বজ্রপাত থেকে বাঁচাতে সতর্ক হোন
বজ্রপাত থেকে বাঁচার জন্য সতর্ক হোন
বজ্রপাত থেকে বাঁচার জন্য পরিবেশ বাঁচাতে হবে। নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে বৈশ্বিক উষ্ণতাকে। অন্যথায় বজ্রপাতের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় দেড়শতাধিক মানুষ প্রাণ হারায় বজ্রপাতে। এ বছরেও বেড়ে চলেছে হতাহত ও মৃত্যুর সংখ্যা। চলতি জুন মাসে সিরাজগঞ্জ, চট্টগ্রাম, পটুয়াখালী, মানিকগঞ্জ, ফেনী, মাদারীপুর, নোয়াখালী, মুন্সিগঞ্জ ও শরীয়তপুরে সব মিলিয়ে বেশ কিছু মানুষ বজ্রপাতে মারা গেছেন। শুধু তাই নয়, পরিবেশের উপরেও পড়ছে বজ্রপাতের ক্ষতিকর প্রভাব।
এমতাবস্থায় বজ্রপাতের মত আকস্মিক দুর্যোগ থেকে বাঁচতে প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বনের জন্য চলুন জেনে নেই বজ্রপাতের ব্যাপারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
সম্প্রতি বাংলাদেশে বজ্রপাত বৃদ্ধির কারণ
সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম বজ্রপাতের অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার পেছনে মূলত বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও লম্বা গাছের সংখ্যা কমে যাওয়াকেই দায়ী করেছে।প্রতি ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বজ্রপাত বাড়ে ১০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি। সম্প্রতি ঘন কালো মেঘের ওপরের ও নিচের অংশ দুটি পুল হিসেবে ভেসে বেড়াচ্ছে। ফলশ্রুতিতে তাদের মধ্যে বিদ্যুৎ প্রবাহের মাত্রা বেড়ে সৃষ্টি হচ্ছে বজ্রপাত। সম্প্রতি কালো মেঘের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ায় ফলে বৃষ্টিপাতের সাথে পাল্লা দিয়ে বজ্রপাতের পরিমাণ বেড়েছে।
আরও পড়ুন: কিশোরগঞ্জে বজ্রপাতে কৃষক নিহত
ঝড়বৃষ্টির সময় বজ্রপাতের প্রভাব
মানুষের উপর প্রভাব
বজ্রপাত থেকে উৎপন্ন হয় প্রায় ১০ হাজার অ্যাম্পিয়ার বিদ্যুৎ যা থেকে মিলি সেকেন্ডের মধ্যে ৫০ হাজার কেলভিন তাপশক্তি ছড়িয়ে পড়ে। সেজন্যই যদি সরাসরি কোন মানুষের উপর বাজ পড়লে এর আকস্মিকতা বুঝে ওঠার আগেই তার শরীর অঙ্গার হয়ে যায়। অন্য ক্ষেত্রে বাজ পড়ার পরে হার্ট অ্যাটাক হওয়াটা স্বাভাবিক।
রুটগার্স নিউ জার্সি মেডিকেলের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক অধ্যাপক লুইস নেলসনের মতে, বাজের ফলে সাধারণত তাৎক্ষণিকভাবে হৃদযন্ত্রের এক স্পন্দন বন্ধ হয়ে পরে দ্বিতীয়বারে বা দুই স্পন্দন পরে শুরু হয়।
আমেরিকার গণস্বাস্থ্য সংস্থা সিডিসির তথ্যানুসারে, বজ্রপাতে আক্রান্ত লোক শরীর জ্বালা-পোড়া, শক এবং ট্রমায় ভোগে। কারো কারো মধ্যে দুর্বলতা, বিভ্রান্তি, ত্বক নষ্ট এমনকি স্ট্রোক পর্যন্ত হতে পারে।
আপনি হয়ত ইতোমধ্যে জেনে থাকবেন যে, বজ্রপাতপৃষ্ঠ হয়েও অনেকে বেঁচে যায়। কিন্তু এরা কেউই স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারে না। বজ্রপাতের বিদ্যুৎ মস্তিষ্কে প্রবেশ করলে এর তাপ ও স্পার্ক মস্তিষ্কের কোষগুলিকে পুড়িয়ে অকেজো করে দেয়। বেঁচে যাওয়া মানুষদের ক্ষেত্রে তাই ট্রমা, মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত, ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন প্রভৃতি পরিলক্ষিত হয়।
পরিবেশ বিনষ্টসহ অন্যান্য ক্ষতি
দাবানল
বাজ সরাসরি গাছের উপর পড়ে গাছে আগুন ধরিয়ে দেয়। এভাবে তাপ ছড়ানোর ফলে দাবানলের সৃষ্টি হয়। বিমান ও অন্যান্য পরিবহনের ক্ষতিবিমানবন্দর, বিমান ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র, যোগাযোগের টাওয়ার এবং নেভিগেশন বীকনগুলি বজ্রপাতের সময় অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে থাকে। বজ্রপাতের ফলে বিমানের ক্রমবর্ধমান বিলম্ব, বাতিলকরণ ও রুটের পরিবর্তন প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
বজ্রপাত সময়কালীন বাঁচার উপায়
১) ঝড়বৃষ্টির ও বজ্রপাতের সময় এপ্রিল-জুন মাস। সাধারণত ৩০-৪৫ মিনিট পর্যন্ত বজ্রপাত স্থায়ী হয়। এ সময়টুকু ঘরে থাকাটাই সমীচীন।২) এ সময় ঘন কালো মেঘ দেখলেই ঘরের বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকুন। জরুরি প্রয়োজনে রবারের জুতা পড়ে বেরতে পারেন। ৩) মুক্ত আকাশের নিচে ধানখেত বা খোলা মাঠে থাকলে দ্রুত পায়ের আঙ্গুলের ওপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙ্গুল দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকুন। ৪) যত দ্রুত সম্ভব দালান-কোঠা বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে গিয়ে আশ্রয় নিন। টিনের চালা ঘর অবশ্যই এড়িয়ে চলবেন।৫) গাড়ির ভেতর অবস্থান করলে গাড়ির ধাতব অংশ থেকে যথাসম্ভব শরীরকে বাঁচিয়ে রাখুন। গাড়িটি নিয়ে দ্রুত কোন কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিন। ৬) মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, টিভি, ফ্রিজসহ সকল ধরনের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। বজ্রপাতের আভাস পেলে আগে থেকেই এগুলোর প্লাগ খুলে রাখুন।৭) ধাতব হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। এ ক্ষেত্রে প্লাস্টিক বা কাঠের হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করতে পারেন।
৮) এ সময় সমুদ্র বা নদীতে থাকলে মাছ ধরা বন্ধ রেখে নৌকার ছাউনির নিচে অবস্থান করুন।৯) বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির ধাতব রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করবেন না।১০) বিস্তৃত জায়গায় একসাথে কয়েকজন থাকলে প্রত্যেকে ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে দূরে সরে যান।১১) বাড়িতে যদি পর্যাপ্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে সবাই এক কক্ষে ভিড় না করে আলাদা আলাদা রুমে চলে যান।
আরও পড়ুন: রাজশাহীতে আম কুড়াতে গিয়ে ...
যে স্থানগুলো বজ্রপাতের জন্য বিপজ্জনক
১) বজ্রপাতের সময় খোলা যেমন ধানখেত, মাঠ-ঘাট, নদী ও উঁচু জায়গা সব থেকে বিপজ্জনক। বিস্তৃত ফাঁকা জায়গায় যাত্রী ছাউনি বা বড় গাছে বজ্রপাত হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি।২) উঁচু গাছপালা বা বিদ্যুতের খুঁটিতে বাজ পড়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে তাই এ সময় গাছ বা খুঁটির কাছাকাছি থাকা নিরাপদ নয়।৩) বাড়িতে থাকলে জানালার কাছে থাকা যাবে না। ৪) রাস্তায় থাকলে অবশ্যই জমে থাকা পানি এবং বিদ্যুতের ছেঁড়া তার এড়িয়ে চলুন।
বজ্রপাতে কেউ আহত হলে কি করণীয়
সাথে সাথেই আহত ব্যক্তিতে খালি হাতে স্পর্শ করতে যাবেন না। অন্যথায় আপনিও শক পেতে পারেন। প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে সিপিআর দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবেন। হাত-পা অনবরত মালিশ করবেন। যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যাবেন। মনে রাখবেন, বজ্রপাত ও বৈদ্যুতিক শকে আহত ব্যক্তির একই চিকিৎসা।
বজ্রপাত থেকে বাঁচার সর্বোত্তম উপায়
বজ্রপাত যেহেতু একটি আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাই আগে থেকেই এর জন্য প্রস্তুত থাকার কোনো বিকল্প নেই।
১) অপেক্ষাকৃত বেশি দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোকে চিহ্নিত করে আগেই সেখানে জনসচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করুন। যেহেতু প্রত্যন্ত অঞ্চলে মৃত্যুর হার বেশি, তাই কৃষক, জেলেসহ যারা খোলা স্থানে কাজ করে তাদেরকে বজ্রপাতের ব্যাপারে সঠিক জ্ঞান দিয়ে সতর্ক করুন। এই খেটে খাওয়া মানুষগুলো নিত্যদিনের খাবারের জন্য যেহেতু প্রতিদিনের কাজের উপর নির্ভরশীল, তাই সরকারিভাবে এদের জন্য বিশেষ প্রণোদোনার ব্যবস্থা করা উচিত।২) সবচেয়ে মোক্ষম উপায় হলো যথেষ্ঠ পরিমাণে গাছ লাগানো যেগুলো দ্রুত লম্বা হয়ে বেড়ে ওঠে। এক্ষেত্রে বেশি বেশি তাল ও নারকেল গাছ লাগাতে পারেন। এভাবে বনায়নের ফলে আবহাওয়ায় ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।৩) শহরে প্রতিটি বিল্ডিংয়ে বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপন নিশ্চিত করুন।৪) সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও সুউচ্চ টাওয়ার নির্মাণ করা প্রয়োজন। এতে বজ্রপাত টাওয়ারের উপর দিয়ে প্রবাহিত হবে। লোকালয় বেঁচে যাবে।
বজ্রপাত পরবর্তী পদক্ষেপ
যেহেতু দেশের মধ্যাঞ্চল বজ্রপাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাই সে সব অঞ্চলের লোকদের ক্ষতির পরিমাণই বেশি। তাই সরকারি ও বেসরকারি সবমহল থেকেই তাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসা উচিত। আহতরা যেন উপযুক্ত চিকিৎসা এবং নিহতদের পরিবার যেন নিজেদের জীবন চালানোর জন্য অর্থ ও কাজ পায় সেদিকে খেয়াল রাখুন।শহরে ভাঙা গাছ ও খুঁটি উপরে ফেলে সেখানে গাছ লাগান। ছেঁড়া তার ও জমে থাকা পানি পরিষ্কারের সময় সাবধানতা অবলম্বন করুন। ভাঙা কাঁচ, দালানের কোন অংশ ভেঙে পড়ে থাকলে সেগুলো সাবধানে পরিষ্কার করুন। সাহায্যকারী কোন সংস্থার আশায় বসে না থেকে নিজেরা উদ্যমী হয়ে এক সাথে একে অপরের উপকারে নেমে পড়ুন
শেষাংশ
সর্বপরি বজ্রপাত থেকে বাঁচার জন্য উচিত মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা, যেহেতু এই অবস্থায় তাৎক্ষণিকভাবে মানুষের কিছুই করার থাকে না। এই দুর্যোগের পেছনে মানুষের হাত নেই বললে মিথ্যে বলা হবে। কারণ বিশ্ব জুড়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি আর গাছপালার সংখ্যা কমে যাওয়া এগুলো সব আমাদেরই কাজ। কিন্তু এ অবস্থার উন্নতি অসম্ভব কিছু নয়। এর জন্য প্রয়োজন আমার আপনার সদিচ্ছা এবং প্রত্যেককে প্রত্যেকের জায়গা থেকে এগিয়ে আসা।
আরও পড়ুন: ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বজ্রপাতে ...
৩ বছর আগে