ভয়াল কালরাত
২৫ মার্চ ১৯৭১: গণহত্যা দিবসে ফিরে দেখা ইতিহাসের এক ভয়াল কালরাত
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংসতম অধ্যায়। এই গণহত্যা স্মরণ দিবস-এর সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে বাঙালির অস্তিত্ব। পাক হানাদার বাহিনীর জিঘাংসার শিকার শত শত নিরপরাধ মানুষের প্রতিধ্বনিত আর্তনাদের পরাকাষ্ঠায় রচিত হয়েছিলো স্বাধীনতার ঘোষণা। গ্রামের মেঠোপথ থেকে শুরু করে শহুরে পিচঢালা রাস্তা পরিণত হয়েছিলো মুক্তিযুদ্ধের মঞ্চে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে বাংলার এই মাটি পেয়েছে বিস্তর পরিবর্তনের ছোঁয়া। এরপরও এতে মিশে থাকা সেই আর্তনাদ বারবার মনে করিয়ে দিয়ে যায় স্বাধীনতার মূল্যের কথা। চলুন, ফিরে যাওয়া যাক ১৯৭১ এর সেই ঐতিহাসিক দিনটিতে।
অপারেশন সার্চলাইট, ২৫ মার্চ, ১৯৭১
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাত থেকে পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করার প্রয়াসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত পরিকল্পিত সামরিক অভিযানের সাংকেতিক নাম অপারেশন সার্চলাইট। পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে মূল পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এই রাত থেকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান শহরগুলোতে কার্ফিউ জারি করা হয়। অভ্যন্তরীণ সব সাধারণ যোগাযোগের মাধ্যমগুলো বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়।
রাত সাড়ে ১১টায় পাকিস্তানি সৈন্যরা সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে এসে ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় বিক্ষোভকারী বাঙালিদের ওপর নির্বিচারে আক্রমণ চালায়। এটি ছিল অপারেশন সার্চলাইটের প্রথম হামলা। এরপর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পিলখানা ও রাজারবাগে একযোগে হামলা করা হয়।
আরও পড়ুন: জাতীয় গণহত্যা দিবস পালিত হবে শুক্রবার
পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ঢাকা শহরে ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস)-এর বাঙালি সদস্য এবং পুলিশ, ছাত্র-শিক্ষকসহ হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু ছাত্রাবাস জগন্নাথ হল এবং ইকবাল হল (বর্তমান শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল), পিলখানা, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস এবং পুরান ঢাকার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা ছিল অভিযানের মূল লক্ষ্য।
ট্যাঙ্ক, অটোমেটিক রাইফেল, রকেট লঞ্চার, ভারী মর্টার, এবং মেশিনগানের মতো ভারী অস্ত্রে সজ্জিত পাক সেনারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। রাত ১২টার পর সেনাবাহিনী মর্টারের গোলা ও অবিরাম গুলিবর্ষণের মাধ্যমে জগন্নাথ হলে হামলা চালায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এই রাতে দখলদার বাহিনী পরিকল্পিতভাবে ঘুমন্ত ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মচারীদের হত্যা করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধানমন্ডিতে তাঁর ৩২ নম্বর রোডের বাসভবন থেকে ইপিআর ওয়ারলেসের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তার কিছু পরেই তিনি সামরিক জান্তার হাতে গ্রেপ্তার হন।
সে রাতে দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ এবং পিপলের মতো জাতীয় সংবাদপত্রের কার্যালয়গুলোতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। বিপুল সংখ্যক শীর্ষ সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীকে কার্যালয়ের ভেতরেই পুড়িয়ে মারা হয়। কালী মন্দির এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার মাটিতে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। এমনকি রাজপথের সাধারণ নাগরিকও বাদ যায়নি এই চরম জিঘাংসা থেকে। রিকশার হুড তুলে সিটে শুয়ে থাকা চালকদের ঘুমের মধ্যেই গুলি করে হত্যা করা হয়।
অপারেশন সার্চলাইট-এর নীল নকশা
১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বৈঠকে ২৫ মার্চকে সামনে রেখে করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিদ্ধান্তগুলোর বাস্তবায়ন স্বরূপ পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটা থেকে ষোড়শ পদাতিক ডিভিশন এবং খারিয়ান থেকে নবম ডিভিশনকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।
পরিকল্পনা কার্যকর করার আগে পূর্ব পাকিস্তানের সিনিয়র পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারদের মধ্যে যারা বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সামরিক আক্রমণে সমর্থন করেননি, তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও জিওসি (জেনারেল অফিসার কমান্ডিং) হন। ১৭ মার্চ মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান টেলিফোনের মাধ্যমে অপারেশন পরিকল্পনা করার ক্ষমতা প্রদান করেন। অতঃপর ১৮ মার্চ সকালে ঢাকা সেনানিবাসের জিওসি অফিসে অপারেশন সার্চলাইনের একটি খসড়া তৈরি করা হয়। খসড়াটি তৈরি করেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী এবং ১৪তম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা।
আরও পড়ুন: জাতীয় গণহত্যা দিবস আজ
১৬ অনুচ্ছেদের মোট পাঁচ পৃষ্ঠার পরিকল্পনাটিতে অপারেশন সফল করতে করণীয় এবং দায়িত্বরত ইউনিটগুলোর কাজের বণ্টন স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ ছিলো।
হাতে লেখা পরিকল্পনাটি জেনারেল আবদুল হামিদ খান এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ২০ মার্চ ফ্ল্যাগস্টাফ হাউসে পর্যালোচনা করেছিলেন। জেনারেল আবদুল হামিদ খান নিয়মিত সেনা বাঙালি ইউনিটের অবিলম্বে নিরস্ত্রীকরণে আপত্তি জানালেও ইপিআর, সশস্ত্র পুলিশ এবং অন্যান্য আধা-সামরিক বাহিনীকে নিরস্ত্র করার অনুমোদন দেন। ইয়াহিয়া খান তার সঙ্গে বৈঠকের সময় আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেপ্তারের অনুমোদন দিতে অস্বীকার করেন। পরিকল্পনা চূড়ান্ত হওয়ার পর বিভিন্ন এরিয়া কমান্ডারদের কাছে বিতরণ করা হয়।
ঠিক হয় ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঢাকায় অপারেশন শুরু হবে। সেই সাথে অন্যান্য গ্যারিসনকে তাদের কার্যক্রম শুরু করার জন্য ফোনের মাধ্যমে জানানো হবে। ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইটের নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল ফরমান আলী। বাকি প্রদেশের দায়িত্বে ছিলেন জেনারেল খাদিম। লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এবং তার কর্মীরা ৩১তম ফিল্ড কমান্ড সেন্টারে উপস্থিত থেকে ১৪-তম ডিভিশনের কমান্ড স্টাফদের তত্ত্বাবধান করছিলেন। ২৫ মার্চ দিবাগত রাত ঠিক ১টায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের জন্য ৪০ জনের ৩টি কমান্ডো ব্যাটালিয়ন নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল জেড এ (জিয়াউল্লাহ) খান।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রির নেপথ্যের ঘটনা
১৯৭০ সালের পাকিস্তান সংসদীয় নির্বাচনে বাঙালি আওয়ামী লীগ নির্ণায়ক সংখ্যাগরিষ্ঠ জয়লাভ করার পর, বাঙালি জনগণ ছয় দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের কাছে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তর আশা করেছিল। ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ তারিখে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চাপে পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান মার্চের জন্য নির্ধারিত জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিত করেন। পিপিপি ইতিমধ্যেই শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থানকে দুর্বল করার জন্য লবিং শুরু করেছিল। স্থগিতকরণের প্রতিক্রিয়া হিসাবে আওয়ামী লীগ অসহযোগের আন্দোলনের ডাক দেয়। ফলে পাকিস্তান সরকারের কর্তৃত্ব পূর্ব পাকিস্তানের শুধু সামরিক সেনানিবাস এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
বাঙালি এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমর্থক বিহারীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান মার্চ মাসে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন এবং পরে ভুট্টোর সাথে যোগ দেন।
আরও পড়ুন: চট্টগ্রাম গণহত্যা দিবস : ৩১ বছরেও বিচার পাননি ভুক্তভোগীরা
অধিকাংশ পশ্চিম পাকিস্তানি জেনারেলরা পিপিপিকে সমর্থন করেছিলেন। কারণ তাদের ভয় ছিলো যে পূর্ব পাকিস্তান ক্ষমতায় এলে বহুজাতিক পাকিস্তানি ফেডারেশন ধ্বংস হয়ে যাবে। এই অসমর্থনের সূত্র ধরে অবশেষে পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্রোহী বাঙালিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
অন্য দিকে মার্চের শুরুতে চট্টগ্রামে বাঙালি-বিহারি দাঙ্গায় ৩০০ জনেরও বেশি বিহারি নিহত হয়। এই ঘটনার রেশ ধরে পাকিস্তান সরকার অপারেশন সার্চলাইটকে ন্যায্যতা দেয়ার জন্য এই সামরিক হস্তক্ষেপের নেপথ্যে প্রতীতি হিসেবে ‘বিহারি গণহত্যা’ শব্দ দুটি ব্যবহার করেছিলো।
২৫ মার্চ গণহত্যার প্রতিক্রিয়া
অপারেশন সার্চলাইটের পদ্ধতিগত গণহত্যা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। এরই অঙ্কুরে সূত্রপাত ঘটে স্বাধীনতা যুদ্ধের। পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত পশ্চিম পাকিস্তানের অনুগতদের মিলিশিয়া গঠনে শুরু হয়ে যায় গৃহযুদ্ধ। অবশ্য পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিযোদ্ধাদের বিপক্ষে তারা শেষমেশ টিকতে পারেনি। অন্য দিকে সামরিকভাবে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে ভারত। মোড় ঘুরতে শুরু করে যুদ্ধের প্রেক্ষাপটের। অবশেষে ভারতীয় বাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তান নিঃশর্ত ভাবে আত্মসমর্পণ করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর।
পরিশিষ্ট
স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও কোটি বাঙালির চেতনায় অমলিন হয়ে আছে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তারিখটি। সেদিনের পর থেকে ৫০টি ২৫ মার্চ শুধুমাত্র নিছক কোনো সংখ্যা বা তারিখ নয়। এ হলো- এক পা, দু’পা করে হোচট খেতে খেতে শিশু বাংলাদেশের বেড়ে ওঠা। এই গণহত্যা দিবস এবং ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি ত্যাগ-তিতিক্ষার একটাই দাদি- লাখো শহীদের রক্তে পাওয়া এই স্বাধীনতাকে যে কোনো মূল্যে রক্ষা করা।
২ বছর আগে