সরকারিকরণ
আমাদের প্রাথমিক, মাধ্যমিক শিক্ষা ও প্রসঙ্গ কথা
দ্বিতীয় পর্যায়ে ৩৩২টি স্কুলকে সরকারিকরণ এবং বেশ ক’টি নতুন সরকারি স্কুল নির্মাণের পরও ২০১৯ সালের নভেম্বরের হিসাব অনুযায়ী দেশে মাধ্যমিক স্তরের সরকারি স্কুলের সংখ্যা মাত্র ৬৬৫টি। ১৯৯০ সালের পর গত তিন দশকে ছাত্রীদের শিক্ষার হার আনুমানিক ৫ গুন বেড়েছে। ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ বালিকা। বর্তমানে দেশে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা নামমাত্র বাধ্যতামূলক এবং কেবলমাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অবৈতনিক। তবে ভর্তি ফি, পুনঃভর্তি ফি’র চাপমুক্ত নয়।
স্বাধীনতার পর দেশে প্রাইমারি স্কুলের সংখ্যা ছিল ৩২ হাজারের বেশি, মাধ্যমিক ৬ হাজারের কম। বর্তমানে মাধ্যমিক স্কুলের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়েছে। প্রাইমারি পাশ করার পর এখন প্রায় ৯৬ শতাংশ শিক্ষার্থী ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে হাইস্কুলে ভর্তি হচ্ছে যা আশাব্যাঞ্জক। যেখানেই পড়ুক, সব শিশু যেন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া শেষ করে সেটা নিশ্চিত হওয়া জরুরি। মধ্যম আয়ের দেশ হতে হলে আরও বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া শেষ না করলে কাঙ্খিত ভিত্তি নির্মিত হবে না। সেই লক্ষ্যে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থাকে সৃদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে উচ্চ মাধ্যমিকের প্রবেশদ্বারকে সুগম করতে হবে। সেক্ষেত্রে বাণিজ্য/কলা/বিজ্ঞান ইত্যাদি বিভাজন উচ্চমাধ্যমিক খেকে কার্যকর হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এর বাস্তবায়নে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক ভাবনা চিন্তা আশার পালে হাওয়া দিচ্ছে।
মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মাত্র ৬৩ শতাংশ সরকারি স্কুলে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। বেসরকারি স্কুলের লেখাপড়ার খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে নিম্ন আয়ের অভিভাবক। ভর্তিতে অনিয়ম, যথেচ্ছ মাসিক বেতন, ভর্তি ফি, পুনভর্তি ফি সহ নানাবিধ অনৈতিকতার চর্চা শিক্ষার কাঙ্খিত সুন্দর পরিবেশকে ব্যাহত করছে, আহত করছে। নানাবিধ কোটার আবর্তে ভর্তি প্রক্রিয়া বাণিজ্যমুখীতার চোখ রাঙাচ্ছে, বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের লেখাপড়ার মানও প্রশ্নবিদ্ধ।
শিখন সংকট:
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের মধ্যে শেখার চাইতে পরীক্ষায় পাশ এবং উচ্চতর গ্রেড অর্জন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেক্ষেত্রে পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নপত্র মাথায় রেখেই স্কুলের পড়াশোনা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। হাত বাড়ালেই নোটবই আর পা বাড়ালেই কোচিং সেন্টারের খাঁড়াতো আছেই। শঙ্কা ও হতাশার ব্যাপার হচ্ছে জিপিএ-৫ পাওয়া অনেক শিক্ষার্থীই জিপিএ-এর মানে জানে না! ক্লাস সেভেনে পড়া শিক্ষার্থী ‘আমি ৭ম শ্রেণিতে পড়ি’ এই বাক্যের ইংরেজি অনুবাদ জানে না। আবার অনেকে অনুবাদ শব্দের অর্থই জানে না! যোগ্য শিক্ষকের অভাবই এর অবশ্যম্ভাবী কারণ।
চারপাশে নিম্নমানের কিন্ডারগার্টেন নামের প্রাথমিক স্কুল ছড়িয়ে রয়েছে। মুনাফা অর্জনই এসব প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীদের মূল লক্ষ্য। টেনে টুনে গ্র্যাজুয়েট এবং উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা প্রশিক্ষণহীন শিক্ষক (অধিকাংশ শিক্ষিকা) দিয়েই এসব স্কুলের পাঠক্রম পরিচালিত হয়। শিক্ষকদের বেতন ১৫০০-২০০০ টাকা! শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়িয়ে ওনারা কোনভাবে পুষিয়ে নেন। এর পরিণাম ভয়াবহ হতে বাধ্য।
ইংরেজি না জানলে কিছুতেই আর চলবেনা এই স্লোগানে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আমরা ছুটছি ভার্সন নামের আকর্ষণে। আর সেই সুযোগে সহজে মুনাফা অর্জনের বাণিজ্যে ঝটপট নেমে পড়েছেন চতুর বেনিয়া সম্প্রদায়। হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে আমরা পতঙ্গসম ঝাঁপিয়ে পড়েছি সন্তানকে ইংরেজির আলোয় আলোকিত করবো আশায়, যে মানের শিক্ষক বাংলা ভাষাই ঠিকমতো জানেন না, তিনি কি ইংরেজি শেখাবেন? ভুল উচ্চারণের ভুলভাল ইংরেজি শিখতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা মাতৃভাষা বাংলাও ভুলে যায়। ওরা এখন বাংরাজী ভাষায় কথা বলে!
কিন্ডারগার্টেন ও ইংলিশ ভার্সন স্কুলের ডামাডোলে একটু একটু করে গুছিয়ে নিতে থাকা বাংলা মাধ্যম স্কুল শিক্ষার্থী সংকটে মুখ থুবড়ে পড়ে। অনেক স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে মানসম্মত বাংলা মাধ্যম স্কুলের সংকট দেখা দেয়। সরকারি স্কুলেও শিক্ষার্থী সংকুলান হয় না।
শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে শুরু হয় সৃজনশীল পাঠদানের। চমৎকার সংযোজন। এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা নিজেদের সামর্থ্য যাচাই করার সুযোগ পায়। কিন্তু এই পদ্ধতির প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অপ্রতুলতার কারণে এর সুফললাভ ব্যাহত হচ্ছে।
এবার মূল বিষয়ে আসা যাক। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা যার জন্য ১৯৫২ সালে প্রাণ দিয়েছেন ভাষা শহীদেরা। একাত্তরে ভাষাভিত্তিক বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছে ত্রিশ লাখ শহীদ। অথচ সর্বস্তরে বাংলাভাষার প্রচলন নীরবে চোখের জল ফেলছে।
এমনটা হলে পরে:
চর্চার ক্ষেত্রে বাংলাভাষাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার লক্ষ্যে দেশজুড়ে মানসম্মত বাংলা মাধ্যম স্কুল স্থাপন এখন সময়ের দাবি। বানান এবং উচ্চারণের প্রতি যত্নশীল হওয়ার বিকল্প নেই। নির্দিষ্ট সংখ্যক বানানের জন্য নম্বর কর্তনের বিষয় বিবেচনা করলে কেমন হয়? উচ্চারণ, বানান, শিক্ষাদান পদ্ধতি ইত্যাদি সকল বিষয়ে শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণদান নিশ্চিত সুফল বয়ে আনবে।
লেখক: কবি ও শিশু সাহিত্যিক গোলাম কুদ্দুস চঞ্চল
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
আরও পড়ুন: শিক্ষা কাঠামো আধুনিক হচ্ছে: প্রধানমন্ত্রী
নতুন শিক্ষাক্রমে ছেলে-মেয়েরা আনন্দের মধ্যে পড়াশোনা শিখবে: দীপু মনি
ডেঙ্গু বান্ধব অসহায় ঢাকা!
৩ বছর আগে