হৃৎপিণ্ড
বিশ্বে প্রথমবারের মতো মানবদেহে সফলভাবে শূকরের হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন
এক সময় অচিন্তনীয় ঘটনা হলেও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্রমবিকাশে পশু ও মানুষের মাঝে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের বিষয়টি ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে স্বাভাবিক অভিজ্ঞতায়। পূর্বে জীন প্রকৌশলের মাধ্যমে শূকরের কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। আর এবার সম্ভব হলো মানবদেহে শূকরের হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন। এই অভিনব সার্জারিটি সফলতার সাথে সম্পন্ন করলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড মেডিকেল স্কুলের চিকিৎসকরা। যুক্তরাষ্ট্রের ৫৭ বছর বয়সী ডেভিড বেনেট হচ্ছেন সেই মানুষ যিনি শূকরের হৃৎযন্ত্র বুকে নিয়ে এখন পর্যন্ত সুস্থ আছেন। চলুন, চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই যুগান্তকারী অনবদ্য সংযোজনটির ব্যাপারে বিস্তারিত জেনে নিই।
মানবদেহে শূকরের হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন
এরকম ভিন্ন প্রজাতির মধ্যে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের নিরীক্ষণের প্রচেষ্টাটা (মেডিকেল শাস্ত্রে যাকে বলা হয় জেনোট্রান্সপ্লান্টেশন) শুরু হয় ১৭ শতকে। প্রাথমিক গবেষণাটি কেন্দ্রীভূত ছিল স্তন্যপায়ী গোত্রভুক্ত আদিম প্রাণীদের বা প্রাইমেটদের উপর। কিন্তু এই ধরনের সকল প্রচেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়েছে মানবদেহের আভ্যন্তরীণ কাঠামোর সাথে সেই সব প্রাণীর অঙ্গগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ার কারণে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে নিকট অতীতের ঘটনা- শিশু ফা-এর কথা। ১৯৮৪ সালে শিশুটি একটি বেবুনের হৃৎপিণ্ড নিয়ে ২১ দিন বেঁচে ছিল।
অতঃপর ২১ শতকের এই তৃতীয় দশকের প্রারম্ভে মেরিল্যান্ডের ড. বার্টলি গ্রিফিথ ও তাঁর দলের অস্ত্রোপচারটি যুগান্তকারী একটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করল। প্রায় আঠ ঘণ্টা লেগেছিল শূকরের হৃৎযন্ত্রটিকে ৫৭ বছর বয়সী ডেভিড বেনেটের বুকে প্রতিস্থাপন করতে। তাই ২০২২ এর ৭ জানুয়ারি শুক্রবার দিনটি বেনেটের পরিবারের পাশাপাশি তাঁর চিকিৎসকদের জন্যও বেশ উত্তেজনাকর ছিল।
সর্বমোট ১০টি অনন্য জীনের উপর কাজ করার জন্য ছয়টি মানব জীন প্রবেশ করানো হয়েছিল জীনোমে। এই জীনগত প্রকৌশলটি সম্পাদন করেছিল ২০২১ এর সেপ্টেম্বরে ভার্জিনিয়ার বায়োটেক ফার্ম রেভাইভিকোর। তারা অস্থায়ীভাবে একটি মৃত মানুষের শরীরে একটি শূকরের কিডনি সংযুক্ত করেছিলেন এবং এটি কাজ করতে শুরু করেছিল। আর মেরিল্যান্ড ট্রান্সপ্লান্ট তাদের সেই পরীক্ষাকে পরবর্তী স্তরে নিয়ে যায়। তারা এমন একটি শূকরের হৃৎপিণ্ড ব্যবহার করেছিলেন, যেটি তার কোষে চিনি অপসারণের জন্য জীনগত প্রকৌশলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। এই শূকরগুলোর আকার, দ্রুত বৃদ্ধি এবং দ্রুত বংশবৃদ্ধি বৈশিষ্ট্যের কারণে আদর্শ দাতা হিসেবে তৈরি হয়।
আরও পড়ুন: স্মার্ট আইডি কার্ড: জাতীয় পরিচয়পত্রে ভুল থাকলে যেভাবে সংশোধন করবেন
আর এই হৃৎপিণ্ডটি সরবরাহ করেছে সেই বায়োটেক ফার্ম রিভাইভিকোর। অঙ্গটি অস্ত্রোপচারের আগ পর্যন্ত সচল রাখার জন্য একটি অঙ্গ-সংরক্ষণ মেশিনে রাখা হয়েছিল। পাশাপাশি তাতে একটি পরীক্ষামূলক নতুন অ্যান্টি রিজেকশান ওষুধও ব্যবহার করা হয়, যেটি তৈরি করেছিল কিনিক্সা ফার্মাসিউটিক্যাল্স।
এই পরীক্ষামূলক অস্ত্রোপচারটির সবচেয়ে কঠিন দিক ছিল রোগীকে পুরো ব্যাপারটা জানানো। আর এই কাজটি বেশ বুদ্ধিমত্তার সাথেই করেছেন এই অস্ত্রোপচারের প্রধান চিকিৎসক ডা. বার্টলি গ্রিফিথ। প্রথম চিকিৎসা হওয়াতে পুরো ব্যাপারটিতে ছিল আদ্যোপান্ত অনিশ্চয়তা। এর আগে ডা. প্রিফিথ পাঁচ বছরে প্রায় ৫০টি বেবুনে শূকরের হৃদয় প্রতিস্থাপন করেছেন। অস্ত্রোপচার পরীক্ষামূলক ছিল এবং এর ফলাফল অনিশ্চিত ছিল।
আরও পড়ুন: অতিরিক্ত আবেগ হতে পারে শরীরের ক্ষতির কারণ
শূকরের হৃৎপিণ্ডধারী প্রথম মানুষ আমেরিকান ডেভিড বেনেট
ডেভিড বেনেট তাঁর সারাটা জীবন পুল মেরামত, গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ, পেইন্টিং সহ বৈচিত্র্যপূর্ণ কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। প্রায় এক দশক আগে একটি শূকরের ভাল্ব লাগিয়েছিলেন।
বেশ কয়েকবার হৃৎপিণ্ড দাতার খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরে, কয়েকটি হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন পরীক্ষায় অযোগ্য হওয়ার পর একদম হতাশ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। শারীরিক অবস্থা, হার্ট ফেইলিওর এবং অনিয়মিত হৃদস্পন্দন তাকে কৃত্রিমভাবে হার্ট পাম্পের জন্য অযোগ্য করে তুলেছিল। এভাবে নিজের হৃৎপিণ্ডটাকে বাঁচানোর জন্য দুই মাস চেষ্টা করেও কাজ হয়নি।
এই সবকিছু ভেবে শেষমেষ ডা. গ্রিফিথের প্রস্তাবে অনেকটা জুয়া খেলার মত করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন বেনেট।
আরও পড়ুন: ঢাকার কাছেই প্রকৃতির মাঝে ক্যাম্পিং সাইট
জটিল অস্ত্রোপচারের পর রোগীর বর্তমান অবস্থা
অস্ত্রোপচারের পর প্রথম ৪৮ ঘণ্টা গুরুতর কোন ঘটনা ছাড়াই কেটেছে। গত সোমবার থেকে অবস্থার বেশ উন্নতি পরিলক্ষিত হয়েছে। তখনো হার্ট-ফুসফুস বাইপাস মেশিনের সাথে সংযুক্ত ছিলেন বেনেট, এমনকি সে অবস্থায় নিজে নিজেই শ্বাস নিতে পারছিলেন। অবশ্য তবে এটি সদ্য নতুন হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপিত হওয়া রোগীর ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক নয়।
এখনো তার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রতিক্রিয়া নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। ঝুঁকি যদিও কম এরপরেও তার শূকর ভাইরাস বা পোরসিন রেট্রোভাইরাস-এর সংক্রমণের দিকটাও পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
তবে এ ধরনের প্রাথমিক স্টেজের প্রতিস্থাপন শেষ পর্যন্ত কাজ করতে পারে কিনা তা অন্বেষণ করার জন্য এটি আরও বেশি সময় প্রয়োজন। এখনো সম্ভাবনার দোলাচলটা থেকেই যাচ্ছে। এরপরও বেনেট আশা করেন যে, এটা চূড়ান্তভাবে কাজ করবে এবং পরবর্তীতে তিনি মানুষের হৃৎপিণ্ডও নিজের বুকে প্রতিস্থাপন করতে পারবেন।
আরও পড়ুন: স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পিংক সল্ট বা হিমালয় লবণের উপকারিতা
পরিশিষ্ট
মানবদেহে সফলভাবে শূকরের হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন একটি যুগান্তকারী উদ্ভাবন, যার চূড়ান্ত ব্যবহারিক সফলতা জন্মগত বিকলাঙ্গ সহ অন্যান্য শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত লক্ষাধিক রোগীদের আশা উদ্রেক করবে। রোগীদের সংখ্যার তুলনায় অধিক হারে অঙ্গগুলোর সরবরাহ মিলবে। গত বছর প্রায় ৩ হাজার ৮১৭ আমেরিকান রোগী মানব হৃৎপিণ্ড পেয়েছে। সংখ্যাটি পূর্বাপেক্ষা বেশি হলেও সম্ভাব্য চাহিদা আরও বেশি। তবে মেরিল্যান্ডের চিকিৎসকরা এই চিকিৎসাটিকে ওয়াটারশেড-এর সাথে তুলনা করেছেন। অর্থাৎ এটি অনেক বড় সাফল্যের একটা ছোট ফলাফল। বেনেটের বুকে স্থাপিত হৃৎপিণ্ডটি যে শূকরের ছিল তার গোত্রের উপর জীনগত প্রকৌশল চলার কারণে বাই প্রোডাক্ট হিসেবে এই হৃৎপিণ্ডে মানুষ বাঁচানোর বৈশিষ্ট্যগুলো পাওয়া গেছে। সুতরাং হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে খুব শিগগিরই একটা বড় পরিবর্তনের আশা রাখা যায়।
২ বছর আগে
বুক ব্যথার নানা ধরন: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা
মানুষের ইমার্জেন্সির রুমের শরণাপন্ন হওয়ার সবচেয়ে সাধারণ কারণগুলোর একটি হলো বুকে ব্যথা। বুকে ব্যথা ধারালো ছুরিকাঘাতের মত, পীড়ন বা বুক জ্বালা, বুকে হাল্কা চাপ অনুভূত হওয়া ইত্যাদির মত বিভিন্ন আকারে দেখা দিতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে ব্যথা ঘাড়, চোয়াল হয়ে পিছনে বা নীচে হাতে ছড়িয়ে পড়ে। এগুলোর মধ্যে হৃৎপিণ্ড বা ফুসফুস-এর সাথে জড়িত বুক ব্যথাগুলো জীবনের জন্য সবচেয়ে বেশি হুমকি হতে পারে। আবার অনেক সাধারণ কারণও এটি ঘটিয়ে থাকতে পারে। বিভিন্ন ধরনের এই বুক ব্যথার শনাক্তকরণ ও করণীয় নিয়েই এবারের ফিচার।
কি কি কারণে বুক ব্যথা হয়
হৃদপিণ্ড সম্পর্কিত কারণ
এই কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো হার্ট অ্যাটাক, যা হৃৎপিণ্ডে রক্ত প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। এনজাইনার ফলে হৃদপিন্ডের দিকে পরিচালিত রক্তনালীতে বাধা সৃষ্টি হয়ে বুকে ব্যথা হয়। এছাড়া হৃৎপিণ্ডের চারপাশে থলির প্রদাহ বা পেরিকার্ডাইটিস, হৃৎপিণ্ডের পেশীর প্রদাহ বা মায়োকার্ডাইটিস, হৃৎপিণ্ডের পেশীর রোগ কার্ডিওমায়োপ্যাথি বুক ব্যথার কারণ হয়। বুক ব্যথার আরও একটি ভয়াবহ কারণ মহাধমনী ব্যবচ্ছেদ, যা এমন একটি বিরল অবস্থা যার ফলে মহাধমনী ছিঁড়ে হৃদপিণ্ডের সংযোগস্থল থেকে বেরিয়ে আসে।
আরও পড়ুন: লবঙ্গের স্বাস্থ্যগত উপকারিতা ও ঝুঁকি
পাকস্থলী ও অন্ত্র সম্পর্কিত কারণ
অ্যাসিড রিফ্লাক্স, বা অম্বল, খাদ্যনালীর ব্যাধির ফলে গলাধঃকরণে সমস্যা, পিত্তথলিতে পাথর, গলব্লাডার বা প্যানক্রিয়াসের প্রদাহ ইত্যাদি এই কারণগুলোর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত।
ফুসফুস সম্পর্কিত কারণ
এই কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে নিউমোনিয়া, ভাইরাল ব্রংকাইটিস, নিউমোথোরাক্স, রক্ত জমাট বাঁধা বা পালমোনারি এম্বুলাস। ফুসফুস সম্পর্কিত আরও একটি জটিলতা ব্রঙ্কোস্পাজম, যেটি সাধারণত এমন লোকেদের মধ্যে ঘটে যাদের হাঁপানি ও হাঁপানি সংক্রান্ত ব্যাধি আছে।
আরও পড়ুন: কোলেস্টেরল কমানোর কার্যকরী ঘরোয়া উপায়
পেশী- বা হাড় সম্পর্কিত কারণ
থেঁতলে যাওয়া বা ভাঙ্গা পাঁজর, পরিশ্রম বা দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা থেকে কালশিটে পেশী, কম্প্রেশন ফ্র্যাকচার-এর স্নায়ুর উপর চাপ সৃষ্টি করা প্রভৃতি থেকে বুক ব্যথা হতে পারে।
দাদ
চিকেনপক্স ভাইরাসের পুনঃসক্রিয়তার কারণে, দাদ হতে পারে এবং পিঠ থেকে বুকের প্রাচীর পর্যন্ত ফোসকা তৈরি করতে পারে।
আরও পড়ুন: এসি রক্ষণাবেক্ষণ: দীর্ঘদিন ব্যবহারের উপযোগী রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ টিপস
বিভিন্ন ধরনের বুক ব্যথার লক্ষণ
হৃদপিণ্ড সম্পর্কিত লক্ষণ
যদিও বুক ব্যথা হার্টের সমস্যার সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ, তবে বুকে ব্যথার পাশাপাশি অন্যান্য উপসর্গগুলোও অনুভূত হতে পারে। যেমন: বুকে চাপ, পিঠ, চোয়াল বা বাহুতে ব্যথা, ক্লান্তি, হালকা মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, নিঃশ্বাসের দুর্বলতা, পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব, এবং পরিশ্রমের সময় বুক ব্যথা।
৩ বছর আগে