গাণিতিক মডেলিং
জুনের আগে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হবে না: বিশেষজ্ঞ মতামত
বাংলাদেশ বর্তমানে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দিন দিন পরিস্থিতি অবনতির দিকেই যাচ্ছে। আগামী জুন মাসের আগে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হবে না বলে জানিয়েছেন স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের দল বাংলাদেশ কমো মডেলিং গ্রুপ।
বাংলাদেশ ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত দলটি গাণিতিক মডেলিং ব্যবহার করে করোনার পূর্বাভাস জানার চেষ্টা করেন। গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে আগামী মে মাসের শেষ নাগাদ করোনা পরিস্থিতি বর্তমান অবস্থাতেই থাকবে। তবে জুন মাস থেকে পরিস্থিতি উন্নতি হবার সম্ভাবনা রয়েছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
তবে স্থানীয় কিছু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ের দিকে যাচ্ছে। তাদের মতে, করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সরকার লকডাউন কার্যকর করার আগেই অনেক মানুষ রাজধানী ছেড়ে নিজ জেলায় চলে যায়। এর ফলে ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতেও এখন দ্রুত করোনা সংক্রমণ বেড়েই চলেছে।
আরও পড়ুন: করোনায় ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত কমলেও মৃত্যু বেড়েছে
বাংলাদেশ কমো মডেলিং গ্রুপের সদস্য ড. আবু জামিল ফয়সাল ইউএনবিকে বলেন, “আমাদের পূর্বানুমান অনুযায়ী আগামী মে মাস পর্যন্ত বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতির ঊর্ধ্বগতি বজায় থাকবে। আমাদের মতে, বাংলাদেশ করোনার সর্বোচ্চ সংক্রমণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আগামী এক মাস ঊর্ধ্বগতি বজায় থাকবে এবং এর দুই সপ্তাহ পর হতে ধীরে ধীরে সংক্রমণ সংখ্যা হ্রাস পাবে।”
ড. ফয়সাল বলেন, মে মাসের আগে হঠাৎ করেই সংক্রমণের হার কমার সম্ভাবনা নেই। তবে করোনায় মৃত্যুর হার নিয়ে বলতে পারছেন না তারা। কেননা, হঠাৎ করেই মৃত্যু সংখ্যা বাড়ছে-কমছে এবং হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। তবে তিনি বলেন, “আমার ব্যক্তিগত অনুমান অনুযায়ী আগামী মে মাসের মধ্যে মৃত্যু সংখ্যা ১২,০০০ ছাড়াবে।”
আরও পড়ুন: স্বাস্থ্যবিধি না মানলে করোনা নিয়ন্ত্রণে আসবে না: মন্ত্রী
তিনি জানান, সরকারের কাছে তারা এই গবেষণার তথ্য সরবরাহ করেছেন এবং এই তথ্য বিশ্লেষণে কাজ করে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশের আট বিভাগের যৌথ গণস্বাস্থ্য পরামর্শক কমিটির সদস্য ড ফয়সাল বলেন, করোনার এই সংক্রমণ চক্র ভাঙতে কার্যকরী এবং সমন্তির পদক্ষেপ নেয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। শতভাগ মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করাসহ প্রতিদিন টেস্ট বৃদ্ধি করা, সঠিক আইসোলেশন এবং কন্টাক্ট ট্রেসিং এর প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
করোন প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক ড. মিরজাদি সেবরিনা ফ্লোরা বলেন, কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর ভাইরাস সংক্রমণের গতি নির্ভর করে। “করোনা নিয়ন্ত্রণে আমরা বর্তমানে যে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি তা যদি মেনে চলতে পারি, তবে আশা করা যায় করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হবে।”
তিনি বলেন, করোনায় মৃত্যু সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু মৃত্যুহার বৃদ্ধি পায়নি। বর্তমান দ্বিতীয় ঢেউয়ের আগে মৃত্যু হার ছিল ১.৫২ শতাংশ এবং বর্তমানে মৃত্যুহার ১.৪৩ শতাংশে নেমে এসেছে। তার মতে, সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে।
আরও পড়ুন: লকডাউনে খাদ্য ও আর্থিক সহায়তার দাবি অটোরিকশা, হালকা যানবাহনের কর্মীদের
ফ্লোরা বলেন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়া মৃত্যু সংখ্যা কমানোর আর কোনো উপায় নেই। সংক্রমণ রোধে সচেতনতা ও আরও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
করোনা পরীক্ষা বৃদ্ধি জরুরি
হেল্থ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান এবং গণস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এম এইচ চৌধুরি (লেনিন) বলেন, অনেক করোনা আক্রান্ত রোগীই শনাক্ত হচ্ছেন না। এসব রোগী নিজের আশপাশে সকলের অজান্তেই করোনা ছড়িয়ে যাচ্ছেন। এ জন্য তিনি করোনা পরীক্ষা সংখ্যা কমে যাওয়াকেই দায়ী করছেন।
তিনি বলেন, “যখন প্রতিদিন গড়ে ৩৩ হাজার করোনা পরীক্ষা হয়েছে, তখন দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা ছিল ৭ হাজার। কিন্তু এখন করোনা পরীক্ষার সংখ্যা ২৫ হাজারের নিচে চলে আসায় গড়ে শনাক্তের সংখ্যা দাড়িয়েছে ৪ হাজারে। প্রতিদিনই করোনা সংক্রমণ বেড়েই চলেছে, কিন্তু পর্যাপ্ত পরীক্ষার অভাবে আমরা তা শনাক্ত করতে পারছি না।”
ড. লেনিন মনে করেন দ্রুত শনাক্ত এবং আইসোলেশন নিশ্চিত করার মাধ্যমেই করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের উপদেষ্টা ড. মুজেহারুল হক বলেন, করোন মোকাবিলায় দ্রুত শনাক্ত ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। আইসিইউ-তে চেল যাওয়া রোগীকে বাঁচানো খুব কষ্টসাধ্য বিষয় হিসেবে দেখছেন এই বিশেষজ্ঞ।
অধিক মৃত্যুর কারণ
ড. লেনিনে মতে বর্তমানে সংক্রমণ ছড়ানো করোনার ভ্যারিয়েন্টগুলো দ্রুত পরিবর্তনশীল এবং অত্যন্ত প্রাণঘাতী। তাই গতবছরের তুলনায় এই বছর করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা বেশি বলে মনে করছেন তিনি।
তিনি বলেন, বর্তমানে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া দক্ষিণ আফ্রিকার ভাইরাস টাইপটিতে আক্রান্ত রোগীদের অবস্থা খুব দ্রুত অবনতি হয়। তাদেরকে সঠিক সময়ে অক্সিজেন সরবরাহ করা না গেলে, তাদের অবস্থা আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়।
এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের মতে, অসুস্থ হবার পরও করোনা পরীক্ষা করতে রোগীদের অবহেলাকে অধিক মৃত্যুর অন্যতম কারণ। এছাড়া অতিরিক্ত অসুস্থ না হলে রোগীরা ডাক্তারের পরামর্শও নেন না। অবশ্য ড. লেনিন জানান, গতবছরে করোনা চিকিৎসায় ব্যবহৃত অধিকাংশ ওষুধই বর্তমান করোনা ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে সুফল দিচ্ছে না।
মৃত্যু নিয়ন্ত্রণে করণীয় কী ?
করোনায় মৃত্যু নিয়ন্ত্রণে ড. লেনিন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, মাস্ক ব্যবহার করা এবং করোনা সংক্রমণের সন্দেহ হলেই টেস্ট করার পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি বলেন, “করোনা পরীক্ষার পর কেউ আক্রান্ত হিসেবে ধরা পড়লে সাথে সাথেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিৎ। এক্ষেত্রে চিকিৎসক যদি হাসপাতালে ভর্তি হবার কথা বলেন, তাহলে কোনো অবস্থাতেই বিলম্ব করা যাবে না।”
করোনায় মৃত্যু নিয়ন্ত্রণ ও সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিতের লক্ষ্যে, সরকারকে অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিতসহ প্রয়োজনে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের আহ্বান জানান এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
৩ বছর আগে