তালিবান
নয়া তালেবান, পুরান তালেবান: তফাৎ কী?
তালেবান ক্ষমতা হারায় বিশ বছর আগে, তারপর কখনও এখানে, কখনও ওখানে। পরিকল্পনা করেছে, অ্যাকশনে গিয়েছে, কিন্তু ক্ষমতা পায়নি। শেষে মার্কিনিরা যখন দেখলো যে ক্ষমতা তারা ধরে রাখতে পারবে না, তালেবানের সাথে আলাপে নামলো। হঠাৎ করে তালেবানেরা সবল হলো, নাকি মার্কিনিরা দূর্বল হচ্ছিল দীর্ঘ দিন ধরে?
তালেবানের পিছনে দুই বড় শক্তি কাজ করেছে গত ৭ বছর ধরে আমেরিকাকে হটাতে এবং নিজেদের দেশে জঙ্গিবাদ মোকাবেলা করতে। সে কারণেই তালেবান টিকে থাকতে পেরেছিল।
আর মার্কিনিদের মাথায় তালেবান নয়, চীনাদের ভূত চেপেছে। সকল শক্তি নিয়োজিত করছে চীনকে ঠেকাতে। তাই প্রস্থান। সংঘাত সাউথ সি ও তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে।
তালেবান পাঞ্জশির প্রদেশ নিজেরা দখল করতে না পারায় এটাই প্রমাণ হয় যে তাদের শক্তি বৃদ্ধি পায়নি।
২
পাঞ্জশির পুরোটাই CIA-এর পালক সন্তান। সেটা মাসুদ বা Northern Alliance ই হোক। কিন্তু তারা প্রতিরোধ গড়তে পারেনি, কারণ পাশের ইরান বা তাজিকিস্তানের সাথে সামরিক যোগাযোগ আগেই বন্ধ করা ছিল।
অতএব রসদহীন ভাবে যুদ্ধ চালাতে তারা অক্ষম। তাছাড়া যুদ্ধটা করেছে পাকিস্তান, অতএব তালেবানের কৃতিত্ব এটা নয়। আর পাকিস্তান কার কথা শোনে? চীন। তালেবান এমন কোনও বড় শক্তি আগেও ছিল না, এখনও নেই।
৩
দেশের ভেতর তালেবানরা বলেছে, তারা নারী অধিকার, গণমাধ্যমের অধিকার, এইসব দেবে। তারা জানে, এইগুলো না বললে অন্য দেশ তাদের স্বীকৃতি দেবে না।
তালেবানরা পুশতুন নিয়মে চলে। তার বাইরে যেটা, সেটা তারা করবে না। ২০ বছর আগে যেটা লোকে বলতো ইসলামী মৌলবাদ, সেটা ছিল ‘পুশতুনিয়া’ মৌলবাদ। এটা থেকে সরে আসলে তালেবানদের ভেতরে দ্বন্দ্ব দেখা দেবে। অতএব, মুখে যতই বলুক, একটা সীমানার পর তারা পুরান তালেবানই থাকবে।
নারীদের পরিসর শতভাগ বন্ধ হবে না, তবে বেশির ভাগ বন্ধ থাকার আলামত চারদিকে। কিন্তু ২০ বছরে পৃথিবী পাল্টেছে। আমেরিকা যা বলে, তা সবাই আর শোনে না। এটাই তালেবানদের জন্য বড় সংবাদ। কিন্তু তাদের নিজেদের কী হবে?
আরও পড়ুন: ‘আফগানিস্তান’ কোনো একক রাষ্ট্র নয়
৪
তালেবানরা দেশের ভেতরে যাই করুক, বাইরে তা করতে পারবে না। জঙ্গিবাদ পোষণ করতে বড় বাঁধা তাদের দুই হুজুর- চীন ও রাশিয়া, বিশেষ করে চীন। তাদের খেপিয়ে টিকে থাকার ক্ষমতা তালেবানের নেই।
জঙ্গিবাদ পোষণ করবো না বলেই তারা চীন ও রাশিয়ার কাছ থেকে সমর্থন আদায় করেছে। জঙ্গিবাদ লালন বন্ধ করতে হবে, আর না করলে তাতে নতুন বিপদ।
দেশ চালানোর সমস্যা অনেক। যেমন সাহায্য না পেলে, দারিদ্র্য ভয়ানকভাবে বাড়বে, ফলে নতুন শত্রু তৈরি হবে। তালেবানের দূর্বলতা মানে পাকিস্তানের শক্তি বৃদ্ধি, যেটা তালেবান চায় না। আর চীন চায় ব্যবসা, যেটা তালেবানও চায়।
এই প্রয়োজনের কারণেই তালেবান কথা শুনবে। জটিল রাষ্ট্র সামলাবার ক্ষমতা তাদের নেই। ক্ষমতায় টিকতে হলে কথা শুনে চলতে হবে।
আরও পড়ুন: তালেবান মাস্ক না পরলে কি কিছু এসে যায়
৫
সেই তালেবান ছিল পুশতুন মৌলবাদী, এই তালেবান তাই। যেটা তারা শিখেছে সেটা হলো, যে করেই হোক ক্ষমতায় টিকতে হবে। কিছু নিলে, কিছু দিতে হবে।
আজকের আফগনিস্তান, ২০ বছর আগের মতো নয়। মানুষগুলো অনেক পাল্টে গেছে, দেশের অনেক শত্রু। কয়েক বিলিয়ন ডলার মার্কিন ব্যাংকে আটকা, তা না পেলে অনেক কিছুই হবে না।
চীনের সাথে তালেবানের রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল না আগে। তাই চীন কত কঠোর হতে পারে তালেবান তা জানে না। তাই বেসামাল কিছু করলে, এই অনেকটা দূর্বল গোষ্ঠী বিপদে পড়বে। তবে কতটা গেলে সেটা হতে পারে, এখনও কেউ তা বলতে পারে না।
হুম হ্যাম যতই করুক, তালেবান শান্তিতে নেই।
লেখক: এডিটর এট লার্জ, ইউএনবি
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
আরও পড়ুন: মুক্তি পেয়ে কী বার্তা দিলেন পরীমণি
বিষয়টা পরীমণি, না অন্য কিছু ?
৩ বছর আগে
আমার আফগান স্টুডেন্টরা ও ১৯৭১ : ব্যক্তিগত অনুভূতি
আমি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির একটি শাখায় ‘গবেষণা পদ্ধতি’র ওপর ক্লাস নিই। এতে বিভিন্ন দেশের স্টুডেন্ট আছে। তার মধ্যে আছে আফগানীরা। এক মাস ধরে মার্কিনিদের চলে যাওয়া নিয়ে চারদিকে অনিশ্চিয়তা বিরাজ করছিল। আমার স্টুডেন্টরা মিড্ টার্ম পরীক্ষা দিয়েছে সবাই, রেজাল্ট ভালো। কিন্তু আমার মনে ছিল বড় রকম দুশ্চিন্তা। ওদের কি হবে ? যুদ্ধ ঘরে আসলে ওরা কি করবে?
যা ঘটলো তালিবানদের হাতে
তালিবানরা দ্রুতভাবে এগুতে লাগলো দেখে সবাই অবাক। মার্কিনিরা নাকি ভেবেছিল ছয় মাস লাগবে ওদের কাবুল পৌঁছাতে। কিন্তু ওরা লাগালো মাত্র ১৫ দিন। মার্কিনিরা যে কত বাস্তব জ্ঞানহীন এটা তারই পরিচয়। যেখানেই যায় এটা ঘটে। ভিয়েতনাম ছেড়েছে এই ভাবে, আফগানিস্তানও ছাড়লো একই ভাবে নিজেদের মানুষদের পুরা বিপদের মধ্যে ফেলে।
একটি অন্তর্বতীকালীন সরকার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই খেলা শেষ। প্রেসিডেন্ট গনি প্লেনে চড়ে পালিয়ে গেলো আর তালেবান কাবুল দখল করে ফেললো।
তোমাদের খবর কি ?
যে আমার ক্লাস সহায়ক এবং স্টুডেন্টদের সাথে যোগাযোগ রাখে তাকে বলেছি। সে আফগান স্টুডেন্টদের কয়েকটা মেসেজ পাঠানোর পর উত্তর আসলো। ‘আমরা ভালো আছি। কি হচ্ছে, কি হবে জানি না। চারদিকে অনিশ্চয়তা। তালিবানরা একের পর এক শহর দখল করছে। কাবুলের অনেক কাছে তারা। সবাইকে শুভেচ্ছা।’
এই কথায় নিশ্চিত হওয়ার মতো কিছু ছিল না। মেয়েটা আমাকেই আস্বস্ত করতে চাইছে মনে হলো। আমার ক্লাস সহায়ক একটা পোস্ট দিলো ফেসবুকে। লিখেছে, ‘কত দূরের যুদ্ধ, কত সহজে কাছে এসে যায়। আমার সহপাঠীদের জন্য খুব উদ্বিগ্ন। এখন সারাদিন সোশ্যাল মিডিয়া দেখি, কোনো খবর আছে কিনা।’
যেদিন তালিবানরা কাবুল দখল করলো সেদিন আর একজনের মেসেজে এলো। লিখছে , ‘কি হবে জানি না। অনেকে পালাতে শুরু করেছে। পাশের দেশে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করছে অনেকে। আমার পরিবার নিয়ে আমি বেশি চিন্তিত। কারণ আমরা সংখ্যালঘু। আমাদের কি হবে কে জানে! চারদিকে কি ঘটছে জানি না, বুঝি না।’
যুদ্ধের না বলা খবরগুলো হারিয়ে যায়
সেই দোমড়ানো মনটা নিয়ে আছি। কারণ আমি জানিনা ওদের কি অবস্থা। ওরা কষ্ট করে এই দেশে পড়তে এসেছিল, তারপর করোনার কারণে ফেরত যেতে হয়। আর এখন জীবনটাই বন্ধ। আমার মতো মানুষের জন্য আরও বেশি কষ্টের কারণ ওরা আমার শিক্ষার্থী, শিক্ষকের কাছে আপন সন্তানের মতো। আমি বুকের ভেতরে কষ্টটা টের পাই সারাক্ষণ। অথচ এতো অসহায় লাগে নিজেকে। কিছুই করতে পারবো না, পারছি না।
১৯৭১ সালের একটা ঘটনা। ১৪ ডিসেম্বর আল- বদর এসে স্বামীকে তুলে নিয়ে যায়। যাওয়ার আগে ছেলেটাকে কোলে নিয়ে আদর করে তাদের ছেড়ে তিনি চলে যান। কেন নিচ্ছে কেউ বোঝেনি, এখনো জানে না। ১৬ তারিখে সবাই আনন্দ করে। তখন পরিবারের লোকজন জানে না তার কি হাল। ভেবেছে যুদ্ধে জিতেছে, নিশ্চয় ফিরে আসবে। লাশ আর কোনোদিন পাওয়া যায়নি।
যুদ্ধের বিজয় আছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের কষ্টের কথা কেউ বলে না।
লেখক: এডিটর এট লার্জ, ইউএনবি
৩ বছর আগে