কিউলেক্স
রাজধানীতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে মশার উপদ্রব, নগরজুড়ে উদ্বেগ
মাসউদুল হক, ১৭ ফেব্রুয়ারি (ইউএনবি)— রাজধানীতে সম্প্রতি মশার উপদ্রব উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে কিউলেক্স মশার সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে নগরবাসী। মশার এই উপদ্রবে শুধু ঘুমের ব্যাঘাতই হচ্ছে না; ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ও চিকুনগুনিয়ার মতো রোগের ঝুঁকিও বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালে সারা দেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু শনাক্ত হন ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন। বছরজুড়ে এই রোগে প্রাণ হারান ৫৭৫ জন। দেশের অন্যান্য জায়গার তুলনায় রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার অনেক বেশি।
মশক নিধন কার্যক্রম কখনোই খুব শক্তিশালী ছিল না ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে। কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও তাই এর সুফল সেভাবে পায় না নগরবাসী। প্রতি বছর মশা নিয়ন্ত্রণে নানা কার্যক্রম হাতে নেওয়া হলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ কম।
সিটি করপোরেশন যা বলছে
সম্প্রতি মশার বাড়বাড়ন্ত নিয়ে নগরবাসীর অভিযোগ, কিউলেক্স মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন তারা। মশা নিধনে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কেউ। আগে সপ্তাহে একবার মশার ওষুধ ছিটালেও এখন এক মাসেও তাদের দেখা মেলা ভার। ফলে দিন-রাত বাসাবাড়িতে মশায় কামড়ায়। সারা দিন বাসায় কয়েল জ্বালিয়ে বা মশারি টানিয়ে রাখতে হয়।
আরও পড়ুন: দেশে প্রথমবারের মতো ৫ জনের শরীরে রিওভাইরাস শনাক্ত
তবে এসব অভিযোগ পাশ কাটিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) দাবি, মশা নিধনে তারা প্রতিদিনই ওষুধ ছিটায় এবং এ বিষয়ে বিভিন্ন অভিযানও অব্যাহত আছে।
এমনকি মানুষকে সচেতন করতে নানা সময় জরিমানাও করা হচ্ছে, কিন্তু যে হারে মশার উপদ্রব বাড়ছে, তা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে দাবি তাদের।
সরকারি কর্মকর্তাদের দাবি
স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব নিজাম উদ্দিন ইউএনবিকে বলেন, ‘মশা নিধনের জন্য ঢাকার দুই সিটিকে (করপোরেশন) প্রতিনিয়ত মশা নিধনে অভিযান অব্যাহত রাখার নির্দেশনা দিয়েছি। যেহেতু এখন নির্বাচিত কেউ (সিটি মেয়র) নেই, তাই আমাদের দুই প্রশাসক প্রতিটি জোন ভাগ করে দিয়েছেন; সে অনুযায়ী কাজ চলছে।’
তিনি বলেন, ‘মশা নিধনে যা করণীয়, আমরা তা-ই করব। এজন্য মানুষকেও সচেতন হতে হবে। যেকোনো জায়গায় ময়লা, পানি জমিয়ে রাখাসহ যেসব কারণে মশার বৃদ্ধি ঘটে, সচেতনভাবে সেসব কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। তারপরও যারা অবহেলা করছেন তাদের জরিমানা করা হচ্ছে।’
শুধু ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পেলে নয়, বছরব্যাপী মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যক্রম পরিচালনা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
আরও পড়ুন: কোভিড ল্যাবসৃষ্ট ভাইরাস: আস্থা কম সিআইএ’র সিদ্ধান্তে
বিশেষজ্ঞদের হুঁশিয়ারি
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ইউএনবিকে বলেন, ‘জানুয়ারি মাসের শুরু থেকে নগরীতে কিউলেক্স মশা বাড়ছে। এভাবে আগামী মার্চ পর্যন্ত মশা বাড়বে।’
‘মশা বৃদ্ধি পাওয়ায় নগরবাসীর কষ্ট সহজেই অনুমান করা যায়। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে দুই সিটি করপোরেশনের উচিত ডেঙ্গুর মতো কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণেও পদক্ষেপ নেওয়া। তা না করলে এ বছর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাও বাড়বে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের সমঝোতা স্মারকে বেশ কয়েকটি শর্ত ছিল, যার অধিকাংশই পূরণ হয়নি। শুধু একটি শর্ত তারা পালন করছে, সেটি হলো—ডিএনসিসির পাঁচটা জোনে শুধু গবেষণা করা। অর্থাৎ ওয়ার্ডগুলোতে মশার লার্ভা কেমন আছে, কোনটাতে বেশি, কোনটাতে কম, কোন ওয়ার্ডে বেশি ওষুধ ছিটাতে হবে বা কোন ধরনের ওধুষ ছিটাতে হবে—কেবল এসব নিয়ে কাজ হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহে আমরা ডিএনসিসিতে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাঠাচ্ছি। তবে তারা কাজ করছে কিনা, তা জানি না।’
নগরবাসীর ক্ষোভ
রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা মাইনুদ্দিন ইউএনবিকে বলেন, ‘আগে মাঠপর্যায়ে মশক নিধন কার্যক্রম তদারকি করতেন সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলররা। তবে গত ৫ আগস্টের পর সিটি করপোরেশনের সব ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ায় এখন মশার উপদ্রব নিয়ে কারও কোনো জবাবদিহি নেই। কে মশা নিধন করবে—আমরাও আসলে জানি না। বর্তমান সরকারের উচিত, রাজধানীর বাসিন্দাদের ভোগান্তির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এ বিষয়ে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া।’
বাড্ডায় বসবাসকারী জুনায়েদ বলেন, ‘মশা এখন প্রতিটি সময়ের সাথী। দিনেও মশারি লাগে, রাতেও মশারি, কী একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে! অথচ মশা নিধনে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখছি না। মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম সবসময়ই প্রশ্নবিদ্ধ। এখন তা চরম আকার ধারণ করেছে।’
আরও পড়ুন: ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে মৃত্যু নেই, হাসপাতালে ৬
মিরপুরের বাসিন্দা শহীদুল হক ইউএনবিকে বলেন, ‘এডিস মশার উপদ্রব অনেক বেড়েছে। এখন সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তা বা গলিতে দাঁড়ালেই মৌমাছির মতো চারদিক থেকে ঘিরে ধরে মশা। মশার কারণে বাচ্চাদের নিয়ে সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়।’
সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ
মশক নিধন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে নিয়মিত ফগার মেশিন ও লার্ভিসাইড প্রয়োগ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এছাড়া মশা নিধনে নতুন ওষুধও আমদানি করা হয়েছে বলে দাবি তাদের।এমনকি, পানি জমে থাকলে ভবন ও স্থাপনার মালিকদের জরিমানা করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছে তারা।
এর মধ্যে ডিএনসিসি বলছে, রাজধানীর ১৯৬ দশমিক ২২ বর্গকিলোমিটার এলাকার ৫৪টি ওয়ার্ড ডিএনসিসির আওতাভুক্ত। চলতি অর্থবছরে মশা নিধনে প্রায় ১১০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে তারা। এর মধ্যে মশা নিধনে কীটনাশক কিনতে রাখা হয় ৬৫ কোটি টাকা এবং বাকি অর্থ ফগার, হুইল, স্প্রে মেশিন ও পরিবহন, ব্লিচিং পাউডার ও জীবাণুনাশক ও মশা নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতি কিনতে বরাদ্দ রাখা হয়। এই টাকা দিয়েই ডিএনসিসির সবগুলো ওয়ার্ডে মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ জানায়, গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগ পর্যন্ত মশক নিধন কার্যক্রম ঠিকমতোই চলছিল। তবে তার পর থেকে মেয়র বা কাউন্সিলর না থাকায় এই কার্যক্রম স্থবির পড়ে। এখন যারা মশার ওষুধ ছিটান, তাদের তেমন কোনো জবাবদিহি নেই। ফলে ডেঙ্গুর পাশাপাশি কিউলেক্স মশাও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
অপরদিকে, এডিস ও কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে বছরব্যাপী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে বলে জানিয়েছে ডিএসসিসি।
তাদের দাবি, সে অনুযায়ী কার্যক্রমও চলছে। তারপরও কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এজন্য ২০ থেকে ৩১ জানুয়ারি ক্র্যাশ প্রোগ্রাম পরিচালনা করেছে তারা।
ডিএসসিসি সূত্র জানায়, মশা নিধনে ডিএসসিসি চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রেখেছে ৪৪ কোটি টাকা। তবে প্রয়োজনে বরাদ্ধ আরও বাড়ানো হবে।
মশা নিধনে ডিএসসিসির কার্যক্রম অব্যাহত আছে জানানো হলেও বাস্তবে তেমন কোনো কর্মকাণ্ড চোখে পড়েনি। ৫ আগস্টের পর থেকে মশক নিধন অভিযান চললেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
মশক নিধন কার্যক্রম নিয়ে নগরবাসী বারবার প্রশ্ন তুললেও এ বিষয়ে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। এ অবস্থা থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রাণ পেতে নগরবাসীর নিজেদেরই সচেতন হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
তবে আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় এবং নগরবাসীকে সঙ্গে নিয়ে সরকার ও সিটি করপোরেশন সম্মিলিত উদ্যোগ নিয়ে তা বাস্তবায়ন করলেই মিলবে সত্যিকারের সমাধান। আর এমন কিছুরই আশায় দিন-রাত মশার কামড় সহ্য করে চলেছে রাজধানীতে বসবাসরত বিপুল জনগোষ্ঠী।
৩৯ দিন আগে
অ্যানোফিলিস ও কিউলেক্স মশা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই: এলজিআরডি মন্ত্রী
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বুধবার বলেছেন, অ্যানোফিলিস ও কিউলেক্স মশা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই।
১৪৮৬ দিন আগে