কাজী আনোয়ার হোসেন
এমআর নাইন: পর্দায় অবহেলিত ‘মাসুদ রানা’
গোয়েন্দা গল্পনির্ভর সিনেমা দেখার আগে একটু স্থির হয়ে বসতে হয়। যেন কোনো দৃশ্য পাশ কাটিয়ে না যেতে পারে। আর মূল ঘটনা শুরুর পর যেন এক ধাঁধা মেলানো খেলা চলতে থাকে মাথায়। আর পরতে পরতে উত্তেজনা তো আছেই।
যেই প্রসঙ্গে এতো কথা বলা তার কারণ সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘এমআর নাইন: ডু অর ডাই’ সিনেমাটি। একে তো বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এতো বড় বাজেটের সিনেমা হয়নি, তার ওপর এটি কাজী আনোয়ার হোসেনের কালজয়ী সৃষ্টি মাসুদ রানাকে নিয়ে। এই সিনেমা নিয়ে আলোচনায় আরও বেশি করে ঘি ঢালা হয়েছে হলিউডের যৌথ প্রযোজনার প্রসঙ্গ টেনে।
সিনেপ্লেক্সের সিটে বসে অপেক্ষা শেষে শুরু হলো ‘এমআর নাইন: ডু অর ডাই’। মাসুদ রানা সিরিজের ‘ধ্বংস পাহাড়’ গল্প অবলম্বনে এই সিনেমা। তবে বলে রাখি সিনেমায় গল্পটিকে হুবুহু তুলে ধরা হয়নি।
১৯৬৬ সালে প্রকাশ হওয়া সেই গল্পকে আধুনিক সময়ে রূপ দেওয়া হয়েছে। যারা বইয়ের সঙ্গে মিল রেখে সিনেমাটিকে প্রত্যাশা করবেন তাদেরকেই মূলত জানিয়ে রাখা।
একটি হলিউডের সিনেমা দেখতে বসলে পর্দায় ঠিক যা আপনার চোখে আসে প্রায় একই আবহে শুরু হয় ‘এমআর নাইন: ডু অর ডাই’। গল্পটি শুরু হয় আমেরিকা থেকে।
আরও পড়ুন: প্রীতম-ফারিণ জুটির সিনেমা 'কাছের মানুষ দূরে থুইয়া’
এরপর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘুরে শেষ হবে সেখানেই। প্রথম দিকে দর্শকরা পরিচিত হবেন দুজন সিআই এজেন্টের সঙ্গে। যেই চরিত্র দুটিতে অভিনয় করেছেন নিকো ফস্টার ও মাইকেল জ্য হোয়াইট।
একজন লোকাল ড্রাগ ডিলারকে ধরতে সিআই এজেন্টের এক মিশন দিয়ে যেভাবে সিনেমাটা শুরু হয় ততক্ষণে একটু স্থির হয়ে চোখ শুধু পর্দায় রাখলাম। মনেই হচ্ছে না বাংলাদেশের কোনো সিনেমা দেখছি।
লোকেশন, ফ্রেমিং, অ্যাকশন সব মিলিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ না হয়ে হয়তো উপায় থাকবে না। আর সঙ্গে আবহ সঙ্গীত দিয়ে শুরুর কিছুক্ষণ পর্দা থেকে চোখ সরানো ফুসরত পাওয়া যাবে না।
এই আবহ সঙ্গীতটি তৈরি করেছেন ভারতীয় বংশোদ্ভুত আমেরিকান সঙ্গীত পরিচালক রিকি কেজ। যার হাতে এখন পর্যন্ত ৩টি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড উঠেছে। ‘এমআর নাইন: ডু অর ডাই’ তে তার মুন্সিয়ানার পরিচয় বেশ ভালোভাবেই পাওয়া যায়। তবে কিছু জায়গায় এতো একটু কানের আরাম পেলে ভালো হতো!
পরিচালক আসিফ আকবরের অভিষেক হিসেবে সিনেমার শুরুটা প্রশংসার দাবি রাখে। শুরুর এই মুগ্ধতা নিয়ে মাসুদ রানার পর্দায় কখন আসবে সেই অপেক্ষা তখনও। তবে মূল চরিত্রকে নির্মাতা বেশিক্ষণ আর আড়ালে রাখলেন না। সিআই এজেন্টদেরও তখন মিশন সফল করতে প্রয়োজন মাসুদ রানাকে।
এক জঙ্গলে দেখা মিললো মাসুদ রানার। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন এবিএম সুমন। ‘ঢাকা অ্যাটাক’ দিয়ে শুরু হয় তার পরিচিতি। তবে মূল চরিত্র হিসেবে ‘এমআর নাইন: ডু অর ডাই’ তার প্রথম মুক্তি পাওয়া সিনেমা।
বড়পর্দায় প্রথম মূল চরিত্রে কাস্ট হওয়াটা ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। তাও এখানে দুটি বিষয় খুবই বিবেচনা করা মতো। এক, মাসুদ রানা একটি বিখ্যাত চরিত্র। সেই গোয়েন্দা হয়ে পর্দায় আসা এবং দর্শকদের গ্রহণ যোগ্যতা। অন্যটি, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে বিগ বাজেটের সিনেমা।
এই প্রসঙ্গগুলোর ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে চলুন একটু দেখে নিই পর্দার মাসুদ রানা কেমন ছিল।
গোয়েন্দা গল্পনির্ভর সিনেমার প্রাণ মূল চরিত্র। মানে এখানে মাসুদ রানা। স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা ছিল তার ওপর থেকে চোখ সরানো যাবে না। কিন্তু নির্মাতা তার ওপর চোখই রাখতে দিলেন না। এখনও শুরুর কথা বলছি।
প্রথম দৃশ্যেই এবিএম সুমন এক প্রাণহীন মাসুদ রানা হিসেবে পর্দায় এলেন। শুধু যেটুকু ছিল সেটি তার এক্সপ্রেশনে গোয়েন্দা লুক আনার চেষ্টা। আর তার অস্ত্র গোছানো। এরপরই সেই দৃশ্য শেষ। তার কিছুক্ষণ পর বাংলাদেশের বিসিআইএর অফিসে দেখা যায় আমেরিকা থেকে আসা সিআই এজেন্ট পল টেইলরকে (নিকো ফস্টার)।
এর মাঝে হলিউড বা বলিউডের সেই পুরোনো ঢংয়ে এক মিশনে মাসুদ রানার একটি অ্যাকশন দৃশ্য ফ্ল্যাশব্যাকে দেখানো হলো। সেখানে কিছুটা মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা ছিল সুমনের। তবে তার আশেপাশে সবাই যখন এত ভালো পারফর্মেন্স দেখাচ্ছে সেখানে তিনি যেন ঢাকা পড়ে যাচ্ছিলেন।
এতক্ষণ পর্যন্ত প্রায় ২০ মিনিট চলে গেলেও মাসুদ রানার মধ্যে কোনো প্রাণ পাওয়া গেল না। অথচ গোয়েন্দা গল্পের সিনেমায় মূল চরিত্রের বিভিন্ন সংলাপ, তার বুদ্ধিচর্চা, মিশন নিয়ে তার অবজারভেশন এসবই যেন মুগ্ধ করে দর্শককে। অথচ সিনেমার মাসুদ রানার মুখে নেই কোনো শক্তিশালী সংলাপ, নেই তার অভিনয়ের কোনো জায়গা।
আরও পড়ুন: বিশ্বব্যাপী মুক্তির দিন বাংলাদেশে 'জাওয়ান’
খুব অবহেলায় এন্ট্রি হলো মাসুদ রানার। তবে তখনও আশা তো থেকে যায়। শত হলেও মাসুদ রানা। হতে পারে আমেরিকায় গিয়ে সব চমকের খোলাসা হবে।
আমেরিকায় এক সেফ হাউজে রাখা হয় মাসুদ রানাকে। এই মিশনে তাকে নিয়ে আসার মূল কারণ তার দক্ষতা অথচ পুরো সিনেমায় কয়েকটি অ্যাকশন দৃশ্যছাড়া মাসুদ রানাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। মূল চরিত্রকে পরিচালক কেন এত কম সময় পর্দায় রাখলেন সেটি প্রশ্নবিদ্ধের বিষয়।
তবুও এবিএম সুমন সেটুকু সুযোগ পেয়েছেন সেখানে অভিনয়ের দক্ষতাটা প্রমাণ করতে পারলে হয়তো তাকে নিয়েও কয়েকটি প্রশংসার লাইন লেখা যেত।
যদি ‘এমআর নাইন: ডু অর ডাই’ প্রোডাকশনের প্রযুক্তিগত দিকের কথা বলি, সেখানে পরিচালক শুধুমাত্র বাজেটের কারণে উতরে গেছেন। কিন্তু পরিচালক হিসেবে প্রশংসা পেতে হলে সিনেমায় গল্পের মালা গাঁথাটা জানতে হয়। তবে প্রথম পরিচালনা হিসেবে নির্মাতা আসিফ আকবের চেষ্টার প্রশংসা করতে হয়।
আমেরিকায় আসার পর সিআইয়ের সঙ্গে এক ড্রাগ ডিলারকে ধরার মিশনে নামেন মাসুদ রানা। সেই গল্প দেখানো হয়েছে সিনেমা। আর বইয়ের গল্পে যে ধ্বংসা পাহাড়কে দেখানো হয়েছে সেটি দেখা যাবে সিনেমার একবারে শেষ অংশে।
সিনেমার শেষটা হয় দীর্ঘ এক অ্যাকশন নিয়ে, তবে সেই অংশেও নৌকার বৈঠা পাননি এবিএম সুমন। হলিউডের অভিনয়শিল্পীদের দিয়ে মিশনের সফলতা দেখিয়েছেন পরিচালক। তাই বলা যায় পুরো সিনেমাতেই অবহেলিত ছিলেন মাসদ রানা।
লেখাটি শেষ করার আগে বাংলাদেশ থেকে অভিনয় করা কয়েকটি চরিত্র নিয়ে বলা যাক।
সিনেমায় অল্প সময়ের জন্য আমেরিকার অংশে দেখা যাবে আনিসুর রহমান মিলনকে। অনেকদিন পর পর্দায় তার ফেরাটা ছিল বড়কিছু দিয়েই। আর এখানে তিনি অভিনেতা হিসেবে তার মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। তবে পর্দায় তাকে বেশিক্ষণ থাকার সুযোগ দিলেন না পরিচালক।
অন্যদিকে গল্পের প্রয়োজনে বিভিন্ন দৃশ্যে অভিনয় করেছেন শহীদুল আলম সাচ্চু। এমন একজন অভিনেতাকে আসিফ আকবর শুধু গ্রিন স্ক্রিনের দৃশ্যে আটকে রাখলেন বোঝা গেল না। তবে যেখান মূল চরিত্রে এতটা অবহেলিত সেখানে তাদের বিষয়টা তো আলোচনার বাইরেই চলে যায়।
আর আলোচনায় না থাকলেও পর্দায় নিজেকে বেশ ফুটিয়ে তুলেছেন মাসুদ রানার নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করা ভারতীয় অভিনেত্রী সাক্ষী প্রধান। আর একটি দৃশ্যে দেখা যাবে থ্রি ইডিয়েটখ্যাত অভিনেতা ওমি বৈদ্যকে।
‘এমআর নাইন: ডু অর ডাই’কে বলা যায় শুধু বাজেট খরচের সিনেমা। যেখানে নেই গোয়েন্দা সিনেমার কোনো উত্তেজনা। গোয়েন্দাগীরির চেয়ে গল্পহীন অ্যাকশন সিনেমা হয়ে উঠেছে ‘এমআর নাইন: ডু অর ডাই’।
আরও পড়ুন: ক্যানবেরা মাতালো সোলস
১ বছর আগে
‘মাসুদ রানা’র লেখক-প্রকাশক কাজী আনোয়ার হোসেন আর নেই
জনপ্রিয় রহস্যধর্মী সিরিজ ‘মাসুদ রানা’র লেখক ও প্রকাশক কাজী আনোয়ার হোসেন মারা গেছেন। বুধবার বিকালে রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।
কাজী আনোয়ার হোসেনের পুত্রবধূ মাসুমা মাইমুর এক ফেসবুক পোস্টে এ তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি লেখেন, ‘গত অক্টোবরের ৩১ তারিখ প্রোস্টেট ক্যান্সার ধরা পড়ে আব্বার (কাজী আনোয়ার)। মাঝে পাঁচ বার হসপিটালাইজড ছিলেন। চিকিৎসার সুযোগ খুব একটা পাওয়া যায়নি। একটা ব্রেইন স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাক হয়ে সব শেষ হয়ে গেল। ১০ জানুয়ারি থেকে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন তিনি।’
কাজী আনোয়ার হোসেনের বোন ও ছায়ানটের সভাপতি সানজিদা খাতুন জানান, গতকাল তাকে বারডেমে ভর্তি করে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেয়া হয়।
আরও পড়ুন: বাঙালি কার্টুনিস্ট নারায়ণ দেবনাথ আর নেই
আগামীকাল সকালে তার নামাযে জানাজা ও দাফন হবে বলেও জানান তিনি।
জাতীয় অধ্যাপক, বিজ্ঞানী, লেখক ও শিক্ষাবিদ কাজী মোতাহার হোসেন ও সাজেদা খাতুনের ঘরে ১৯৩৬ সালের ১৯ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন কাজী আনোয়ার হোসেন।
তিনি ১৯৫২ সালে সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। তিনি জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে বিএ এবং ১৯৮১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন।
পাঠন নন্দিত রহস্যধর্মী সিরিজ ‘মাসুদ রানা’র জন্য ব্যাপক পরিচিত কাজী আনোয়ার হোসেন ১৯৬৩ সালে সেগুনবাগিচায় ‘সেগুনবাগান প্রকাশনী’ হিসেবে তার প্রথম প্রেস ব্যবসা শুরু করেন। তার প্রথম প্রকাশনার নাম ছিল ‘কুয়াশা-১’ এবং এটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালের জুন মাসে।
আরও পড়ুন: ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট ডেভিড সাসোলি আর নেই
পরবর্তীতে প্রকাশনা সংস্থার নাম পরিবর্তন করে ‘শেবা প্রকাশনী’ রাখেন তিনি। কাজী আনোয়ার হোসেন ১৯৬৬ সালে ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের প্রথম সংস্করণ ‘ধ্বংস পাহাড়’ প্রকাশ করেন।
কাজী আনোয়ার হোসেন বিখ্যাত গায়িকা ফরিদা ইয়াসমিনকে বিয়ে করেন। তাদের তিন সন্তান হলেন- ছেলে কাজী মাইমুর হোসেন, কাজী শাহনূর হোসেন ও মেয়ে শাহরিন সোনিয়া।
বাংলা সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য কাজী আনোয়ার হোসেন ১৯৭৯ সালে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, ১৯৭৪ সালে ‘মাসুদ রানা’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য ও সংলাপের জন্য বাচসাস পুরস্কার এবং ১৯৬৬ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান।
আরও পড়ুন: আওয়ামী লীগ নেতা জয়নাল হাজারী আর নেই
২ বছর আগে