নিউইয়র্ক সিটি ফ্যাশন উইক
নিউইয়র্ক সিটি ফ্যাশন উইকে ট্রান্স মডেল হিসেবে বাংলাদেশের তাসনুভা আনান শিশির
বাংলাদেশের প্রথম ট্রান্সজেন্ডার সংবাদ পাঠিকা তাসনুভা আনান শিশির এবার ট্রান্স মডেল হিসেবে হেঁটে গেলেন নিউইয়র্ক সিটি ফ্যাশন উইকের র্যাম্প ধরে। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত এই শো’টিতে অংশগ্রহণের সৌভাগ্য অর্জন করেন তাসনুভা। তার ক্যারিয়ারের অগ্রগতিটা আর দশটা সফল মানুষের মত নয়। শত শত উপহাসের সয়লাবের পর প্রথম নিউজ রুমের চেয়ারে বসাটা ছিলো স্বপ্নের মত। আর আমেরিকার মত একটি দেশ থেকে এত বড় একটি প্রাপ্তি মহিমান্বিত করেছে তাসনুভা আনানের অস্তিত্বকে। চলুন, তার এই অসামান্য প্রাপ্তির পাশাপাশি জেনে নেই তার জীবনের গল্প।
একজন তাসনুভা আনান শিশির-এর গল্প
১৯৯১ সালের ১৬ জুন; খুলনার বাগেরহাটে জন্ম নেয়া শিশুটির নাম রাখা হয় কামাল হোসেন। উচ্চ-মাধ্যমিকের গন্ডি পেরোনোর আগেই কামাল নিজের চলাফেরা ও বেশভূষার পুরোটা জুড়ে নারীত্বের উপস্থিতি টের পেতে শুরু করেন। এ নিয়ে আশেপাশে অনেক কথাবার্তাও রটতে থাকে। এক সময় বাবা-মার সম্মানের কথা ভেবে ঘর ছাড়তে হয় কামাল হোসেনকে।
বাগেরহাট থেকে নারায়ণগঞ্জে এসে সেখানকার সরকারি তোলারাম কলেজে সমাজকর্ম নিয়ে পড়াশোনা করেন। সেখান থেকে অনার্স ও মাস্টার্স-এর পর ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ থেকে জনস্বাস্থ্য বিষয়ের উপর এক বছরের আরও একটি মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করেন। এই পুরো সময়টাতে নারী বেশে নিজেকে সমাজের সামনে মেলে ধরেছেন কামাল হোসেন। অতঃপর ২০১৬ সালের শেষের দিকে চূড়ান্তভাবে মনস্থির করে ফেলেন। কলকাতায় চিকিৎসকের পরামর্শে শারীরিকভাবে কামাল হোসেন থেকে পরিণত হন তাসনুভা আনান শিশিরে।
আরও পড়ুন: টাইম ম্যাগাজিনের বর্ষসেরা ছবিতে তাসনুভা আনান শিশির
এরপর ক্যারিয়ার নিয়ে সংগ্রাম মুখর জীবনের এক পর্যায়ে পরিচয় হয় প্রখ্যাত নাট্য পরিচালিকা চয়নিকা চৌধুরীর সাথে। আর এই পরিচয়ের রেশ ধরেই তার সুযোগ মেলে বৈশাখী টিভি'র নিউজ রুমে প্রবেশের।
নিউইয়র্ক সিটি ফ্যাশন উইকে তাসনুভা আনান শিশির
সেরা বাংলাদেশি সংবাদ উপস্থাপিকার পুরস্কার নিতে তাসনুভা উত্তর আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন শো টাইম মিউজিকের আমন্ত্রণে। তখনি খবর পান নিউইয়র্ক সিটি ফ্যাশন উইকের। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি ও সেপ্টেম্বর মাসে নিউ ইয়র্ক সিটির ম্যানহাটন শহরে বসে এই আন্তর্জাতিক আসর।
বিশ্বনন্দিত ইভেন্টটির স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার ওমর চৌধুরী এবং ফোর এএম টিভি ইউএসএ-এর নির্বাহী প্রযোজক আরিফুল ইসলাম তাসনুভা আনানকে আমন্ত্রণ জানান অতিথি হিসেবে র্যাম্পে অংশ নেয়ার জন্য। আমেরিকায় শিশিরের ওয়ার্ক-পারমিট না থাকায় তাকে অতিথি হিসেবে পারফর্ম করার আমন্ত্রণ জানানো হয়।
আরও পড়ুন: সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর: ভারতীয় সংগীতের জগতে অবিস্মরণীয় উজ্জ্বল নক্ষত্র
তজ, ফোর এএম টিভি ইউএসএ ফ্যাশন এবং মিউজিকপেস আয়োজিত ‘প্লিৎজ নিউইয়র্ক সিটি ফ্যাশন উইক’ শিরোনামের আয়োজনটির প্রযোজনায় ছিলো প্লিৎজ্স্ ফ্যাশন মার্কেটিং। বিভিন্ন দেশের মডেলদের সঙ্গে সেখানে প্রথম বাংলাদেশি ট্রান্স মডেল হিসেবে অংশ নেন তাসনুভা আনান শিশির।
তার পরনে ছিলো বিখ্যাত পোশাক ডিজাইনার অস্কার গঞ্জালেজ মন্টানিজ-এর ডিজাইনকৃত পোশাক।
ভালোবাসা দিবসকে কেন্দ্র করে পোশাকের থিম নির্ধারণ করা হয়েছিলো। রঙের ক্ষেত্রে বাছাই করা হয়েছে সাদা, কালো আর লাল রঙকে। ইভেন্টের দিনে তাসনুভা পড়েছিলেন দুটি পোশাক; একটা গাউন আরেকটা শীতকালের হুডি।
আরও পড়ুন: রাজু ভাস্কর্যের সামনে নৃত্যরত ইরা: সপ্রতিভ উত্থানে এক বাংলাদেশি ব্যালেরিনা
স্টেরিওটাইপ সমাজের শিকল ভাঙার আদর্শ তাসনুভা শিশির
ট্রান্স নারীতে রূপান্তরের পর জীবনটা আরও বেশি সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছিলো তাসনুভার জন্য। কৈশোরে ছেলেদের মতো চলাফেরা করে টিউশনি ও নৃত্য সহ অন্যান্য কাজ চালিয়ে নেয়া যেতো। কিন্তু এখন আর সে সুবিধা নেই। কিছুদিন ভয়েস আর্টিস্ট হিসেবেও কাজ করেছিলেন। এবার সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। এক সময় এমন হয় যে, কোন প্রোগ্রাম থেকেই আর ডাক পাওয়া যাচ্ছে না।
এরপরেও তীব্র পরিশ্রম আর অধ্যবসায়-এ নতুন সূর্যোদয় ঘটে তাসনুভার জীবনে। দেখা না হলেও অসুস্থ বাবা-মার ভরণপোষন করছেন তাসনুভাই। অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা বাড়িতে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা তুলে দিলেও আশেপাশের মানুষের কটুকথার ভয়ে এখনও তিনি বাড়িমুখী হন না।
তার অন্য চার বোন আর এক ভাইয়ের সাথে ঠিকমত কথা হয় না। বোনেরা সবাই সংসার-বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত। তাদের সঙ্গে বছরে দুয়েক মিনিট কথা হলেও এড়িয়ে যেতে হয় পরস্পরের ঠিকানা ভাগ করে নেয়ার ব্যাপারটা।
আরও পড়ুন: বাঁধাধরা নিয়ম ভেঙে নতুন উচ্চতায় তাসনুভা আনান শিশির
ছেলেবেলায় বন্ধ হয়ে যাওয়া নৃত্য চর্চা এখন আবার শুরু করেছেন। অভিনয় করেছেন ‘কসাই’ নামক একটি সিনেমায়। বিভিন্ন স্বনামধন্য ব্র্যান্ডের সঙ্গে কাজ করছেন। নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছেন সকল প্রতিবন্ধকতাকে ডিঙিয়ে সময়কে জয় করার লক্ষ্যে।
এখন তাসনুভা আনান শিশির-এর দেখানো পথ ধরে ভাগ্য ফিরছে আরও ট্রান্সজেন্ডারদের। নতুন করে জীবন নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন যুগ যুগ ধরে হাজারো অবজ্ঞায় অবদমিত হয়ে থাকা মানুষগুলো। তাসনুভার এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি শুধু এই নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের জন্যই আশার আলো দেখাচ্ছে না, গোটা দেশের জন্য এক বিপুল অর্জন হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে। সেই নিরিখে যে যুগান্তকারি বিষয়টি উঠে আসে, তা হলো- শ্রেণী, ধর্ম, বর্ণ, ও গোষ্ঠী কোন মানুষের পরিচয় ও সম্মানের নির্ণায়ক হতে পারে না।
আরও পড়ুন: ‘মাসুদ রানা’র লেখক-প্রকাশক কাজী আনোয়ার হোসেন আর নেই
২ বছর আগে