আপন ঠিকানা
আপন ঠিকানা : হারানো স্বজনদের খুঁজে পেতে আরজে কিবরিয়ার মহৎ উদ্যোগ
‘ত্রিশ বছর পর জাহানারা খুঁজে পেলো তার পরিবার’, ‘ভাইবোনকে খুঁজে পেতে মানসিক ভারসাম্যহীন ফজলুর আপ্রাণ চেষ্টা’, ‘বাইশ বছর পর বাবা-মার বুকে ফিরে গেলো তানজিমা’; এরকম আরও অনেক ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে আরজে কিবরিয়ার আপন ঠিকানা অনুষ্ঠানটি।
যথাসম্ভব সঠিক তথ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতে হারিয়ে যাওয়া মানুষটির স্বজনদের খুঁজে পেতে সাহায্য করে আপন ঠিকানা টিম। ২০২১ সালের প্রারম্ভে এই মহান উদ্দেশ্য নিয়ে এগোতেই গণ ও সামাজিক মাধ্যমগুলো থেকে ব্যাপক সাড়া আসে। চলুন, গণমাধ্যম কর্মী আরজে কিবরিয়ার এই অভিনব উদ্যোগের ব্যাপারে বিস্তারিত জেনে নিই।
আপন ঠিকানার শুরুর গল্প
ঢাকা এফএম ৯০.৪ এ লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড নামে একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন আরজে কিবরিয়া। সেখানে অতিথিরা নিজেদের হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের কথা বলতেন। অতঃপর শ্রোতাদের মধ্যে থেকে তাদের স্বজনদের পরিচিত অথবা স্বজনরা লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড টিমের সাথে যোগাযোগ করতো। এভাবে হারানো স্বজনদের খুঁজে পেতো তাদের পরিবার।
আরও পড়ুন: ২০০ কেজি সোনায় কারুকার্যমণ্ডিত হতে যাচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পবিত্র কোরআন
এই লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড শোয়ের আঙ্গিকেই জনপ্রিয় আরজে কিবরিয়া নিজের ইউটিউব চ্যানেলে আপন ঠিকানা অনুষ্ঠানটি শুরু করেন। অনুষ্ঠানটি মূলত তার নিজের প্রতিষ্ঠিত স্টুডিও অফ ক্রিয়েটিভ আর্টসের প্রথম প্রোজেক্ট। প্রথম ভিডিও প্রকাশ করেন ২০২১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি নাসিমা নামে এক মেয়ে তার মাকে খুঁজে পাওয়ার গল্প নিয়ে। তিন দিন পর ৯ ফেব্রুয়ারি ভিডিটি নিজের ফেসবুক পেজেও প্রকাশ করেন আরজে কিবরিয়া।
সামাজিক মাধ্যম জুড়ে আপন ঠিকানা
আরজে কিবরিয়ার সাথে সারা দেশের লাখ লাখ মানুষ শরীক হয়েছে হারানো স্বজনদের খুঁজে বের করার প্রচেষ্টায়। অনুষ্ঠানটি শুরুর পর কয়েক মাসেই আপন ঠিকানা টিমের কর্মতৎপরতা সবার নজরে আসে। প্রতিটি সন্ধানের সময় হারিয়ে যাওয়া মানুষটির কাছ থেকে যথাসম্ভব সব রকম তথ্য নিয়ে তা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পরিবারের লোকজনদের দেয়া তথ্যের সাথে মিলিয়ে দেখা হয়।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশে ই-পাসপোর্ট করার নিয়ম: প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও খরচ
উদ্যোগটি গ্রহণের ১০ মাসের মাথায় আপন ঠিকানার মোট এপিসোড সংখ্যা ৮১টি। লাখ লাখ দর্শকদের কাছে জনপ্রিয়তা পাওয়া এই এপিসোডগুলোতে উঠে এসেছে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর দুঃখময় জীবনের কথা।
মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ১১ বছর ধরে নিখোঁজ সুরভীর দুঃখ ভারাক্রান্ত বাবা-মার আর্তনাদ, অন্য পরিবারে বেড়ে ওঠা মেয়ে কেয়ার আসল পরিবারে ফিরে যাওয়া, ২০ বছর পর বাবাকে চিন্তে না পারায় অস্বস্তি ও উদ্বেগের দোলাচলে থাকা ঝর্ণার গল্প নিয়ে বহুল আলোচিত হয়েছে সামাজিক মাধ্যম জুড়ে। আর এই গল্পগুলো সারা দেশের মানুষ শেয়ারের কারণে আপন ঠিকানার প্রতি দর্শকদের প্রতিক্রিয়া বুঝার পাশাপাশি সম্ভব হয়েছে স্বজনহারা মানুষগুলোকে নিজেদের পরিজনদের কাছে সফলভাবে পৌঁছে দেয়া।
বেতার মাধ্যমে জনপ্রিয় নাম আরজে কিবরিয়া
ক্যারিয়ারের শুরুটা ছিল ২০০৬ সালে রেডিও টুডেতে কথাবন্ধু হিসেবে যোগ দেয়ার মাধ্যমে। তারপর থেকে বেতার মাধ্যমে ১৪টি বছর কাটিয়ে দিয়েছেন মো. গোলাম কিবরিয়া সরকার বা সবার প্রিয় আরজে কিবরিয়া। আরজে, টিভি উপস্থাপক, কনটেন্ট নির্মাতা কিবরিয়া বর্তমানে রেডিও আম্বার ১০২.৪ এর স্টেশন ইনচার্জ এবং ঢাকা এফএম ৯০.৪ এর নির্বাহী প্রযোজক। ইতোমধ্যে তিনি জীবন গল্প, সিক্রেটস, তারার রাত ও লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড অনুষ্ঠানগুলো সঞ্চালনের মাধ্যমে নিজের একটা ব্র্যান্ড তৈরি করে ফেলেছেন। স্টুডিও অফ ক্রিয়েটিভ আর্টস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের খাতায়ও নিজের নাম লেখালেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক প্রশাসন বিভাগে ১ম শ্রেণিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করা কিবরিয়া মানুষ ও মানুষের গল্প নির্ভর কনটেন্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চান। বাংলাদেশের আরজেদের মধ্যে তিনিই প্রথম যিনি সর্বপ্রথম ইউটিউব সিলভার বাটন পাওয়ার সম্মান অর্জন করেছেন, তাও মাত্র পাঁচ মাসে।
আরও পড়ুন: তোগুড়: তরমুজের রস দিয়ে বানানো নতুন গুড়
আরজে কিবরিয়ার সঞ্চালিত প্রতিটি অনুষ্ঠান-ই জীবনধর্মী। তার কনেটেণ্টের বিশেষত্ব হলো, তিনি প্রতিটি মানুষের জীবনের গল্প সর্বস্তরের দর্শকদের জন্য আকর্ষণীয় ও শিক্ষণীয়ভাবে তুলে ধরেন। সেসব অনুষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি এই আপন ঠিকানা সামাজিক মাধ্যমের সঠিক প্রয়োগের উপায় এবং সুফলের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। শুধু বিনোদনের বাহন নয়, সামাজিক মাধ্যম হতে পারে দিন বদলের এক শক্ত হাতিয়ার।
৩ বছর আগে
১৭ বছর পর বাবা-মায়ের সন্ধান পেলেন শাহরাস্তির সবুজ
ঢাকায় আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়ানো শেষে বাড়ি ফেরার পথে শিশুকালে হারিয়ে যাওয়া সবুজ ১৭ বছর পর বাবা-মায়ের সন্ধান পেলেন।
মঙ্গলবার জনপ্রিয় রেডিও উপস্থাপক আর জে কিবরিয়ার ‘আপন ঠিকানা’ অনুষ্ঠানে সবুজকে নিয়ে আসেন বেসরকারি এনজিও ‘ফ্যামিলিজ ফর চিল্ড্রেন’র পরিচালক শিখা বিশ্বাস। সেখানে তাকে নিয়ে প্রচারিত একটি ভিডিও প্রতিবেদনের মাধ্যমে তার পরিচয় এবং ঠিকানা নিশ্চিত হওয়া গেছে।
আরও পড়ুন: ঘুমন্ত বাবা-মায়ের পাশ থেকে ১৭ দিনের শিশু চুরি
লাইভে কথা বলতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে সবুজ আকুতি দিয়ে বলেন, ‘জীবনে একটাই চাওয়া, শুধু মায়েরে একবার মন ভইরা দেখতে চাই।’
সবুজ বর্তমানে সিরাজগঞ্জ খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছেন। লকডাউন শেষে তাকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে আনা হবে।
সুবজ চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার সুচিপড়া গ্রামের খলিল মেম্বার বাড়ির বাসু (বাশার বা বশির) মিয়ার ছেলে।
২০০৪ সালে ঢাকায় খালুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে চাঁদপুরের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সময় ডেমরা এলাকা থেকে হারিয়ে যান তিনি। এরপর দীর্ঘদিন খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন: বগুড়ায় হাসপাতাল থেকে শিশু চুরিকালে নারী আটক
তার পরিচয় নিশ্চিত করেছেন সুচিপাড়া উত্তর ইউনিয়নের কাজী মাওলানা মোস্তফা কামাল এবং তার ছেলে হাসান মাহমুদ। মোবাইলে সবুজের মামা রাশেদ আলমও বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
সবুজের মামা রাশেদ আলম বলেন, ‘এই সবুজ ২০০৪ সালে হারিয়ে যাওয়া সবুজ। কারণ সবুজের দেয়া তথ্য অনুসারে তার অন্যান্য ভাইবোন, বাবা-মা, খালা-খালু এবং খালাতো ভাইয়ের নাম পুরোপুরি মিলে গেছে।
তিনি বলেন, সে জানায় যে তার মায়ের নাম খোদেজা বেগম।পাঁচ ভাইবোন, বড়বোন শিউলি, তারপর সবুজ, এরপর ছোটবোন সাথী এবং ছোটভাই শাকিব ও সাকিল। দাদা লাল মিয়া। তার দেয়া তথ্য হারিয়ে যাওয়া সবুজের তথ্যের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে গেছে।’
আরও পড়ুন: মেয়ের কোল ভরিয়ে দিতে হাসপাতাল থেকে শিশু চুরি করলেন মা
পরিবার সূত্রে জানা যায়, ২০০৪ সালে সবুজ তার দাদা লাল মিয়ার সঙ্গে রাজধানী ঢাকাতে ফুফু এবং খালুর বাসায় বেড়াতে যান। খালুর বাসায় কয়েকদিন বেড়ানোর পর বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন তারা। বাড়ি ফেরার সময় তার খালা সবুজকে কিছু টাকা দেন খেলনা কেনার জন্য। বাড়ি ফেরার পথে খেলনার দোকান দেখে সবুজ বেঁকে বসেন ফুটবল কিনে দিতে হবে। দাদা লাল মিয়া তাকে বাড়ি গিয়ে খেলনা কিনে দেয়ার কথা বললেও তিনি নাছোড়বান্দা, খেলনা ছাড়া বাড়ি যাবে না। এতে দাদা লাল মিয়া রাগ করে একটু সামনে গেলে অগণিত মানুষের ভিড়ের মধ্যে পড়ে দাদা-নাতির বিচ্ছেদ হয়ে যায়। অনেক খুঁজেও দাদা নাতিকে না পেয়ে বাড়ি ফেরেন বুকে কষ্ট নিয়ে।
ওদিকে দাদাকে হারিয়ে একা হয়ে গিয়ে সবুজ বসে বসে কাঁদতে থাকেন। তখন এক মুদি দোকানদার সবুজকে বাসায় নিয়ে যান। পরদিন তিনি ডেমরা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে তাকে পুলিশের কাছে দিয়ে আসেন।
সবুজের পরিবারের কোনো সন্ধান না পাওয়ায় থানা পুলিশ ‘অপরাজেয় বাংলাদেশ’ নামের একটি এনজিওর কাছে সবুজকে হস্থান্তর করে। এনজিওটি কয়েক মাস তাদের কাছে রেখে সবুজের পরিবারের সন্ধান না পেয়ে আরেক বেসরকারি এনজিও ‘ফ্যামিলিজ ফর চিল্ড্রেন’-এর কাছে হস্তান্তর করে ২০০৫ সালে।
ফ্যামিলিজ ফর চিল্ড্রেনের পরিচালক শিখা বিশ্বাস জানান, সবুজ অনেক মেধাবী ছাত্র। তাই স্থানীয় স্পন্সরের সহযোগিতায় আমরা তাকে লেখাপড়ার সুযোগ করে দিয়েছি। বর্তমানে তিনি সিরাজগঞ্জ খাজা আলী ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়ন করছেন।
মঙ্গলবার জনপ্রিয় রেডিও উপস্থাপক আর জে কিবরিয়ার ‘আপন ঠিকানা’ অনুষ্ঠানে সবুজকে লাইভে নিয়ে আসেন ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেনের পরিচালক শিখা বিশ্বাস। ভিডিওটি প্রচারের সময় সবুজের বাল্যকালের কিছু ছবিও পরিদর্শন করা হয়। এ সময় সবুজের দেয়া তথ্য হারিয়ে যাওয়া সবুজের তথ্যের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় এক ঘণ্টার মধ্যে কেশরাঙা গ্রামের রাশেদ আলম (সবুজের মামা) নিশ্চিত করেন সবুজ তার ভাগিনা।
সবুজের মামা রাশেদ আলম বলেন, বিষয়টি আমার বোন এবং ভগ্নিপতি নিশ্চিত করেন এবং তারা হারিয়ে যাওয়া ছেলের সন্ধান পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে আছেন।
ইউএনবিকে সবুজের মা ও মামা খোরশেদ আলম জানান, লকডাউন শেষ হলেই যোগাযোগ করে আমরা সবুজের সঙ্গে দেখা করব। তাকে বাড়ি নিয়ে আসব, ইনশাল্লাহ। এখন অপেক্ষার প্রহর গুনছি।
৩ বছর আগে