্টা ও সচিবের পদত্যাগের দাবিতে গত মঙ্গলবার (২২ জুলাই) নগরীর কাচারি বাজার এলাকায় শিক্ষা অফিস ঘেরাও করে বিক্ষোভ করে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা। এ সময় শিক্ষার্থীরা অফিসের সামনে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন দাবিতে স্লোগান ও বক্তব্য দেয়।
এ প্রতিবাদ কর্মসূচির সামনের সারিতে দেখা যায় পীরগাছার অন্নদাগর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান বিজয়কে। আন্দোলনকারীরা জানায়, ‘এ সময় আতাউর শিক্ষার্থীদের উত্তেজিত করতে একাধিকবার উসকানিমূলক স্লোগান দেয় এবং শিক্ষা অফিসে মব তৈরির চেষ্টা করেন। এছাড়া এ কর্মসূচিতে থাকা অনেককেই অচেনা বলে জানান আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীরা।
পড়ুন: ভারতে প্রবেশের সময় ৭ মামলার আসামি ছাত্রলীগ নেতা গ্রেপ্তার
ছাত্রলীগ নেতা আতাউর রহমান বিজয়ের ছবি এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ জুলাই যোদ্ধারা। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওই ছবি পোস্ট করে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
এ বিষয়েও ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন মহানগর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক ইমতিয়াজ আহমেদ ইমতি। ওই পোস্টে ইমতি লেখেন, ‘আমার রংপুরের কোমলমতি ভাইবোনদের আন্দোলনের মাঝে ছাত্রলীগ ঢুকেছে, আপনারা সকলেই জানেন এই শোকাবহ সময়ে পুরো বিষয়টাকে নোংরাভাবে উপস্থাপন এবং দেশকে অস্থিতিশীল করতে আন্দোলনের মাঝে ঢুকেছিল ছাত্রলীগ।’
ইমতি আরো লেখেন, ‘রংপুরেও তাদের পরিকল্পনা ছিল আন্দোলন উসকিয়ে দিয়ে শিক্ষা অফিসে ভাঙচুর করা। প্রশাসনের বিচক্ষণতায় সেদিন তা সামলানো গেছে। কোনোভাবেই আমরা চাই না আমাদের স্নেহের ভাইবোনদের কোনো বিপদের কারণ এই সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ হোক। শিক্ষার্থীদের যেকোনো যৌক্তিক দাবিতে আমরা তাদের সঙ্গে সামনের সারিতে থাকব, ইনশাআল্লাহ। তবে এই লীগের দেখা পেলে তাদের সঙ্গে আর কোনো আপস হবে না।’
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য মতে, এরই মধ্যে রংপুরে ঠাকুরগাঁও, রাজশাহী, গোপালগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা রংপুরে এসে অবস্থান নিয়েছে। তারা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে ঢুকে যেকোনো মুহূর্তে বড় ধরনের নাশকতার করতে পারে।
সূত্রগুলো জানায়, ২২ জুলাই পীরগাছার ছাত্রলীগ নেতা আতাউর রহমান বিজয় আন্দোলনে যোগ দিয়ে শিক্ষার্থীদের উসকে মব তৈরির মাধ্যমে শিক্ষা অফিস ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্রুততম সময়ে ব্যবস্থা নেওয়ায় বিজয়সহ বেশ কয়েকজন পালিয়ে যায়।
পড়ুন: শ্যামপুরে বাসে আগুন দেওয়ার চেষ্টা, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কর্মী গ্রেফতার
গোয়েন্দা সূত্রগুলো আরও জানিয়েছে, রংপুরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের অনুপ্রবেশের পেছনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের মধ্যে থাকা ছাত্রলীগ থেকে আসা নেতাদের প্রশ্রয়ের প্রমাণও পেয়েছেন তারা। তাদের সকল কর্মকাণ্ড মনিটরিং করা হচ্ছে। বিশেষ করে তাদের সকল ডিজিটাল ডিভাইস ও অ্যাকাউন্টে কড়া নজরদারিও রাখছে গোয়েন্দা বিভাগের সংশ্লিষ্টরা।
এ ব্যাপারে রংপুর মহানগর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক ইমতিয়াজ আহমেদ ইমতি বলেন, ‘এখন মাইলস্টোন ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে রংপুরকে অস্থিতিশীল করতে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা তৎপর। তারা ছদ্মবেশে অত্যন্ত কৌশলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ঢুকে পড়ছে এবং মব তৈরি করে নাশকতার চেষ্টা করছে। তাদের গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা লক্ষ্য করছি না।’
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ রংপুর মহানগর কমিটির মুখপাত্র (গেল বছর ১৬ জুলাই রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে গুলিবিদ্ধ আবু সাঈদকে প্রথম উদ্ধারকারী) সিয়াম আহসান আয়ান বলেন, ‘নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ পরিকল্পিতভাবে আমাদের শিক্ষা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে সরকারের সংস্কার আন্দোলনকে অন্যদিকে ঘুরানোর অপচেষ্টা করছে। আমরা এজন্য সতর্ক অবস্থায় আছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলবো আপনারা তৎপরত হোন। নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের এই অপচেষ্টা রংপুরে জিরো টলারেন্সে আমরা প্রতিহত করব।’
রংপুর মহানগর যুবদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক জহির আলম নয়ন বলেন, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের বিভিন্ন নেতাকর্মীরা রংপুরের নানা কর্মসূচিতে অনুপ্রবেশ করে মব সৃষ্টির চেষ্টা করছে। এটি অশনি সংকেত। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে আরও তৎপর হতে হবে। প্রতিহত করতে হবে ফ্যাসিস্টদের। আমরা বিএনপির প্রতিটি সদস্য সজাগ রয়েছি।
এ ব্যাপারে রংপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মজিদ আলী জানান, ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ কৌশলী ঢুকে পড়াদের ব্যাপারে আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় আছি। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ঘিরে আমরা কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছি।