কালের বিবর্তন
কালের বিবর্তনে বঙ্গদেশের যে ভাষাগুলো বিলুপ্তির পথে
একটি ভাষা শুধু কতক জনগোষ্ঠীর যোগাযোগের মাধ্যম নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সংশ্লিষ্ট মানবগোষ্ঠীর শত বছরের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। একটি ভাষার মৃত্যু মানে সেই শত বর্ষের জীবনধারার ইতিহাসের পরিসমাপ্তি। সময়ের বিবর্তনে ঠিক সেই বিলুপ্তির শিকারেই পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষাগুলো। সংখ্যালঘু মানুষগুলোর নিবাস দেশের প্রত্যন্ত ও দুর্গম অঞ্চলগুলোতে হওয়ায় অগোচরেই থেকে যাচ্ছে এই ভাষা বিলুপ্তি। বিগত দশকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটের সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী বঙ্গদেশের বিলুপ্তপ্রায় ভাষার সংখ্যা মোট ১৪টি। চলুন, বিপন্নপ্রায় সেই ভাষাগুলোর ব্যাপারে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
বঙ্গদেশের যে ভাষাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে
কন্দ
১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশে আগমন ঘটেছিল কন্দ ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর। কন্দদের আদিভাষার নাম কন্দফারসি। ভারতের ওড়িশা থেকে এ দেশে কন্দদের আনা হয়েছিল মূলত রেললাইন স্থাপন ও চা বাগানের কাজে। এদের মধ্যে বর্তমানে কেউই আর সেই কন্দতে কথা বলতে পারে না। ভাবের আদান-প্রদানটা হয়ে থাকে উড়িয়া ভাষায়।
খাড়িয়া
অস্ট্রো-এশিয়াটিক গোত্রের মুণ্ডা শাখার অন্তর্গত খাড়িয়া ভাষার সর্বাধিক ব্যবহার হয় ভারতের ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়, ও ওড়িশায়। বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গলে মংরাবস্তিতে প্রায় ১০০-এরও বেশি পরিবারের মাতৃভাষা খাড়িয়া। কিন্তু এ ভাষায় স্বাচ্ছন্দ্যে কথা বলতে পারে মাত্র ২ জন। এদের একজন খাড়িয়া সমাজকর্মী হিসেবে নিজেদের মাতৃভাষা রক্ষার কাজ করছেন।
আরও পড়ুন: আসামের বাংলা ভাষা আন্দোলন নিয়ে মাসুদ করিমের তথ্যচিত্র
২০২০ সালে তিনি খাড়িয়াদের ওপর একটি সমীক্ষা করেছিলেন, যেখানে বাংলাদেশে ৪১টি খাড়িয়া গ্রামের খোঁজ পাওয়া যায়। গ্রামবাসীদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ হাজার ৭০০ জন।
কোডা
পশ্চিমবঙ্গ, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং বাঁকুড়া জেলার প্রচলিত এক ধরনের মুণ্ডা ভাষার নাম কোডা। এর আরও নাম আছে, যেমন কোরা, কাওরা, কোরালি, কোরাটি, কোরে, এবং মুদিকোরা। ভারত ও বাংলাদেশের কোরা গোষ্ঠী দ্বারা কথিত একটি বিপন্ন মুণ্ডা ভাষা। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কোডা-ভাষী গ্রামগুলো হচ্ছে রাজশাহী বিভাগের কুন্দং এবং কৃষ্ণপুর। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কোডা বাংলার সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে। দুয়েক জন প্রবীণদের মুখে কিছু কোডা শোনা গেলেও তরুণদের সবাই বাংলাতেই কথা বলেন।
মুণ্ডারি
অস্ট্রোএশিয়াটিক ভাষা বিভাগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুণ্ডা ভাষা এই মুণ্ডারি। নেপাল, পূর্ব ভারতীয় রাজ্যের ঝাড়খন্ড, ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গের মুণ্ডাদের এই কথ্য ভাষার সঙ্গে সাঁওতালি ভাষার অনেক মিল।
আরও পড়ুন: একুশে বইমেলার শিকড়ের সন্ধান
বাংলাদেশে মুণ্ডারির ব্যবহার দেখা যায় খুলনার কয়রা উপজেলার উত্তর ও দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নে, ডুমুরিয়া, এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগর, দেবহাটা ও তালা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামগুলোতে। সুন্দরবন সংলগ্ন নদী পাড়ের গ্রামগুলোর এই আদিবাসীরা এখন কদাচিৎ মুণ্ডা ব্যবহার করে। পাবনার ঈশ্বরদীর তরুণ মুণ্ডাদের অনেকেই প্রথম দিকে জানতো না যে, তাদের নিজস্ব একটি মাতৃভাষা ছিল।
কোল
একদম আলাদা মুণ্ডা ভাষা হলেও কোল এবং কোডাকে মুণ্ডারির মিশ্র ভাষা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ১৮৩১ থেকে ১৮৩২ সালে কোলরা বৃটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। সুযোগ্য নেতৃত্বের অভাব, আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতা, শিক্ষিত শ্রেণীর সমর্থনের অভাব এবং নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের অভাবে আন্দোলন ব্যর্থ হয়।
কোলদের গ্রাম সবচেয়ে বেশি রয়েছে রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার বরেন্দ্র অঞ্চলে এবং রংপুরের বাবুডাইংয়ে।
আরও পড়ুন: টাকা কীভাবে এলো? মানব সভ্যতায় টাকার ইতিহাস
সৌরা
ভারতের সীমান্ত পিলার ও ত্রিপুরা বনবাজার খেকে ২০০ গজ দূরত্বে বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গলের রাজগাট ইউনিয়নের সৌরা পল্লী। এই গ্রাম পরম যত্নে আগলে রেখেছে ২২টি সৌরা পরিবারকে। এছাড়া উত্তরবঙ্গের রংপুরেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সৌরারা। এদের বেশিরভাগই কথা বলেন ওড়িয়া, সাদরি ও স্থানীয় তথা উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক ভাষায়।
মালতো
পূর্ব ভারতের মাল্তো উপজাতির মুখে প্রচলিত উত্তর দ্রাবিড় ভাষা এই মালতো। এর ‘পাহাড়িয়া’ নামটিও বেশ প্রসিদ্ধ, তবে ‘রাজমহালি’ নামটি খুব কম শোনা যায়।
পাবনার ঈশ্বরদীর দাশুড়িয়া ইউনিয়নের মাড়মি পল্লীর অধিবাসীদের প্রথম ভাষা মালতো। এছাড়া নাটোর, রাজশাহী ও নওগা জেলায়ও রয়েছে মালতোদের বসবাস। বর্তমানে জীবিকার উদ্দেশ্যে লেখালেখির যাবতীয় কাজ বাংলায় হওয়ায়, কথা বলার সময়েও কমে গেছে মালতোর ব্যবহার।
আরও পড়ুন: বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ: কোথা থেকে এলো বাংলা ভাষা
খুমি
বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) দক্ষিণ চীন রাজ্যের ভাষা দক্ষিণ চীনের একটি উপভাষা খুমি। বার্মার পালেওয়া ও তার আশেপাশের অঞ্চল এবং বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার আদিবাসীরা এই ভাষা ব্যবহার করে। আরাকানীয় (বর্তমান রাখাইন, যা মিয়ানমারের একটি অঞ্চল) এবং বর্মী ভাষার বিস্তর প্রভাব এই ভাষার ওপর। বান্দরবানের রুমা, থানচি এবং রোয়াংছড়িতে খুমিদের বসবাস।
পাংখোয়া
ভারতের মিজোরাম রাজ্যে ব্যবহৃত কুকি ভাষার নাম পাংখোয়া, যা পাংখু, পাংখোয়া বা পাং নামেও পরিচিত। পাংখোয়ার দুইটি উপভাষা হচ্ছে বিলাইছড়ি ও কংলাক। বাংলাদেশে পার্বত্য রাঙ্গামাটির সাজেক উপত্যকা থেকে বারাবানের রুমা সংলগ্ন এলাকায় পাংখোয়া জাতির বসবাস।
২০২২ সালে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ থেকে পাহাড়ি ৭টি উপজাতীয় ভাষার স্বতন্ত্র শব্দকোষ প্রকাশ করা হয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে পাংখোয়া অন্যতম।
আরও পড়ুন: বাংলা নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস: রূপরেখায় অপশক্তির অবসান কামনায় শান্তি মিছিল
রেংমিটচ্য
খুমি এবং ম্রো ভাষার ঘনিষ্ট প্রভাব থাকলেও মায়ানমারের কুকি-চীন ভাষার শ্রেণীভুক্ত রেংমিটচ্য একটি স্বতন্ত্র ভাষা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে আলীকদমের পার্টি পাড়ায় বাস করতো শতাধিক রেমিটচ্য পরিবার। আলীকদম সদর থেকে ১০ থেকে ১২ মাইল দূরে তৈনখালের উপত্যকার ছোট্ট গ্রাম ক্রাংসিপাড়া। সেখানে রেমিটচ্যভাষীদের বসতি ছিল প্রায় ৩০০ বছর ধরে। কালের বিবর্তনে এই সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা কমতে কমতে ২০২২ সালে ৬-এ এসে দাঁড়ায়। এদের বেশিরভাগই আবার ছিলেন ষাটোর্ধ্ব। এদের মধ্যে ২ জন থাকতেন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ম্রোদের সঙ্গে।
মূলত স্থানীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ায় সংখ্যা কমছে রেংমিটচ্য ভাষাভাষীদের।
চাক
মিয়ানমারের চাক নৃ-গোষ্ঠীর কথ্য হিসেবে প্রচলিত আরও একটি চীন-তিব্বতি ভাষা চাক। শাল বিভাগভুক্ত এই ভাষাটি সাক নামেও পরিচিত। ১৩ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কাদু জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা ভাবে পরিচিতি লাভ করে চাকরা। ১৪ শতকে তাদের রাজ্য আরাকানিরা দখল করলে তারা পার্বত্য চট্রগ্রামে প্রবেশ করে। বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ের ছড়া অঞ্চলগুলোই এখন এই চাকদের নিবাস। সুরপ্রধান চাক ভাষা সাহিত্যে বেশ সমৃদ্ধ হলেও লেখায় তেমন প্রচলন না থাকায় এখন বিপন্ন হতে চলেছে।
আরও পড়ুন: পহেলা বৈশাখ: বাংলা নববর্ষের উৎপত্তি এবং ইতিহাস
খিয়াং
রাঙামাটির কাপ্তাই ও চন্দ্রঘোনা এবং বান্দরবানের থানচি ও রোয়াংছড়িতে বসবাসরত খিয়াং আদিবাসীদের কথ্য ভাষা খিয়াং। বাংলাদেশে খিয়াংরা মূলত দুটি গ্রুপে বিভক্ত- লাইতু ও কংতু। লাইতুরা থাকে সমতলে আর কুংতুরা থাকে পাহাড়ি এলাকায়। এদের বেশিরভাগই বর্তমানে বাস করে রাজকীয় মং সম্প্রদায়ের সঙ্গে। তাই কথ্য রীতিতে আর আগের সেই মৌলিকতা নেই। অবশ্য তা ফিরিয়ে আনার জন্য খুব ছোট পরিসরে হলেও তোড়জোড় শুরু হয়েছে। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের ৭টি পাহাড়ি ভাষার শব্দকোষের মধ্যে খিয়াং একটি।
লুসাই
উত্তর-পূর্ব ভারত ও মিয়ানমারের প্রসিদ্ধ একটি উপজাতীয় ভাষা লুসাই। আসামের লুসাই পাহাড় থেকেই এই ভাষার নামকরণ হয়েছে। বাংলাদেশের লুসাইভাষীরা নিজেদের মঙ্গোলীয়দের বংশধর বলে দাবী করে। রাঙ্গামাটির সদরের বাঘাইছড়ি এবং বান্দরবান সদর ও রুমায় রয়েছে লুসাইদের গ্রাম।
পাহাড়ি ভাষা সংরক্ষণের জন্য রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ কর্তৃক যে শব্দকোষগুলো প্রকাশ করা হয়েছিল, তার মধ্যে লুসাইও রয়েছে।
আরও পড়ুন: কীভাবে এল বাংলা ক্যালেন্ডার: দিনলিপি গণনার ইতিবৃত্ত
লালেং (পাত্র)
বাংলাদেশের উপভাষাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম পরিচিত পাত্র বা লালেং ভাষা। সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে গহীন জঙ্গলে এই ভাষাভাষী লোকদের বসবাস। এই ভাষার নাম মূলত লালেং ঠার বা লাইয়ুংটার। এর কোনও শব্দের সঙ্গে বাংলা অথবা অন্য ভাষার কোনও মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি।
শেষাংশ
দেশের এই ১৪টি বিলুপ্তপ্রায় ভাষা কোনোরকম বেঁচে আছে উপজাতিগুলোর গুটি কয়েক প্রবীণ সদস্যের মাঝে। এলাকায় অন্যান্য সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষার প্রভাবে নৃ-গোষ্ঠীগুলোর নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মাতৃভাষা। ফলে হুমকির মুখে রয়েছে খাড়িয়া, কোল, রেংমিটচ্য, খিয়াং, ও লুসাইয়ের মত ভাষা, যেগুলো এক সময় নিজ নিজ অঞ্চলে যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিল।
সমৃদ্ধ শব্দকোষ তৈরি পাংখোয়া, লুসাই ও খিয়াং ভাষার জন্য নিঃসন্দেহে এক যুগান্তকারী উদ্যোগ। এমন পদক্ষেপ বাকি বিপন্নপ্রায় ভাষাগুলোর ক্ষেত্রেও শিগগিরই গ্রহণ করা জরুরি। এক্ষেত্রে শুধু সরকারি মহলগুলোই নয়, এগিয়ে আসতে হবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও।
আরও পড়ুন: ‘ধারণার চেয়েও বেশি’: মধ্যযুগে বাংলায় হাবশি শাসন এবং আফ্রিকা-ভারত সংযোগ সম্পর্কে ডা. কেনেথ রবিন্স
১০ মাস আগে
মাগুরায় কালের বিবর্তনে 'ঢেঁকি' বিলীন হতে চলেছে
মাগুরা জেলার ৪ উপজেলায় কালের বিবর্তনে আধুনিকতার ছোয়ার দাপটের কাছে ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম-বাংলার এক সময়ের কৃষান-কৃষানীদের ভাল মানের চাল তৈরি করার প্রধান মাধ্যম ঐতিহ্যবাহী কাঠের ঢেঁকি।
চাল তৈরির কদর কালের বিবর্তনে আস্তে আস্তে কমে গেলেও পৌষ মাসে জামাই, মেয়ে, আত্মীয় স্বজনদের আপ্যায়নের জন্য এই এলাকায় শীতের আমেজ বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে পিঠা পুলি তৈরির মূল উপাদান চাল থেকে আটা তৈরির জন্য কাঠের ঢেঁকির কদর বেড়ে যেতো। এমন কি যার বাড়িতে ঢেঁকি থাকতো সেই বাড়িতে প্রতি কেজি ভেজানো চাল টাকার বিনিময়ে বা হতদরিদ্র পরিবার চাউলের বিনিময়ে আটা ভাঙ্গানোর জন্য দুই দিন আগেই সিরিয়াল দিয়ে রাখতেন।
এই আটা দিয়ে পিঠা তৈরিতে মা-বোনদের কোন বেগ পেতে হয় না।
“ও বউ ধান বানেরে” গ্রামীণ এই ঐতিহ্যবাহী গানটি আর তেমন শোনা যায় না। চোখে পড়ে না আর ঢেঁকিতে পাড় দিতে দিতে গ্রামীণ বউদের এই গান গাওয়ার দৃশ্য।
আরও পড়ুন: মাগুরায় হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখি, চোখে পড়ে না বাসা
কালের পরিবর্তনে মাগুরা জেলা সদর সহ ৪ উপজেলায় গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় দিন দিন ঢেঁকির কদর গ্রাম-বাংলার কৃষকদের বাড়ী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। হাতে গোনা দুই এক জন কৃষকের বাড়ীতে কাঠের তৈরি প্রাচীনতম ঢেঁকি এখনও চোখে পড়ে।
ধান, চাল, আটা ও চিড়া ভাঙ্গনোর জন্য বৈদ্যুতিক মিল হওয়ার কারণে গ্রামীণ কৃষকরা সহজেই ধান, আঁটা ও চিড়া কম সময়ে অল্প খরচে ভাঙ্গাতে পারছে। তাই বাড়ীতে ঢেঁকি রাখার প্রয়োজন মনে করছেন না অনেকেই।
আগের দিনে কৃষকদের বাড়ীর বউদের অনেক কষ্ট করে ধান ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে ভাঙ্গানোর পর চাউল ও চিড়া তৈরী হত। ধান ভাঙ্গানোর বৈদ্যুতিক মিল হওয়ায় কৃষকদের বাড়ীর বউদের আর কষ্ট করে ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে ধান ভেঙ্গে চাউল, আঁটা ও চিড়া তৈরী করাতে হয় না।
তবে বিশেষ সময়ে আটার চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে ঢেঁকির কদরও বৃদ্ধি পায়। কবি, সাহিত্যিকরা যুগে যুগে অনেক কবিতাও লিখেছেন এই ঢেঁকি নিয়ে। তাই ঢেঁকির গুণ সম্পর্কে প্রবাদ বাক্য রয়েছে যে, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও নাকি ধান বানে।
গ্রামীণ জনপদের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণে বাপ-দাদার মাটির বাড়ি ঘড়ের বদলে ডিজাইন করে ইটের বাড়ি ঘড় তৈরি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে অনেক বাড়িতেই ঢেঁকি রাখার মত জায়গা থাকছে না। তাই শত বছরের ঐতিহ্যবাহী কাঠের ঢেঁকি বিলুপ্তীর পথে। ঢেঁকি হয়ত আর কারও চোখে পরবেনা বলে আশংকা করছে এলাকাবাসী।
ধোয়াইল গ্রামের শামেলা বেগম (৭০) জানান, আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ির আমল থেকেই এই বাড়িতে ঢেঁকি ছিলো। পারিবারিক প্রয়োজনে খুব বেশি ব্যবহার না করলেও শীতের সময় আমার প্রয়োজন মত আটা তৈরি সহ প্রতিবেশিরা প্রায় প্রতিদিনই পিঠা তৈরির আটা ভাঙ্গানোর জন্য ভিড় করতো। সত্যিই এর কদর একেবারে শেষ হচ্ছে না।
বড়রিয়া গ্রামের ছকিনা বেগম (৫০) জানান, এই ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি অনেকটা স্মৃতিবসতই ধরে রেখেছি। প্রায় ১৬-১৭ বছর ধরে এই ঢেঁকিতে ধান, আঁটা ও চিড়া ভেঙ্গে আসছি।
এলাকার লোকেরা আঁটা ভেঙ্গে নেওয়ার জন্য তার কাছে আসতেন। এর বিনিময়ে তিনি প্রতি কেজি চালের আঁটার জন্য ৪-৫ টাকা নিতেন। এখন হাট বাজারে মিল হওয়ায় সবাই মিল থেকে চাল গুড়া করে আনে। যে কারনে তাদের কাছে এখন আর কেউ আসে না চাল গুড়া করতে।
৩ বছর আগে
মাগুরায় হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখি, চোখে পড়ে না বাসা
কালের বিবর্তনে মাগুরা থেকে দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে বাবুই পাখি ও তার সুদর্শন বাসা। এক সময় এসব বাসা শুধু শৈল্পিক নিদর্শনই ছিল না, মানুষের মনে চিন্তার খোরাক জোগাত এবং আত্মনির্ভশীল হতে উৎসাহ দিত। কিন্তু কালের বিবর্তনে ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে এই পাখি আমরা হারাতে বসেছি।
একসময় গ্রাম-গঞ্জের তাল, নারিকেল ও খেজুর গাছে এরা বাসা বেঁধে থাকতো। প্রকৃতি থেকে তাল আর খেজুর গাছ বিলুপ্ত হওয়ায় বাবুই পাখিও হারিয়ে যেতে বসেছে।
আরও পড়ুন: নওগাঁয় অতিথি পাখির অভয়ারণ্য এখন মহাদেবপুরের কুঞ্জবন
এক সময় মাগুরায় তিন প্রজাতির বাবুই পাখি দেখা যেত। দেশি বাবুই, দাগি বাবুই ও বাংলা বাবুই। তবে বাংলা ও দাগি বাবুই এখন বিলুপ্তির পথে। বর্তমানে কিছু দেশি বাবুই দেখা যায়, তবে বাসা তৈরির জন্য বাবুই পাখির প্রথম পছন্দ তাল গাছ। তাল গাছ প্রায় বিলুপ্তর সাথে সাথে দেশি বাবুই পাখি প্রায় বিলুপ্ত।
আরও পড়ুন: বাঁশি ব্যবহার করে অতিথি পাখি শিকার!
বাবুই পাখি নারিকেল, সুপারি ও খেজুর গাছ, খড়ের ফালি, ধানের পাতা, তালের কচিপাতা, ঝাউ ও কাশবন দিয়ে বাসা বাঁধে। বাসার গঠনও বেশ জটিল, তবে আকৃতি খুব সুন্দর। বাসা যেমন দৃষ্টিনন্দন, তেমনি মজবুত।
আরও পড়ুন: অতিথি পাখিতে মুখরিত কুমিল্লার পুকুর আর দিঘিগুলো
বাসা তৈরির শুরুতেই বাসায় দুটি নিম্নমুখী গর্ত রাখে। অর্ধেক বাসা বাঁধার পর তার সঙ্গীকে খোঁজে। স্ত্রী বাবুইটির পছন্দ হলে মাত্র ৪ দিনে বাসা বাঁধার কাজ শেষ করে। বাসার নিম্নমুখী একটি গর্ত বন্ধ করে ডিম রাখার জায়গা করে নেয়। অন্যটি খোলা রাখে প্রবেশ ও প্রস্থানের জন্য। বাসার ভেতরে-বাইরে কাদা লাগিয়ে রাখে। ফলে প্রবল ঝড়ে বা বাতাসেও টিকে থাকে বাসা। রাতে বাসা আলোকিত করার জন্য জোনাকি পোকা ধরে এনে রাখে। সাথী বানানোর জন্য কত কিছুই না করে পুরুষ বাবুই। স্ত্রী বাবুইকে নিজের প্রতি আকর্ষিত করতে খাল-বিল ও ডোবায় গোসল সেরে ফূর্তিতে নেচে বেড়ায় গাছের ডালে ডালে।
সাধারণত মে থেকে আগস্ট বাবুই পাখির প্রজনন মৌসুম। একটি পুরুষ পাখির একাধিক বাসা ও পরিবার থাকতে পারে। বাবুই পাখি দুই থেকে চারটি ডিম দেয়। স্ত্রী বাবুই ডিমে তা দেয়। দুই সপ্তাহের মধ্যে বাচ্চা ফোটে। তিন সপ্তাহ পর বাচ্চা উড়ে যায়।
এরা মূলত বীজভোজী পাখি। তাই এদের ঠোঁটের আকৃতি সহজে বীজ ভক্ষণের উপযোগী চোঙাকার। আর ঠোঁটের গোড়ার দিকটা মোটা। এরা সাধারণত খুঁটে খুঁটে বিভিন্ন ধরনের বীজ, ধান, ভাত, পোকা, ঘাস, ছোট উদ্ভিদের পাতা, ফুলের মধু-রেণু ইত্যাদি খেয়ে জীবন ধারণ করে।
মাগুরার কয়েকজন অভিজ্ঞ লোক জানান, আগে সোনালি ও সবুজ রঙের বাবুই পাখির কিচির মিচির ডাক শোনা যেত সন্ধ্যা ও সকালে। এ পাখি যেমন শিল্পী; তেমন ঘুম জাগানিয়া।বাবুই চমৎকার সুরে মানুষের ঘুম ভাঙাতো। এখন সেভাবে আর বড় তাল আর নারিকেল গাছ দেখা যায় না। বাসা বাঁধার জায়গা না থাকায় এ পাখি বংশ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়না, বংশ রক্ষার্থে পারি জমিয়েছে অন্যত্র। সরকারের কৃষি ও বন বিভাগের উদ্যোগে পরিবেশ ও পাখি সংরক্ষণের জন্য তাল, নারিকেল গাছ রোপণ করা জরুরি। এছাড়াও অবৈধভাবে এ পাখি শিকার করেন অনেকে, যা এই পাখি বিলুপ্ত হওয়ার আরেকটি প্রধান কারণ।
মাগুরার এলাকাবাসীরা জানান, ‘এখন কৃষকরা ক্ষেতে ও বীজতলায় কীটনাশক ব্যবহার করায় বাবুই পাখি মারা যায়। বংশ রক্ষার্থে তারা এলাকা ত্যাগ করতে শুরু করেছে। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় বাবুই পাখির বংশ বিস্তারে তাল, খেজুর ও নারকেল গাছ রোপণ করতে হবে। সেই সাথে কীটনাশকের অপব্যবহার রোধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।’
জেলায় ব্যাপকভাবে তালবীজ রেপন করতে হবে। এসকল বীজ যখন তাল গাছে পরিনত হবে। তখন বাবুই পাখি আবাসস্থল তৈরির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এছাড়া সমাজের সকলের উচিত জমির চারপাশে বা বাড়ির আঙ্গিনায় বেশি করে খেজুর ও নারিকেল গাছ রোপণ করা। গাছগুলো রোপণ করলে একদিকে যেমন আর্থিক সহায়তা হবে অন্যদিকে শরীরের পুষ্টি চাহিদা যোগাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকবে।
৩ বছর আগে