মাসুকুর রহমান
ই-অরেঞ্জের অস্বাভাবিক লেনদেনের প্রমাণ পেয়েছে বিএফআইইউ
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিষ্ঠানটির মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমান এবং ভাই পুলিশ পরিদর্শক (বরখাস্ত) শেখ সোহেল রানার অস্বাভাবিক লেনদেনের প্রমাণ পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
পাশাপাশি সোনিয়া মেহজাবিন, তার স্বামী মাসুকুর রহমান, ভাই শেখ সোহেল রানা ও চাচা মোহাম্মদ জায়েদুল ফিরোজ কর্তৃক নগদে উত্তোলন ও ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর এবং নিজ নামে স্থায়ী সম্পদ ক্রয় করার জন্য মোট ১৮ দশমিক ৫৬ কোটি টাকা ই-অরেঞ্জ এর হিসাব থেকে স্থানান্তর/উত্তোলন করেন।
গ্রাহকদের অগ্রীম মূল্য পরিশোধিত অর্ডারের কাঙ্ক্ষিত পণ্য সরবরাহ না করে সন্দেহভাজনরা উল্লিখিত অর্থ তাদের ব্যক্তিগত হিসাবে স্থানান্তর, নগদে উত্তোলন ও ব্যক্তিগত স্থায়ী সম্পদ ক্রয় করেছেন মর্মে পরিলক্ষিত হয়েছে যা প্রতারণার শামিল।
বুধবার (২ নভেম্বর) বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছে বিএফআইইউ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,প্রাথমিক পর্যায়ে ই-অরেঞ্জ.শপ ও অরেঞ্জ বাংলাদেশ এর মালিকানায় সোনিয়া মেহজাবিন থাকলেও পরে তা পরিবর্তন করে পুলিশ কর্মকর্তা (বরখাস্ত) শেখ সোহেল রানার (সোনিয়া মেহজাবিনের ভাই) স্ত্রী নাজনীন নাহার বিথির নামে হস্তান্তর করা হয়।
সন্দেহভাজন প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে অল্প সময়ের ব্যবধানে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মোট ১৩টি হিসাব খুলে লেনদেন পরিচালনা করা হয়েছে।
১৩টি হিসাবের মাধ্যমে জানু ২০১৯ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২১ পর্যন্ত সময়ে ১ হাজার ১১১.৪৫ কোটি টাকা জমা ও ১ হাজার ১০৯.৯৭ কোটি টাকা উত্তোলনের মাধ্যমে মোট ২ হাজার ২২১.৪২ কোটি টাকার লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে।
হিসাবগুলোতে জানুয়ারি ২০২০ থেকে জুলাই ২০২১ পর্যন্ত সময়ে অধিকাংশ লেনদেন হয়েছে।
এছাড়া সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মো. মাসুকুর রহমানের নামে সর্বমোট ২৪টি হিসাব পরিচালনা করে লেনদেন সম্পন্ন করা হয়েছে মর্মে পরিলক্ষিত হয়েছে। ওই ২৪টি হিসাবের মাধ্যমে সময়ে সময়ে সন্দেহভাজন দুই ব্যক্তি প্রায় ১২০ কোটি টাকার লেনদেন সম্পন্ন করেছেন।
হিসাব খোলার ফরমের তথ্য অনুযায়ী ই-অরেঞ্জ শপ ও অরেঞ্জ বাংলাদেশ এর ব্যাংক হিসাবের নমিনি ও হিসাব খোলার আবেদনে হিসাবটির পরিচয়দানকারী ছিলেন মোহাম্মদ জায়েদুল ফিরোজ।
একইভাবে, রেড অরেঞ্জ ইন্টারন্যাশনাল এর হিসাব খোলার আবেদন ফরমে পরিচয়দানকারী ছিলেন সোনিয়া মেহজাবিন। আলোচ্য সন্দেহভাজন প্রতিষ্ঠান ৩টির ব্যবসায়িক ঠিকানা একই মর্মে ব্যাংক হিসাবের দলিলাদিতে উল্লেখ রয়েছে।
তাছাড়া প্রতিষ্ঠান তিনটির ব্যাংক হিসাবে নিয়মিতভাবে ফান্ড ট্রান্সফার, আরটিজিএস এর মাধ্যমে লেনদেন সংঘটিত হয়েছে মর্মে লেনদেন বিশ্লেষণে পরিলক্ষিত হয়েছে।
প্রতিবেদনের সার্বিক পর্যালোচনা অংশে বলা হয়েছে, ই-অরেঞ্জ শপ, অরেঞ্জ বাংলাদেশ ও রেড অরেঞ্জ ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক কমমূল্যে গ্রাহকদের পণ্য সরবরাহের বিভিন্ন লোভনীয় অফারে প্রলুব্ধ করে বিপুল সংখ্যক গ্রাহকের কাছ থেকে অর্ডারের মূল্য বাবদ প্রাপ্ত অর্থ ব্যাংক হিসাবে জমা করেছেন মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে। পরে জমা করা অর্থ থেকে বিভিন্ন মার্চেন্টকে পরিশোধ করার পাশাপাশি সোনিয়া মেহজাবিন, তার স্বামী মাসুকুর রহমান, ভাই শেখ সোহেল রানা ও চাচা মোহাম্মদ জায়েদুল ফিরোজ কর্তৃক নগদে উত্তোলন ও ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর এবং নিজ নামে স্থায়ী সম্পদ ক্রয় করার জন্য মোট ১৮.৫৬ কোটি টাকা ই-অরেঞ্জ এর হিসাব থেকে স্থানান্তর/উত্তোলন করেন। গ্রাহকদের অগ্রীম মূল্য পরিশোধিত অর্ডারের কাঙ্ক্ষিত পণ্য সরবরাহ না করে সন্দেহভাজনরা উল্লিখিত অর্থ তাদের ব্যক্তিগত হিসাবে স্থানান্তর, নগদে উত্তোলন ও ব্যক্তিগত স্থায়ী সম্পদ ক্রয় করেছেন মর্মে পরিলক্ষিত হয়েছে যা প্রতারণার শামিল।
উল্লেখ্য, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ এর ২(শ)(৫) ধারা অনুসারে প্রতারণা সম্পৃক্ত অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত। কাজেই বর্ণিত অপরাধলব্ধ আয় আলোচ্য ব্যাংক হিসাবগুলোতে জমা, উত্তোলন, স্থানান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে সন্দেহভাজন ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান কর্তৃক মানিলন্ডারিং অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকতে পারে মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে।
বিএফআইইউ কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপের বিষয়ে বলা হয়েছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরিচালিত ই-অরেঞ্জ.শপ ও এর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সব হিসাবের সব তথ্য তদন্তের স্বার্থে ২৩/০৬/২০২১ তারিখে সিআইডিতে সরবরাহ করা হয়েছে। ই-অরেঞ্জ.শপ ও এর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট নামে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরিচালিত সব হিসাবে প্রতারণা থেকে উদ্ভূত অর্থ জমা হয়ে থাকতে পারে মর্মে সন্দেহ করে সিআইডির অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে হিসাবগুলোর লেনদেন মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ২৩(১)(গ) ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে গত ২৫/০৮/২০২১ তারিখে স্থগিত করা হয়। পরে ওই স্থগিতাদেশ ৩য় দফায় বর্ধিত করা হয়। বর্তমানে ই-অরেঞ্জ.শপ ও এর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট নামে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরিচালিত মোট আটটি হিসাব আদালতের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছে।
ব্যাংক হিসাবে অর্থ জমা সংক্রান্ত প্রতিবেদনের অংশে বলা হয়েছে, ই-অরেঞ্জ.শপ ও অরেঞ্জ বাংলাদেশ এর হিসাবে সম্পন্ন হওয়া লেনদেন পর্যালোচনায় পেমেন্ট গেটওয়ে সফটওয়্যার শপ লি.(এসএসএল কমার্স) কর্তৃক মোট তিন লাখ চার হাজার ৫২৫টি অর্ডার আইডির বিপরীতে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা ই-অরেঞ্জ শপকে পরিশোধ করা হয়েছে এবং ৬৬১টি অর্ডার আইডির মোট ৬৫.৯৯ লাখ টাকা গ্রাহককে রিফান্ড করা হয়েছে মর্মে পরিলক্ষিত হয়েছে।
ই-অরেঞ্জ থেকে ৭৭ কোটি টাকার পণ্য কিনে প্রতারণার শিকার ৫৪৭ জন গ্রাহকের পক্ষে মো. আফজাল হোসেন, মো. আরাফাত আলী, মো. তরিকুল আলম, সাকিবুল ইসলাম, রানা খান ও মো. হাবিবুল্লাহ জাহিদ নামের ছয়জন গ্রাহক গত মার্চে হাইকোর্টে রিট করেন। রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে চলতি বছরের ৭ এপ্রিল হাইকোর্ট রুল জারি করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)এর কাছে প্রতিবেদন চান। রুলে গ্রাহকদের নিরাপত্তা, সুরক্ষায় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের সঙ্গে সম্পৃক্ত বনানী থানার সাময়িক বরখাস্ত পরিদর্শক (তদন্ত) সোহেল রানা, সত্ত্বাধিকারী সোনিয়া মেহজাবিন ও বিথি আক্তারসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে গ্রাহক ঠকানো, অর্থপাচারের অভিযোগে আইনি ব্যবস্থা নিতে বিবাদীদের ব্যর্থতা ও নিস্ক্রীয়তা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়েছেন।
একইসঙ্গে সোহেল রানা, সত্ত্বাধিকারী সোনিয়া মেহজাবিন ও বিথি আক্তারসহ অন্যান্যদের কাছ থেকে টাকা উদ্ধার করে ক্ষতি অনুপাতে আবেদনকারীসহ অন্যান্য প্রতারিত গ্রাহকদের মাঝে সে টাকা বন্টন বা বিতরণের নির্দেশ কেন দেয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয় রুলে। ওই আদেশ অনুসারে বিএফআইইউ প্রতিবেদন দাখিল করে। আদালতে আবেদনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আহসানুল করিম ও আব্দুল কাইয়ুম লিটন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক।
গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় অভিযুক্ত ই–অরেঞ্জের সঙ্গে সম্পৃক্ত সোহেল রানাকে গত বছর ৩ সেপ্টেম্বর সীমান্ত এলাকা থেকে আটক করা হয়।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সদস্যরা অনুপ্রবেশের অভিযোগে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার চ্যাংড়াবান্ধা সীমান্ত থেকে তাকে আটক করে। পরে ৫ সেপ্টেম্বর তাকে সাময়িক বরখাস্তের কথা জানায় ঢাকা মহানগর পুলিশ।
২ বছর আগে
ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়াসহ ৩ জন কারাগারে
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমানসহ তিনজনকে রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। অপর আসামি হলেন ই-অরেঞ্জের চিফ অপারেটিং অফিসার আমান উল্ল্যাহ।
বৃহস্পতিবার (০২ সেপ্টেম্বর) ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বাকী বিল্লাহ এ আদেশ দেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার দুপুরে পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তাদের হাজির করা হয়। একই সাথে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিত বিচারক এ আদেশ দেন।
সোমবার (২৩ আগস্ট) ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোর্শেদ আল মামুন ভূইয়া পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
গত ১৭ আগস্ট ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবুবকর সিদ্দিকের আদালত ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমান আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেন। পরে বিচারক তাদের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এর আগে অগ্রিম অর্থ পরিশোধের পরও মাসের পর মাস পণ্য না পাওয়ায় ১৭ আগস্ট সকালে গুলশান থানায় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে মামলা করেন প্রতারণার শিকার গ্রাহক মো. তাহেরুল ইসলাম। তার সঙ্গে প্রতারণার শিকার আরও ৩৭ জনও উপস্থিত ছিলেন। মামলার এজাহারে তাদের স্বাক্ষর রয়েছে।
আসামিরা হলেন ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন, তার স্বামী মাসুকুর রহমান, আমান উল্ল্যাহ, বিথী আক্তার, কাউসার আহমেদ।
আরও পড়ুন: স্ত্রীকে এসিড নিক্ষেপ: স্বামীর মৃত্যুদণ্ড বহাল
ই-অরেঞ্জের মালিকসহ তিনজন ৫ দিনের রিমান্ডে
৩ বছর আগে