আশফাক নিপুণ
‘ফাইনেস্ট সিরিজ ডিরেক্টর’ আশফাক নিপুণ
শিল্পকর্মে যখন সময়কে আঁকা হয় তখন তা নাকি বহু বছর টিকে যায়। নির্দিষ্ট এক সময়ের সাক্ষী হয়ে থাকে সেই কাজ। আশফাক নিপুণ নির্মিত ‘মহানগর’ সিরিজটিকে ঠিক তেমনই একটি কাজ বললে পাঠকরা হয়তো দ্বিমত করবেন না।
ওটিটির জোয়ারে যখন বাংলাদেশের নির্মাতারা সিরিজ তৈরি করতে শুরু করলেন সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জনপ্রিয় সিরিজের তালিকার শীর্ষে রয়েছে ‘মহানগর’।
২০২১ সালের ৫ জুন ‘হইচই’-তে মুক্তি পায় ‘মহানগর ১’। ঠিক এই সিরিজ দিয়ে যে আশফাক নিপুণকে দর্শক চিনেছে ঠিক তা কিন্তু নয়। এই নির্মাতা তার নাটক ও টেলিফিল্ম দিয়ে এর আগেই তাকে চিনিয়েছেন। তাকে পরিচিত করে তুলেছে তার গল্প বলার এক ভিন্ন ঢং। তার বিভিন্ন সাক্ষাৎকার বা ফেসবুক প্রোফাইল থেকে কিছুটা হলেও বোঝা যায় নিজের দর্শন ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখার অভিজ্ঞতা তার প্রতিটি কাজে তুলে আনার চেষ্টা করেন।
এই চেষ্টা সাহসিক এক জায়গায় তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ‘মহানগর’ সিরিজ। ২০ এপ্রিল একই ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পেল সিরিজের দ্বিতীয় সিজন। আমাদের মহানগরে রাত-দিনের পার্থক্যটা অনেক না হলেও কিছু সংখ্যক সাধারণ মানুষের জানা আছে। আশফাক নিপুণ তার এক রূপ এঁকেছেন সিরিজের দুই সিজনে।
আরও পড়ুন: রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার শিকার সবচেয়ে বেশি হয় নারীরা: আশফাক নিপুণ
‘মহানগর’ সিরিজের মূল চরিত্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংলাপ, ‘দুইটা কথা মনে রাখবেন, ক্রিমিনাল আর টাকা যদি থাকে নসিবে আপনে আপনে আসিবে’। আশফাক নিপুণ এক রেডিও অনুষ্ঠানে বলছিলেন মূল চরিত্রে তিনি মোশাররফ করিম ছাড়া কাউকে চিন্তা করতে পারেননি। যদি শিডিউল সমস্যা হতো, তাহলে তিনি অপেক্ষা করে হলেও মোশাররফ করিমকে চাইতেন।
সিরিজটি যারা দেখেছেন, তাদেরও হয়তো এমনটা মনে হওয়ার কথা। মোশাররফ করিম এদেশের ঝিনুকের মধ্যে মুক্তা। চরিত্রের মাঝে তিনি যেভাবে মিশে যান সেখান থেকে চোখ ফেরানো যায় না।
পুরো ‘মহানগর’ সিরিজের দুটি সিজনে ঢাকা মহানগরে রাতের ঘটনাগুলো উঠে এসেছে। ঢাকা মহানগরের কোতোয়ালি থানার ওসি হারুণ এই গল্পের নায়ক। যদিও তিনি নায়ক নাকি ভিলেন সেই দ্বিধায় পড়তে হয় কয়েকবার।
‘মহানগর ১’ শেষ হয় ওসি হারুণকে গ্রেপ্তার করার ঘটনায়। এরপরই তাকে নেওয়া হয় অজানা এক জায়গায়। দীর্ঘক্ষণ চলে জিজ্ঞাসাবাদ। যেখান থেকে শুরু ‘মহানগর ২’। এই পর্বে এমন আরও একজন অভিনেতা যোগ হয়েছেন যিনি অভিনয় দিয়ে দর্শক কাঁদাতে পারেন। বলছিলাম ফজলুর রহমান বাবুর কথা।
ওসি হারুণকে জিজ্ঞসাবাদের প্রধান হিসেবে থাকেন তিনি। এরপর সেই অজানা জায়গায় কাটে ওসি’র আরও একটি রাত। এই জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যে উঠে আসে পেছনের এক গল্প। সেখানে রয়েছেন দর্শকদের জন্য আরও এক চমক। আর যাকে দেখে চোখ আটকে যাবে তিনি আফসানা মিমি। দ্বিতীয় সিজনে নতুন আরও একটি পরিচিত মুখ রয়েছেন অভিনেত্রী তানজিকা আমিন।
সিরিজের প্রতিটি চরিত্রের যে আশফাক নিপুণ যত্ন নিয়েছেন সেটি দেখলে বোঝা যায়। খুবই অল্প সময়ের জন্য পর্দায় থাকা চরিত্রগুলোকেও তিনি অবহেলা করেননি। এই বিষয়গুলো তার পেশদারিত্বের ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয়।
আরও পড়ুন: ঈদ উপলক্ষে হইচই’র পর্দায় ‘মহানগর-২’
এদেশে সিরিজের সিক্যুয়াল দিয়ে বাজিমাত করতে পেরেছে এমন কেউ ‘মহানগর ২’ এর আগে পর্যন্ত ছিল না। কিন্তু এই দ্বিতীয় সিজন যেন প্রথম সিজনকেও ছাড়িয়ে গেছে। গল্পের বুনন, সংলাপ, চরিত্রগুলোর এক্সপ্রেশন সবকিছুই এতটা যত্ন নিয়ে নিপুণ সাজিয়েছেন তাকে এদেশের ‘ফাইনেস্ট সিরিজ ডিরেক্টর’ বললে মনে হয় খুব একটা বেশি বলা হবে না।
একটি সিরিজের প্রথম সিজন যখন ব্যাপক জনপ্রিয় হয়, পরেরটার জন্য প্রেশার আর চ্যালেঞ্জ কয়েক গুণ বেড়ে যায়। সেই চাপ সামলে নিয়েছেন আশফাক নিপুণ। মাঝে এক বছর চলে গেলেও তিনি ধৈর্য্য ধরেছেন। তার ফলও পেয়েছেন। তাই ঈদের আনন্দটাও বেড়ে গেল কয়েক গুণ।
‘মহানগর ২’ এর বর্তমান গল্পের সঙ্গে দুই বছর আগের এক গল্প নিয়ে পুরো সিরিজ এগিয়ে যায়। একই ফ্রেমে দুই সময়ের গল্প ঠিকঠাক বলতে পারাটাও মুন্সিয়ানার বিষয়। নাহলে অনেক সময় চোখে দর্শক দ্বিধায় পড়ে যায়। সেই কাজটিও ঠিকঠাক করেছেন নিপুণ।
সিরিজের ডিআই কালার ও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক আলাদা করে প্রশংসার দাবি রাখে। যা সিরিজটি আবহ স্ক্রিনে আরও জীবন্ত করে তুলেছে।
সিরিজের শেষটায় যা হয়েছে সেটিই সবচেয়ে তাক লেগে যাওয়ার অবস্থা তৈরি করেছে। সঙ্গে কলকাতার অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্যের প্রবেশ তৃতীয় সিজনের এক ইঙ্গিত রেখে শেষ হয় ‘মহানগর ২’। যেহেতু আশফাক নিপুণ তার অন্য এক সিরিজ ‘সাবরিনা’র সিক্যুয়াল ও অন্য কাজ নিয়ে ব্যস্ততা রয়েছেন, তাই হয়তো ‘মহানগর ৩’ এর জন্য দর্শকের অপেক্ষাটা দীর্ঘ হবে।
তবুও আশফাক নিপুণ সময়ের গল্প বলে যাক।
আরও পড়ুন: প্রথমবার চরকি অরিজিনাল সিনেমায় মোশাররফ করিম
১ বছর আগে
রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার শিকার সবচেয়ে বেশি হয় নারীরা: আশফাক নিপুণ
ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘হইচই’-এ সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে ‘সাবরিনা’। ৮ পর্বের এই ওয়েব সিরিজকে নারীকেন্দ্রিক গল্প বলা হলেও এতে উঠে এসেছে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিত্র। দুই নারীর গল্পের মধ্য দিয়ে যা দেখানো হয়েছে। ইউএনবির সঙ্গে আলাপকালে এ নিয়ে কথা বলেন ওয়েব সিরিজটির নির্মাতা আশফাক নিপুণ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মোস্তাফিজ মিঠু
‘সাবরিনা’র গল্পের পাশাপাশি আপনার লোকেশন নির্বাচনও বেশ প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু শুটিং ঠিক কোথায় করেছেন সেটি জানা যায়নি। এ নিয়ে শুরুতে জানতে চাইব।
লোকেশনের বিস্তারিত আমি ইচ্ছে করেই জানাতে চাইনা। কারণ যখন আমরা স্ক্রিনে কোন দৃশ্য দেখি, তার লোকেশনও আমাদের আন্দোলিত করে। পরিচিত হলে কানেক্ট করে কোথাও, অপরিচিত হলে উৎসুক করে। যদি বলেই দেই কোথায় কোথায় শ্যটিং করেছি তাহলে সেই আগ্রহ শেষ হয়ে যায়। আমরা মেট্রোপলিটান শহরের আবহের বাইরে গিয়ে একটি গল্প দেখাতে চেয়েছি। তাই ঢাকার বাইরে দূরে কিছু লোকেশনে আমরা ২১ দিন শুটিং করেছি।
ওয়েব সিরিজটিকে শুরু থেকেই শুধু নারীকেন্দ্রিক গল্প বলা হচ্ছে। যদিও আপনি পুরো গল্পে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন। তাহলে কী কেন্দ্রিয় চরিত্রে নারী কাস্টিং থাকায় এমনটা হয়েছে?
গল্পটা আসলে সাবরিনাকে নিয়েই। এখানে মূল যে দুটি চরিত্র তারা নারী এবং তারাই কেন্দ্রীয় চরিত্র। নামকরণও তাই করা হয়েছে ‘সাবরিনা’। তবে আমি যখন গল্প বলি, সেটি ‘মহানগর’ ওয়েব সিরিজ হোক বা টেলিভিশনে শেষ যে কয়টি কাজ করেছি সেখানেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার প্রতিফলন রাখার চেষ্টা ছিল সবসময়। সেই জায়গা থেকে ‘সাবরিনা’তে দুই নারীর গল্পের মাধ্যমে দেশের বর্তমান সামাজিক রাজনৈতিক চিত্র তুলে ধরেছি। একটা দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার শিকার সবচেয়ে বেশি হয় নারীরা। অতি সম্প্রতি টিপ পরা নিয়েও একজন নারী হেনস্থার শিকার হয়েছেন। পুরো বিষয়টাই আসলে রাজনৈতিক। কখনো হয়তো ধর্মীয় রাজনৈতিক, কখনো সামাজিক রাজনৈতিক, আবার কখনো রাষ্ট্রীয় রাজনীতির শিকার আমরা। ‘সাবরিনা’ র পটভূমি এবং গল্পও তাই। আর এটি এখন পর্যন্ত আমার নির্মিত সবচেয়ে শক্তিশালী পলিটিক্যাল গল্প। আমি চেয়েছিলাম দর্শক নিজেই আবিস্কার করুক সেটা সিরিজ দেখতে দেখতে। তাই হয়েছে। দর্শকই বলছে সমকালীন রাজনৈতিক দুর্বিত্তায়নের প্রেক্ষাপটের মধ্য দিয়ে দুই নারীর এক শক্তিশালী গল্প ‘সাবরিনা’।
ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আসার পর আপনি দেশের গল্পে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট যেভাবে দেখাতে পারছেন, টেলিভিশনে এমনটা দেখাতে পারতেন?
অবশ্যই না। আমাদের এখানে টেলিভিশন পৃথিবীর অন্যান্য দেশের টেলিভিশনের মত স্বাধীনচেতা না। একটা ভয়ের সংস্কৃতি এখন অনেক বেশি চলমান। রাষ্ট্রীয় সেন্সরশীপ এর ভয়ে সেল্ফ সেন্সরশীপ জেঁকে বসেছে টেলিভিশনের মাঝেই। তাই মূলত সংবাদ আর নিছক বিনোদন নির্ভর কন্টেন্ট দিয়েই তাই চলছে টেলিভিশন। কারণ যেকোনো সময় যেকোনো কনটেন্টের ওপর রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক বাঁধা আসার আশঙ্কাও রয়েছে। এছাড়া টেলিভিশন এখন পুরোটাই স্পনসর নির্ভর। স্পনসররাও রিস্কি কন্টেন্টের চ্যালেঞ্জ নিতে চান না, ফাইন্যান্স করতে চান না। আর ওটিটির সুবিধা এটি দর্শককে সাবস্ক্রিপশন নিয়ে দেখতে হয়। এখানে দর্শক স্বেচ্ছায় টাকা খরচ করে এমন কিছু দেখতে চান যা ফ্রি মিডিয়ামে (টিভি, ইউটিউব) এ সে দেখতে পায় না। এখানে দর্শক প্রিমিয়াম কন্টেন্ট খোঁজে। তাই এখানে কানেক্ট করতে পারে এমন সাহসী এবং ভিন্ন ধরনের গল্পের চাহিদা বেশি।
মহানগর’-এর মতো ‘সাবরিনা’ও শেষ করলেন না। দ্বিতীয় সিজন নিয়ে কী পরিকল্পনা?
‘সাবরিনা’ নির্মাণের শুরু থেকেই এটি দ্বিতীয় সিজনের পরিকল্পনা করেই এগোনো। প্রথম সিজন ছিল সূত্রধরের মত। যে কয়টি গল্প দেখানো হয়েছে সবগুলো আরও খোলতাই করে পরবর্তীতে দেখা যাবে। আসলে একটা গল্পকে তো চাইলে যেকোন সময় শেষ করা যায়। ‘সাবরিনা’কেও হয়ত ৮ পর্বে শেষ করতে পারতাম। কিন্তু সেটা চাইনি আমি কারণ ‘সাবরিনা’র ব্যাপ্তি অনেক বড়। পরবর্তী সিজন এলে দর্শক সেটা আরও ভালো বুঝতে পারবেন। শিগগিরই দ্বিতীয় সিজনের গল্প লেখার কাজ শুরু করব।
ছোটপর্দায় এই ধরনের গল্প দেখার পর দর্শকদের মধ্যে আপনার সিনেমাও দেখার আগ্রহও তৈরি হয়েছে। সেই খবর কবে দিচ্ছেন?
আমার প্রথম সিনেমা ‘গোল্লা’ নিয়ে ২০১৯ থেকে কাজ শুরু করি। কিন্তু মহামারির কারণে এর সব পরিকল্পনা ওলোটপালট হয়ে যায়। ‘সাবরিনা’ পোস্ট প্রোডাকশনের কাজের সময় ‘গোল্লা’ নিয়ে আবারও পরিকল্পনা শুরু করি। এখন তো ‘মহানগর’ এবং ‘সাবরিনা’ দুটি সিরিজের দ্বিতীয় সিজনের কাজ বাকি। আরও কিছু ওটিটি কন্টেন্টের ব্যাপারেও কথা চলছে। দেখা যাক কবে নাগাদ পুরোপুরি সিনেমার কাজে হাত দিতে পারি।
আরও পড়ুন: স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ নাটক ‘নিহত নক্ষত্র’
ওয়েব দুনিয়ায় আফসানা মিমির অভিষেক
বিয়ে বাড়িতে হলো ‘গুণিন’ সিনেমার প্রিমিয়ার!
২ বছর আগে