নানা সমস্যায় জর্জরিত সুনামগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেলা সদর হাসপাতাল। ভবনসহ সব সুযোগ-সুবিধা থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে ৩৬ জন চিকিৎসক, ৭৪ জন নার্সের পদ শূন্য রয়েছে।
প্রায় ২৭ লাখ মানুষের চিকিৎসা সেবার একমাত্র ভরসার জায়গা জেলার এই সদর হাসপাতালটি এখন নিজেই রোগে আক্রান্ত। জেলার ১২ উপজেলার রোগীরা হাসপাতালে সঠিক চিকিৎসা সেবা না পেয়ে সিলেটসহ বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে এলাকার গরীব অসহায় রোগীরা মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।
শনিবার (৪ জানুয়ারি) সকালে হাসপাতালের ভবনটিতে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, জেলা সদর হাসপাতালটির খাবার সরবরাহ নিয়ে এখানে ভর্তি হওয়া রোগীদের রয়েছে নানান অভিযোগ। ওয়ার্ডের ওয়াসরুম (টয়লেট) নোংরা, ওয়ার্ডের ভিতরে দুর্গন্ধ। শিশু ওয়ার্ড, মহিলা ওয়ার্ড, সার্জারি ওয়ার্ডে রোগীরা বেড না পেয়ে ফ্লোরে গাদাগাদি করে চিকিৎসা নিচ্ছেন। রোগীর সঙ্গে থাকা লোকজনও তাদের সঙ্গেই শুয়ে আছেন। বহিরাগতদের আনাগোণাও লক্ষ্য করা গেছে।
দিরাই উপজেলার মনোয়ারা বেগম জানান, ‘তার ৭ মাসের নাতির পাতলা পায়খানা হয়েছে। দুইদিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।’ ওয়ার্ডের ভেতরে পর্যাপ্ত পরিমাণে সিট না থাকায় মেঝেতে রেখেই চিকিৎসা নিচ্ছেন তারা। যে ওয়ার্ডে ১০ জন রোগী থাকার কথা সেখানে ২০ জন রোগী গাদাগাদি করে চিকিৎসা নিচ্ছেন। প্রতিটি ওয়ার্ডের টয়লেট খুবই নোংরা, আর্বজনায় ভরপুর। নিয়মিত পরিষ্কার না করায় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। মশা-মাছি উড়ছে। এখানে চিকিৎসা নিতে এসে আরও অসুস্থ হতে হচ্ছে রোগিসহ সঙ্গে থাকা স্বজনদের। দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালের এক্সরে মেশিনটি অকেজো হয়ে আছে, কারো কোনো খেয়াল নাই।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ধনপুর গ্রামের রহিমা বেগম জানান, তিনি চারদিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ৪ দিন সকালে পেয়েছেন ডিম, পাউরুটি আর কলা। দুইদিন পেয়েছেন সেমাই ও পাউরুটি। কিন্তু হাসপাতালের খাদ্য তালিকায় রোগীদের সকালের নাস্তা বাবদ, ডিম, কলা, পাউরুটি ও চিনি দেওয়া আছে। দুপুরের ও রাতের খাবার তালিকায় আছে মাছ, মুরগি, ডাল ও সবজি। কিন্তু রোগীদের দুপুর ও রাতে দেওয়া হচ্ছে শুধু পোল্ট্রি মুরগি আর ডাল।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, জেলা সদর হাসপাতালটিতে ৬৬জন এমবিবিএসসহ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকার অনুমোদন থাকলেও বর্তমানে কমর্রত ৩০ জন চিকিৎসক। দীর্ঘদিন ধরে ৩৬ জন চিকিৎসকের পদ শূন্য রয়েছে। চিকিৎসকের শূন্য পদগুলোর মধ্যে রয়েছে সিনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারি), সিনিয়র কনসালটেন্ট (চক্ষু), জুনিয়র কনসালটেন্ট (চক্ষু), সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি) সিনিয়র কনসালটেন্ট (গাইনি), সিনিয়র কনসালটেন্ট (কার্ডিওলজি), সিনিয়র কনসালটেন্ট (ডেন্টাল), জুনিয়র কনসালটেন্ট (প্যাথলজি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (রেডিওলজি)। অপরদিকে দ্বিতীয় শ্রেণির নার্সসহ ২৬৪টি পদের মধ্যে শূন্য রয়েছে ৭৪টি পদ। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর ৩৮টি পদের মধ্যে ১৯টি শূন্য এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর ২৮টি পদের মধ্যে ১৩টি পদ শূন্য রয়েছে।
জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ডা. মো. রফিকুল ইসলাম জানান, ২৫০ শয্যা হাসপাতালে এখন শীত মৌসুম হওয়ায় রোগীর সংখ্যা একটু কম। এরপরও এখানে দৈনিক ভর্তি হচ্ছেন ৪০০ থেকে ৫০০ রোগী। গরমের মৌসুমে রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৭০০ এর উপরে। ২৫০ শয্যা হাসপাতাল হওয়ায় তারা ২৫০ ডিম প্রতিদিন রোগীদের দিতে পারেন, এর চেয়ে বেশি দিতে পারেন না। যার কারণে খাবারে সমন্বয় করে ডিম দিতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘জেলার এতো বড় একটি হাসপাতালে সার্জারি বিভাগের কোনো চিকিৎসক না থাকায় আমরাও হতাশ। এতে ছোটোখাটো সব সার্জারি রোগীদেরও সিলেট রেফার করতে হচ্ছে, এটা আমাদের জন্য লজ্জার। আমি সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকসহ শূন্য পদে চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি।’
টয়লেট নোংরার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা সত্য অতিরিক্ত রোগীর চাপে টয়লেট পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা যাচ্ছে না। বিষয়টি গণপূর্ত বিভাগ দেখেন। জেলা গণপূর্ত বিভাগকে এ ব্যাপারে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারা টয়লেটর সমস্যা দ্রুত সমাধান করে দেবেন বলে জানিয়েছেন।’
সিভিল সার্জন ডা. মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘জেলা সদর হাসপাতালের বিষয়টি দেখভাল করে তত্ত্বাবধায়ক। হাসপাতালে জনবহুল সংকটের কারণেই এ সমস্যাগুলো দেখা দিয়েছে। ইদানীং জনবল সংকট দূর করার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। আশাকরি চিকিৎসকসহ জনবল সংকট দূর হবে এবং হাসপাতালের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।’