কমনওয়েলথ অব ইন্ডিপেনডেন্ট স্টেটস
আফগানিস্তান দেখা হলো না
প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের ফলে এর অন্তর্গত রিপাবলিকগুলো স্বাধীন হয়ে যায়। ইউক্রেন ও অন্যান্য ধনী রিপাবলিকগুলো নিজেদের সম্পদের জোরে টিকে থাকলেও তাজিকিস্তানের মতো গরিব রাষ্ট্রগুলো কষ্টে পড়ে যায়। মোড়লিপনা বজায় রাখতে রাশিয়ান ফেডারেশন সিআইএস (কমনওয়েলথ অব ইন্ডিপেনডেন্ট স্টেটস)নামে সংগঠন তৈরি করে। দরিদ্র দেশগুলোর মাঝে যাদের তরল/ কঠিন সোনা কিংবা খনিজ সম্পদ আছে, তাদের প্রতি বিশ্ব লুটেরাদের লোলুপ দৃষ্টির সাটেলাইট সব সময়ই নজরদারিতে আছে, সুযোগের অপেক্ষায়।
এমনি একটি দেশ তাজিকিস্তান। দেশটি প্রতিষ্ঠার সময় থেকে মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট নেতা রাখমানভ ক্ষমতায় আছেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী হলো ইসলামী সংস্কারপন্থী দল (আইআরএম)। তাদের নেতৃত্বে আছেন নির্বাসিত নেতা সৈয়দ আব্দুল্লাহ নূরী। সরকার ও ইসলামপন্থীদের সংঘর্ষের পরিণতিতে হাজার হাজার লোক আহত, নিহত ও গুম হয়। মানব ঢল একপ্রান্ত থেকে দেশের ওপর প্রান্তে নিরাপত্তার খোঁজে ছুটতে থাকে। মানবিক বিপর্যয়ের এক পর্যায়ে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ও ইউএনএমওটি (ইউনাইটেড নেশনস মিশনস অব অবজার্ভারস ইন তাজিকিস্তান) কার্যক্রম শুরু করে।
শান্তিচুক্তির পর যে যেখানে আছে সেখানেই থাকবে এ নিয়মে সরকারি দল শহরকেন্দ্রিক অবস্থানে আটকে পড়লো। আর মুসলিম সংস্কারপন্থীদের অবস্থান হলো গ্রাম ও পাশের দেশ আফগানিস্তানের দুর্ভেদ্য এলাকায়। দু’দেশের সীমানা পিয়াঞ্জ নদীর মধ্যরেখা বরাবর। উভয় দেশের এ এলাকাগুলো দুর্গম বিধায় নির্দিষ্ট রাস্তায় চলাচল সীমিত। তাই এসব ক্রিটিক্যাল পয়েন্টের দখল নিয়ে প্রায়ই সরকারি ও বিরোধীদের সংঘর্ষ লেগে থাকে। এসব স্থানে মাঝে মাঝেই পদাতিক পরিবহনকারী সাঁজোয়া গাড়ির আলো দেখা যায়। পিয়াঞ্জ নদীর অপর পাড়ের উঁচু পাহাড় চূড়া থেকে অ্যামবুশ (চোরাগোপ্তা হামলা) পরিচালনা করে বিরোধীরা পালিয়ে যায়।
শান্তিরক্ষীরা মীমাংসা বা তদন্তের সুযোগ পায় না। কারণ বিরোধী পক্ষ অনুপস্থিত। পাহাড়ি খরস্রোতা এঁকেবেঁকে যাওয়া নদীর পাড় দিয়ে যাওয়া রাস্তার নিরাপত্তা দুরুহ। তাজিক সেনারা সংখ্যায় কম এবং দক্ষতা ও নেই। পুনঃ পুনঃ হামলায় সীমান্ত রক্ষীরাও ভীত। সামাল দিতে লাখ লাখ ডলার খরচ করে রাশিয়ান বর্ডার ফোর্স ভাড়া করা হলো। অর্থের যোগান এলো সোনার খনি থেকে। সোনার খনির প্রাপ্য অর্থ অর্ধেক নিয়ে যায় উত্তোলনকারী ব্রিটিশ কোম্পানি। বাকি অর্ধেক নেয় রাশিয়ান বর্ডার ফোর্স। অনেকের ধারণা এখানে কোথাও উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে ইউরেনিয়াম। তাই জাতিসংঘ শান্তি মিশন।
শতভাগ সামরিক অফিসারদের দ্বারা পর্যবেক্ষকদের এই মিশনে বাংলাদেশি সামরিক অফিসারদের বিশেষ ভূমিকা ছিলো। পেশাদারিত্ব ও সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে বিবদমান গোষ্ঠীগুলোর মাঝে বাংলাদেশিদের গ্রহণযোগ্যতা ছিলো আশান্বিত। মুসলমান হিসেবেও আলাদা একটা স্থান ছিলো। ইসলামী কট্টরপন্থীদের সৃষ্ট চরম মুহূর্তগুলোকে মুসলিম পর্যবেক্ষকরা কৌশলে আয়ত্তে আনতে পেরেছিল। এ কৃতিত্ব শুধু বাঙালি মুসলিমদের, অন্য মুসলমান পর্যবেক্ষকদের নয়।
আমার মিশনে যোগদানের কিছুদিন পরেই ল্যাটিন আমেরিকান মিশন প্রধানের পরিবর্তে এলেন প্রাক্তন জার্মান কূটনীতিক মি. গার্ড মেরেম। প্রাক্তন মিশন প্রধানকে সদর দপ্তরের আসে পাশেও দেখা যেত না। তাই তার সাথে তেমন পরিচয় ছিল না। মি. মেরেম এসেই সবার সাথে কথাবার্তা বলেছেন, মিশন সম্পর্কে জানছেন। ব্যক্তিগত একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছেন। বাইরের কফি শপে বসে একসাথে লাঞ্চ সারলাম। পটেটো ম্যাশ, রাশিয়ান কাবাব ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেয়ে নিজের বিল নিজে দিয়ে দিলেন। আমরা ভাবছিলাম ওয়েলকাম লাঞ্চ দিয়ে মিশন প্রধান অল্পতে দায় সারবেন।
মি. মেরেম বাংলাদেশিদের প্রতি অনেক সহানুভূতিশীল ছিলেন। আমাদের নামের সঠিক উচ্চারণ করতেন, যা ব্রিটিশরা ইচ্ছা করেই বিকৃত করে থাকে। পরে কথা প্রসঙ্গে উনি জানালেন যে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিনি টেকনাফে কয়েক বছর কাজ করেছেন। তাই বাঙালিদের সম্পর্কে তার ব্যাপক ধারণা আছে।
মিশনের পর্যবেক্ষকগণ কয়েকটি টিমে বিভক্ত হয়ে কাজ করেন। কখনো চুক্তি লঙ্ঘন, কখনো গুম, হত্যা ইত্যাদি লেগেই আছে। বিভিন্ন ভ্যালিগুলো মুসলিম বিদ্রোহী ওয়ার লর্ডদের দখলে। উভয় দলের মাঝে সমঝোতার প্রচেষ্টা অব্যহত রয়েছে। UNMOT অপারেশন কক্ষের পাশেই একটা বেতার যন্ত্র বসিয়ে দেয়া হয়েছে যাতে আফগানিস্তানের টালোকান থেকে বিদ্রোহী মুসলিম নেতারা কথা বলতে পারেন । তবে স্থানীয় পর্যায়ে কিছু যোগাযোগ থাকলেও শীর্ষ পর্যায়ে কোনো বৈঠক হয়নি।
মিশন সদরের প্রচেষ্টায় একবার শীর্ষ বৈঠকে বসতে নেতারা সন্মত হলেন। দুশানবে থেকে প্রেসিডেন্ট রাখমানোভ ও তুরকেমিনিস্তান থেকে বিরোধী নেতা সৈয়দ আব্দুল্লাহ নুরী আফগানিস্তানের কুন্দুজ এ মিলিত হবেন। মধ্যস্থতা করবেন আমাদের মিশন প্রধান মিস্টার মেরেম।
জাতিসংঘ দলে অন্তর্ভুক্ত হতে পেরে নিজেকে একটু কেউকেটা মনে হলো। অতি উৎসাহে সমন্বয়ের কাজে লেগে গেলাম। চার গাড়িতে চারটি দলে বিভক্ত হয়ে আমরা দুশানবে থেকে যাত্রা করলাম। ঘন্টা ছয়েক লাগবে সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছাতে । যোগাযোগ মাধ্যম বেতার যন্ত্র ও স্যাটেলাইট ফোন। আমাদের কাজ হলো সীমান্তে পৌঁছানো। নদী পার ও পরবর্তী সূচি তালেবানদের হাতে। তখন তালেবানরা আফগনিস্তানের শাসক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তালেবানদের স্বীকৃতি দিয়ে বিশ্বে চমক লাগিয়ে দিয়েছে।
আমরা সীমান্তের ৪/৫ কিলোমিটার আগে একটা বিরতি নিলাম। জাতিসংঘের MRE ( meal ready to eat) প্যাকেট খুলে লাঞ্চ সারলাম। পরবর্তী থাকা, খাওয়া সব কিছু অনিশ্চিত। কিন্তু মিলিটারি অবজারভারের কোনো সমস্যা নেই। তার প্যাকে সবই আছে। শুধু অস্ত্র নেই। তার হাতে আছে জাতিসংঘের পতাকা।
গাড়িতে উঠতে যাবো। বেতার যন্ত্র গুটিয়ে এখনই রওনা দেবো। এমনসময় ডেল্টা বেইজ অর্থাৎ আমাদের সদর দফতর থেকে কল আসলো। নির্দেশ এলো আমরা যেখানে আছি সেখান থেকে যেনো আর এক কদমও আগে না যাই। কারণ বলা যাবে না। নিউইয়র্কের নির্দেশ। ডিউটি অফিসার আর বেশি তথ্য দিতে অপারগ। মিশন প্রধানকেও জানানো হলোনা যাত্রা থামিয়ে দেয়ার কারণ। সবাই জল্পনা-কল্পনায় ব্যস্ত।প্রায় আধা ঘন্টা কেটে গেলো।
মি. মেরেম এ সময় আমাকে কাছে ডাকলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এখন সদর দফতরে ডিউটি অফিসার কে?’ আমি বললাম, ‘মেজর জিয়া।’ তিনি বললেন, ‘ও তাহলে ভালোই হলো। তুমি তোমার বাংলাদেশি অফিসারের সাথে কথা বলো। তোমার নিজ আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলবে। জানতে চাও কী ঘটেছে ও ঘটতে যাচ্ছে। তারপর আমাকে বলো।’ প্রাক্তন কূটনীতিকের এমন বুদ্ধি দেখে চমৎকৃত হলাম।
এটা ভালো কাজ দিলো। জানা গেলো যে বিরোধী নেতা সৈয়দ আব্দুল্লা নুরীর বিমান ছিনতাই হয়ে গেছে। তালেবানরা তাকে কান্দাহার বা অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গেছে। শীর্ষ বৈঠক অনিশ্চিত। জাতিসংঘ সদর দফতরের নির্দেশের অপেক্ষায় থাকতে হবে। প্রেসিডেন্টের হেলিকপ্টার উড়তে গিয়েও নেমে গেলো। আমরা পথিমধ্যে খোশ-গল্পে মশগুল হলাম। বিভিন্ন মিশনের অভিজ্ঞতা, রঙ্গ রস কিছুই বাদ গেল না।
সন্ধ্যার কিছু আগে দুশানবে থেকে নির্দেশ এলো রাজধানীতে ফেরত যাবার। সবাই এক হয়ে আবার ফিরতি যাত্রা শুরু করলাম। আমাদের সুইজারল্যান্ডের অবজারভার বললো, ‘ইস একটা দেশ দেখা থেকে বঞ্চিত হলাম।’ পাসপোর্টের আফগান ভিসার দিকে সে একমনে তাকিয়ে আছে।
লেখক: কলামিস্ট ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
আরও পড়ুন: ‘আফগানিস্তান’ কোনো একক রাষ্ট্র নয়
তালেবান মাস্ক না পরলে কি কিছু এসে যায়
আমার আফগান স্টুডেন্টরা ও ১৯৭১ : ব্যক্তিগত অনুভূতি
৩ বছর আগে