চিংড়ি শিল্পে বিপর্যয়
করোনার প্রভাবে খুলনায় চিংড়ি শিল্পে বিপর্যয়
করোনার প্রভাবে খুলনায় চিংড়ি শিল্প দেখা দিয়েছে বিপর্যয়। রপ্তানি বন্ধ থাকার কারণে ন্যায্যমূল্য থেকে চাষিরা বঞ্চিত হচ্ছে। সেই সাথে মৌসুমের শুরুতে ঘর পরিচর্যা শেষ করলেও চাহিদা অনুযায়ী পোনা ছাড়তে পারছেন না চাষিরা। ফলে গত বছরের মতো এবারও আর্থিক ক্ষতির মুখে তারা।
এছাড়া লকডাউনে চিংড়ি পোনা পরিবহন ব্যবস্থা অচল থাকায় পোনার সংকটও দেখা দিয়েছে। এ কারণেই গলদা-বাগদা পোনার দাম হুট করে কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। অনেকেই বেশি দামে পোনা কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।
খুলনা জেলা মৎস্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী, খুলনাসহ উপকূলীয় জেলাগুলোর প্রায় দুই লাখ ৭৬ হাজার হেক্টর জমিতে প্রতি বছর বাগদা ও গলদা চিংড়ির চাষ হয়। চাষের সাথে জড়িত রয়েছে প্রায় ১০ লাখ মানুষ। আর দেশের চিংড়ি ঘেরের ৮০ শতাংশই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের তিন জেলা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায়। এ সব জায়গায় দেশে মোট ৫০ থেকে ৬০ হাজার মেট্রিক টন চিংড়ি উৎপাদিত হয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে খুলনাঞ্চল হতে প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানি হয়। ২০১৬-১৭ বছরে উৎপাদন কমায় রপ্তানি কমে দাঁড়ায় ২৫ হাজার মেট্রিক টনে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চিংড়ি রপ্তানি হয়েছে ২২ হাজার মেট্রিক টন।
আরও পড়ুন: ইউরোপে কমলেও, খুলনাঞ্চলের চিংড়ির রপ্তানি বেড়েছে জাপানে
বাগরহাট মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে, বাগরহাটে ৭৯ হাজার ৭৩৬ জন চিংড়ি চাষি রয়েছেন। আর ৭১ হাজার ৮৮৬ হেক্টর জমিতে ৮১ হাজার ৩৫৮টি বাগদা ও গলদা চিংড়ির ঘের রয়েছে। এসব ঘেরে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ১৭ হাজার ৪৮৭ মেট্রিক টন বাগদা ও ১৬ হাজার ৩৩৭ মেট্রিক টন গলদা চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে।
বাগরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম রাসেল জানান, করোনার প্রভাবে রপ্তানি বন্ধ থাকায় বর্তমানে মাছের দাম অনেকটা কমে গেছে। এর ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চাষিরা। রপ্তানি বন্ধ থাকায় গত এক বছর বাগরহাটের চিংড়ি শিল্প ক্ষতির পরিমাণ ১৪০ কোটি টাকা। আর সব মিলিয়ে এই ক্ষতির পরিমাণ হবো প্রায় ২৫০ কোটি টাকা। এরই মধ্য বাজারে পোনা সংকটও দেখা দিয়েছে। বাগেরহাটে ৭৭ কোটি বাগদা ও ২১ কোটি গলদা পোনার চাহিদা রয়েছে। চাষিদের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। এর অংশ হিসেব জেলার ২৮ হাজার মৎস্য চাষিক আর্থিক প্রণোদনা দেয়ার পাশাপাশি সহজ শর্তে চাষিদের জন্য ব্যাংক থেকে ঋণের সুবিধা দেয়া হচ্ছে।
খুলনা মৎস্য পরিদর্শন ও কোয়ালিটি কন্ট্রোল অফিস সূত্র জানায়, বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া হিমায়িত চিংড়ির ৮৫ ভাগ যায় ইউরোপে, আর ১৫ ভাগ আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে। তবে এসব দেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানায় হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি এক প্রকার বন্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে আর্থিক মন্দার শিকার হয়েছে দেশের অন্যতম রপ্তানি পণ্যের এই খাত।
আরও পড়ুন: ওজন বাড়ানো ও সতেজ রাখতে চিংড়ি মাছে ক্ষতিকর জেলি!
চিংড়ি চাষের সাথে জড়িত ঘের মালিকরা জানান, এ মৌসুমে ঘেরের হার বেশি। চিংড়ি পোনার দামের ঊর্ধ্বগতি, মাছের খাবারের দাম বেশি, ঘের প্রসেসিংয়ের জন্য মালামালের দাম এবং শ্রমিকের মজুরিও বেশি। কিন্তু মাছের দাম কম। আর তার জন্যই দিশেহারা হয়ে পড়েছেন চাষিরা।
বাগরহাটের রামপাল উপজলার ফয়লাহাটে আগে প্রতিদিন কোটি টাকার গলদা-বাগদা বেচাকেনা হলেও এখন আর আগের মতো কর্মব্যস্ততা নেই । করোনার প্রভাবে পোনা পরিবহন সংকট দেখা দেয়ায় শূন্য হাঁড়ি নিয়ে বসে থাকতে দেখা গেছে এই আড়তের সাথে জড়িত শ্রমিকদের।
আড়তদার ও চিংড়ি পোনা গণনাকারি শ্রমিকরা জানান, গত ১৪ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া কঠোর লকডাউনের কারণে অনেকটা বেকার হয়ে পড়ছে এই হাটের সাতে জড়িত ব্যবসায়ী ও শ্রমিকসহ প্রায় ৪ থেকে ৫ হাজার মানুষ। এমন অবস্থা চলতে থাকলে মৌসুমের শুরুতে চাহিদা অনুযায়ী পোনা সরবরাহ করতে না পারলে চিংড়ি চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
আড়তদার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী ও কক্সবাজার থেকে বাগদা ও গলদা পোনা আসে এই হাটে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এই হাটে প্রায় কোটি টাকার গলদা-বাগদার পোনা বেচাকেনা হয়। তবে করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে হাটে। আগের মতো পোনার সরবরাহ নেই। চাষিরা চাহিদা অনুযায়ী পোনা পাচ্ছেন না। এ কারণে ৯৫ শতাংশ চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। লকডাউনের কারণে হাটে পোনা সরবরাহ কমে যাওয়ায় কারণে ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা অসহায় দিনযাপন করছেন।
হাটে চিংড়ি পোনা গণনাকারী তরিকুল ইসলাম বলেন, লেখাপড়ার পাশাপাশি ফ্যামিলিকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য আমাকে বাজার আসতে হচ্ছে। এক হাজার মাছ গুনলে আমি বিশ টাকা পাই। লকডাউনের কারণে তাও বন্ধ।
চিংড়ি পোনা গণনাকারী হাকিম শেখ বলেন, ‘পোনা-পাতি আসতিছে না, তালি আমরা কি করে বাঁচবো? বাড়ি ছেলে-মেয়ে আছে, মা আছে। আমাদের তো না খেয়ে মরার পথ।’
আরও পড়ুন: বিগত অর্থবছরে চিংড়ি রপ্তানি বেড়েছে
চিংড়ি চাষি হারুন শেখ বলেন, ‘আমি আইজ ১২-১৩ বছর ঘের করি। আমার ঘেরের পরেই সংসার চলে। এই করোনাকালীন সময়ে আইসে মাছের রেট কুমে গেইছে। আগে গলদা-বাগদা বিক্রি করিছি ১৩০০-১৪০০ টাকা। এখন সেই মাছের দাম ৬০০ থেইকে ৯০০ টাকা। আমার ১০-১২ বিঘার দু’টি ঘের আছ। আমি যা লগ্নি করছি, তার অর্ধেক টাকাও আসবে না। এখন সামনে আর ঘের করবো কি না, সেই তৌফিক থাকবে কি না, টাকা থাকবে কি না...করার মতো সেই অবস্থা আর নাই।’
চিংড়ি চাষি আতিয়ার গাজী বলেন,‘আমরা ঘের রেডি করে রাইছি। মাছ ছারতি পারতিছি না করোনার কারণে। মাছ পাওয়া যাচ্ছে না, কম কম আসে, দাম বেশি। আগে ছিল ১ হাজার ৩০০ টাকা, এহন ডবল দাম। নদীর বাগদা ছিল ৭০০ টাকা এহন ১২০০-১৪০০ টাকা- তাও পাওয়া যাচ্ছে না। রেনু (গলদা) হালকা-পাতলা পাওয়া যাচ্ছে ৩ হাজার ২০০ টাকা করে।’
বারাকপুর চিংড়ি আড়তদার সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জাকির হোসেন বলেন, করোনাকালীন সময়ে চিংড়ি শিল্পে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। ১৭০০ টাকার চিংড়ি মাছ ৮০০-৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এই চিংড়ি শিল্প থেকে প্রচুর পরিমাণ রাজস্ব আয় হয়। চিংড়ি শিল্পকে বাঁচিয় রাখতে হলে চাষিদের সরকারি সহায়তা প্রয়োজন। তা না হল এই খাতকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
ডুমুরিয়ার চাষি গাজী মেহেদী হাসান বলেন, ‘মৌসুমের শুরুতে চিংড়ি ঘেরে পোনা ছাড়া যাচ্ছে না। দাম বেশি, পোনা পাওয়া যাচ্ছে না।’
খুলনা বিভাগীয় পোনা ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও পাইকগাছা উপজেলার পুরস্কারপ্রাপ্ত ঘের ব্যবসায়ী গোলাম কিবরিয়া রিপন বলেন, চিংড়িতে করোনার প্রভাব মারাত্মক। আর আম্পানের আঘাতে সব স্বপ্নই চুরমার হয়েছে। তারপরও চাষিরা মাথা তুলে দাঁড়াতে সচেষ্ট। কিন্তু, ১০-১২ দিন হলো অজানা কারণে চিংড়ি মরতে শুরু করেছে। এখন মাছ তোলার গোনে চিংড়ি মরার কারণে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
আরও পড়ুন: খুলনাঞ্চলে হিমায়িত চিংড়ির আন্তর্জাতিক বাজার পরিধি কমছে
তিনি বলেন, পোনা স্বল্পতা রয়েছে। তারপরও হ্যাচারিতে সামান্য পোনা থাকলেও চাষিদের অনাগ্রহে তা বিক্রি হচ্ছে না। ঘেরে মাছ মরার কারণে চাষিরা নতুন করে পোনা ছাড়ছেন না।
চিংড়ি ব্যবসায়ী লিটন পরামানিক বলেন, করোনার প্রভাবে মাছ রপ্তানি বন্ধ। দেশের বাজারেও ক্রেতা নেই। তাই বেকার অবস্থায় দিন কাটছে।
খুলনার কয়রা বাগালি ইউনিয়নের বাগদা চাষি মফিজুল ইসলাম জানান, গরমের কারণে ঘের-পুকুরে চিংড়ি মরছে। গরমে ঘেরে পানি কম, বৃষ্টি নেই, পোনা ও খাবার সংকট, কর্মচারীদের বেতন সব মিলিয়ে বড় ধরনের লোকসানে তারা।
৩ বছর আগে