উপকূলীয় জেলা
জলবায়ু পরিবর্তন: মোংলায় ৮৫ শতাংশ মানুষের নিরাপদ পানির ব্যবস্থা নেই
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের মোংলায় পানিতে লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে পানিতে ৯ গুন বেশি লবণাক্ততা পাওয়া গেছে। খাল-বিল, নদী-নালা, ডোবা ও ভূ-গর্ভস্থসহ সর্বত্রই পানিতে লবণ আর লবণ। লবণাক্ততার কারণে সুপেয় পানির চরম সংকট চলছে মোংলায়। উপজেলার ৮৫ শতাংশ মানুষ খাবারের নিরাপদ পানির জন্য হাহাকার করছে। জীবন বাঁচাতে খাবার পানির জন্য নারী-পুরুষকে কয়েক কিলোমিটার পাড়ি দিতে হচ্ছে। লবণাক্ত পানি পান করে অনেকে পেটের পীড়া এবং পাতলা পায়খানাসহ নানা রোগে ভুগছেন। অধিকাংশ মানুষের খবারের জন্য বৃষ্টি পানি একমাত্র ভরসা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মোংলা উপজেলা চারদিক থেকে নদী-খাল দ্বারা বেষ্টিত। গ্রামগুলোতে ডোবা-নালা আর মৎস্যঘেরে ভরা। যেদিকে চোখ যায় সবদিকেই পানি থৈ থৈ করছে। কিন্তু সব পানিই অতিমাত্রায় লবণাক্ত। ওই সব পানি খাবার তো দুরের কথা ব্যবহার যোগ্য নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মোংলা উপজেলার সর্বত্রই পানিতে লবণাক্ততা বাড়ছে। কোন কোন পরিবারে ব্রাকের বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ পদ্ধতি দেখা মিলেছে। পানির কথা বলতেই বিভিন্ন গ্রামের নারী-পুরুষরা এক বাক্যে তাদের সুপেয় পানির তীব্র সংকটের কথা জানালেন।
উপজেলার উত্তর চাঁদপাই গ্রামে মধ্য বয়সী রোজিনা বেগমের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, টিনসেডের বাড়িটির এক পাশ দিয়ে খাল বয়ে গেছে। অপর দুই পাশে পুকুর আর মৎস্যঘের। বাড়ির তিন পাশেই পানি। কিন্তু সব পানিই লবণাক্ত। পাশে ফুলজান বিবির বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল বাড়ির এক পাশে পুকুর আর অপর পাশ দিয়ে খাল বয়ে গেছে। ওই দুই বাড়িতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য দুই হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ট্যাংক এবং জীবানুমুক্ত করার জন্য পানি ফিল্টারের ব্যবস্থা দেখা গেছে। ব্রাকের জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির আওতায় তাদেরকে ওই পানি সংরক্ষণ পদ্ধতি দেয়া হয়েছে বলে তারা জানান।
বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এর প্রভাবে বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সংখ্যা এবং তীব্রতা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই সাথে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের নদ-নদী ও ভূ-গর্ভস্থ পানিতে লবণাক্ততা বাড়ছে। যা এই অঞ্চলের কৃষি, স্বাস্থ্য ও জীবিকার ক্ষতি করবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের ১৯ জেলার ৭০ উপজেলায় চার কোটি মানুষ বাস্তচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। চার দশকে লবণাক্ত জমির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ২৭ শতাংশ। পশুর নদীর মোংলা পয়েন্টে ১৯৬২ সালে লবণাক্ততার পরিমাণ ছিল দুই পিপিটি। ২০০৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ পিপিটিতে। বর্তমানে দেশের ১৯টি উপকূলীয় জেলার ১৫৩ উপজেলায় প্রায় ৫ কোটি মানুষের বসবাস। যার মধ্যে ১০ থেকে ৩৫ শতাংশ মানুষ অতিদরিদ্র।
তথ্য মতে, লবণাক্ততা বাড়ার কারণে উপকূলের তিন কোটি ৫০ লাখ মানুষ তীব্র খাবার পানি সংকটে ভুগছেন। এখানে একজন মানুষ প্রতিদিন গড়ে মাত্র দুই লিটার খাবার পানির মাধ্যমে ১৬ গ্রাম লবণ গ্রহণ করেন। যে খানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ দিনে পাঁচ গ্রাম। লবণাক্ততা ছাড়াও আয়রন, আর্সেনিক ও ফ্লোরাইডও পাওয়া যায় এসব এলাকার পানিতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, লবণাক্ততার প্রভাবে ২০৫০ সাল নাগাদ ৩০ থেকে ৫০ লাখ দরিদ্র ও ২০ থেকে ৩০ লাখ অতিদরিদ্র মানুষ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আরও পড়ুন: জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর পাঁচ প্রস্তাব
৩ বছর আগে