নৌকা বেচাকেনার ধুম
চাঁদপুরে নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত মিস্ত্রিরা, বেচাকেনার ধুম
পদ্মা, মেঘনা, ডাকাতিয়া ও ধনাগোদা নদী বিধৌত চাঁদপুর জেলা। বর্ষা মৌসুমে নদী তীরবর্তী এলাকা ও চরাঞ্চলের মানুষের চলাচলের সহজ ও একমাত্র বাহন নৌকা। এ বছরও বর্ষার শুরু থেকে নৌকা তৈরি শুরু হয়েছে মতলব উত্তর ও মতলব দক্ষিণে।
মতলব দক্ষিণের প্রবীণ সমাজসেবী মাকসুদুল হক বাবলু জানান, বর্ষাকালে নৌকা তৈরি এ এলাকার কাঠ মিস্ত্রিদের পুরনো পেশা। এটা গত ৫০-৬০ বছর ধরেই চলছে। অন্য কোন উপজেলায় এতো নৌকার মিস্ত্রি আছে কিনা জানা নেই।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মতলব উত্তর উপজেলার ছটাকি, গালিমখাঁ বাংলাবাজার ও মতলব দক্ষিণ উপজেলার বরদিয়া, আড়ংবাজার, মুন্সীরহাট ও নাগদা এলাকায় নৌকা তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন মিস্ত্রিরা।
কাঠ মিস্ত্রিরা জানান, মতলব উত্তর উপজেলার ছটাকি বাজারে ১০-১২ দোকান, গালিমখাঁ বাংলাবাজারে ১২টি দোকান রয়েছে নৌকা তৈরির। নিজ এলাকার চাহিদা মিটিয়ে পার্শ্ববর্তী মুন্সীগঞ্জ, দাউদকান্দি ও কুমিল্লা জেলায় তাদের তৈরি নৌকা বিক্রি হয়।
আরও পড়ুন: নৌকা গ্রাম: শরীয়তপুরের ৩০ পরিবারের জীবিকা চলে নৌকা তৈরি করে
ছটাকি বাজারের নৌকা তৈরির মিস্ত্রি মোহাম্মদ হোসেন জানান, তিনি দীর্ঘ ১০ বছর বর্ষা মৌসুমে নৌকা তৈরি করে বিক্রি করেন।
তিনি জানান, যেসব এলাকায় সড়কগুলো ভালো এবং উপজেলা সড়কের সাথে যোগযোগ রয়েছে তাদের চলাচলে সমস্যা হয় না। কিন্তু নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষগুলোর বর্ষায় চলাচলের একমাত্র বাহন নৌকা। এ সময় গ্রামগুলোর চারপাশে পানি থৈ-থৈ করে। তাই এক মাস আগে থেকেই নৌকা তৈরির কাজ শুরু করা হয়। বেশ বিক্রিও হয়েছে ।
একই এলাকার মিস্ত্রি বাবুল হোসেন বলেন, আমরা যেসব নৌকা তৈরি করি স্থানীয়ভাবে এগুলোকে কোষা নৌকাও বলা হয়। এসব কোষা নৌকা তৈরি করতে দুজন মিস্ত্রির দুদিন সময় লাগে। ব্যবহার হয় কড়ই ও চাম্বল কাঠ। মজুরি, কাঠসহ ব্যয় হয় সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা। বিক্রি করেন ৫ থেকে সাড়ে ৬ হাজার টাকা। আবার অনেক সময় সাইজে ছোট হলে দামও কম হয়। আমরা গত বছর ৫০টিরও বেশি নৌকা বিক্রি করেছি। এবারও এমনই বিক্রির আশা করছেন তিনি । এখনও নৌকা তৈরি করে রেখেছি, কয়েক দিনের মধ্যে এসব বিক্রি শেষ হবে।
মতলব দক্ষিনে মতলব পৌর এলাকার ৮নং ওয়ার্ডের বড়দিয়া, আড়ংবাজার, মোবারকদি ও মুন্সীরহাট ও এর আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নৌকা তৈরির প্রায় ১৫টি কারখানা ও ছোট ছোট দোকান রয়েছে। মিস্ত্রিরা নৌকা তৈরির কাজে ব্যস্ত। অনেকেই নৌকা তৈরি করে পানিতে রেখেছেন। আবার কেউ কেউ কারখানা ও ডাঙায় রেখেছেন। আর এসব নৌকা ৫ হাজার থেকে শুরু করে সাড়ে ৭ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দৈনিক ৩-৪ টি বিক্রি হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, উপজেলার ধনাগোদা নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলিতে অফিস, পারিবারিক অন্যান্য কাজে ও স্কুলগামী ছাত্র-ছাত্রীরা নৌকার মাধ্যমে যাতায়াত করে থাকে। বর্ষার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এলাকার মৌসুমি জেলেরা নৌকা দিয়ে রাত দিন মাছ শিকারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। উপজেলার নিচু এলাকার বাসিন্দারা নৌকার মাধ্যমে খেয়া পাড় হয়ে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম ও হাটবাজারে যায়। অনেকে শাপলা তোলে ও বাজারে বিক্রি করে।
ধনাগোদা নদী তীরবর্তী উপরোল্লেখিত বিভিন্ন বাজারগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত কাঠ মিস্ত্রিরা। কেউ করাত দিয়ে কাঠ কাটায় ব্যস্ত কেউ হাতুড়ি দিয়ে নৌকায় পেরেক বা গজাল লাগাতে, কেউ নৌকাতে আলকাতরা লাগাচ্ছে ও কাউকে আবার তৈরি নৌকা বিক্রি করতেও দেখা গেছে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকার দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিদিন ক্রেতারা তাদের পছন্দসই নৌকা এখান থেকে কিনে নিচ্ছে।
মোবারকদি গ্রামের জনৈক নৌকা ক্রেতা ফজর আলী জানান, মহামারি করোনার মধ্য দিয়েও কাঠমিস্ত্রিরা নৌকা তৈরি ও বিক্রিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। একেকটি ছোট নৌকা ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকায় বিক্রি করছেন। কেউ নিচ্ছে বিলে জাল বাঁধতে, কেউ নিচ্ছে গৃহপালিত পশুর খাদ্য বহন ও সংগ্রহের জন্য আবার কেউ কেউ নিচ্ছে নদীর তীরবর্তী এলাকা থেকে উচু স্থানে পারাপারের জন্য ও কেউ নিচ্ছেন মাছ ধরতে।
আরও পড়ুন: প্রধানমন্ত্রীকে ব্যতিক্রমধর্মী নৌকায় চড়াতে চান লক্ষ্মীপুরের ইউছুফ
মতলব দক্ষিণের মোবারকদি গ্রামের নৌকা তৈরির মিস্ত্রি মো. সুরুজ, আইয়ুব আলী জানান, বর্ষার পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেজন্যে যাতায়াতের জন্য নৌকা তৈরি করছি। পুঁজি খাটিয়ে কড়ই ও আম কাঠ কিনে নৌকা তৈরি করছি লাভের আশায়। তবে করোনার কারণে বিক্রির ক্ষেত্রে অন্যান্য বছরের চাইতে এবার নৌকার চাহিদা কম। সারা বছর করোনারভাইরাসের কারণে অনেকের হাতেই অর্থ নেই। যেই কারণে নৌকা বিক্রিও কম হচ্ছে। প্রতি বছর বর্ষাকালে এ সময় নৌকা বিক্রি করেই সংসার চলে ।৩৫-৪০টি নৌকা তৈরি করে বিক্রি করা হয়েছে বলে জানান তারা। আরও কয়েকটি তৈরি হচ্ছে। আশা করছি সেগুলিও বিক্রি হবে।
৩ বছর আগে