ল্যাকটোজ
গরুর দুধের বিকল্প হিসেবে খেতে পারেন যেসব স্বাস্থ্যসম্মত খাবার
মানবদেহের ক্ষুদ্রান্ত্রে তৈরি হওয়া ল্যাকটেজ নামক পাচক এনজাইম দুগ্ধজাত খাবারের ল্যাকটোজ বা চিনিকে ভেঙে তা হজমের জন্য উপযোগী করে তোলে। অনেকের ক্ষেত্রে এই ল্যাকটেজ যথেষ্ট পরিমাণে তৈরি হয় না। ফলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় ল্যাকটোজ হজমে। ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স নামে পরিচিত হজমের এই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় পেট ব্যথা থেকে শুরু করে ডায়রিয়া পর্যন্ত হয়ে থাকে।
ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্ট ব্যক্তিরা গরুর দুধসহ দুধের তৈরি নানান ধরনের খাবারগুলো এড়িয়ে চলেন। এতে একদিকে বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা থেকে মুক্ত থাকলেও অন্যদিকে তারা বঞ্চিত হন ক্যালসিয়ামের মতো অপরিহার্য পুষ্টিগুণ থেকে। কিন্তু দুধ ছাড়াও এমন কিছু ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার আছে যেগুলো সামগ্রিকভাবে দুধের পুষ্টির যোগান দিতে পারে। চলুন, গরুর দুধের সেই স্বাস্থ্যসম্মতো বিকল্পগুলোর ব্যাপারে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
প্রাপ্তবয়স্কদের ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণে গরুর দুধের ১০টি উৎকৃষ্ট বিকল্প
বীজ জাতীয় বা দানাদার খাবার
নিয়মিত শরীর চর্চায় শণ, তিল, চিয়া, সয়ার মতো বীজগুলো রীতিমতো সুপারফুড হিসেবে পরিচিত। তন্মধ্যে চিয়া বীজে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ অন্যগুলোর তুলনায় বেশি। এমনকি এই পরিমাণ বিভিন্ন দুগ্ধজাত দ্রব্যে থাকা ক্যালসিয়াম থেকেও বেশি।
আরও পড়ুন: কেক ও বিস্কুট খাওয়ার ক্ষতিকর দিক: বিকল্প কিছু স্বাস্থ্যসম্মত পুষ্টিকর খাবার
চিয়া বীজ ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ফাইবারের জন্যও সুপরিচিত। এই বীজগুলোতে রয়েছে ফসফরাস এবং ম্যাগনেসিয়ামসহ সুস্থ হাড়ের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং খনিজ। দুই টেবিল চামচ চিয়া বীজে প্রায় ১.৭৯ গ্রাম ক্যালসিয়াম থাকে।
এক টেবিল চামচ তিলের বীজে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ প্রায় ০.৮৮ গ্রাম। তিলের বীজে আরও আছে স্বাস্থ্যকর চর্বি (বিশেষত পলিআনস্যাচুরেটেড এবং মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট), যা হৃদপিন্ডের কার্যকারিতায় অবদান রাখে। এছাড়াও তিলে আছে খনিজ, ভিটামিন, প্রোটিন, ফাইবার, ভিটামিন-ই ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট।
বীজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় সয়াবিন বা সয়া দিয়ে বানানো খাবারগুলো যেমন সয়ার দুধ ও দই। এ ধরনের ফোরটিফাইড বা সংরক্ষিত খাবারগুলো মূলত গরুর দুধে অ্যালার্জি থাকা লোকদের ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণেই তৈরি। রান্না করা সয়া খাবারের তুলনায় অপরিপক্ক কাঁচা বীজগুলোতেই ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকে।
আরও পড়ুন: ধানমন্ডিতে বুফে খেতে যেসব রেস্তোরাঁয় যেতে পারেন
দুধের উৎকৃষ্ট বিকল্প সুষম খাবার হিসেবে কাজ করতে পারে মটরশুঁটি। এই সবুজ বীজে আছে ভিটামিন এ, সি, কে, ফাইবার, আয়রন এবং ক্যালসিয়াম। এটি ভূমিকা রাখে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে, হিমোগ্লোবিন তৈরিতে, হৃদপিন্ডের সুস্থতা, ও চোখের জ্যোতি বাড়ানো সহ ওজন নিয়ন্ত্রণে।
বাদাম
প্রোটিন, ফাইবার ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ চিনা বাদাম, পেস্তা, আখরোট, কাঠ বাদাম এবং কাজু বাদাম শুধু স্বাস্থ্যকরই নয়; বেশ উপাদেয়। এছাড়াও অন্যান্য খনিজ যেমন ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, পটাসিয়াম, তামা এবং সেলেনিয়ামের পাশাপাশি আছে ভিটামিন ই, বি-২, ও ফোলেট। বাদামে থাকা উপাদান দীর্ঘমেয়াদে হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাসে অবদান রাখতে পারে।
এগুলোর মধ্যে ক্যালসিয়ামের অনুপাতে কাঠ বাদাম সবার থেকে এগিয়ে। এক আউন্স কাঠ বাদামে থাকে প্রায় ৭৬ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম।
আরও পড়ুন: প্যাকেটজাত আলুর চিপস কেন শরীরের জন্য ক্ষতিকর?
সয়া দুধের মতো বাদামের দুধও বেশ জনপ্রিয় একটি খাবার। সুষম খাবারের সঙ্গে মুখরোচক খাবারের সংমিশ্রণে বাদামের কোনও জুড়ি নেই। কম ক্যালোরি সম্পন্ন বাদাম দুধে গরুর দুধের তুলনায় কার্বোহাইড্রেট থাকে অনেক কম। ওজন ঠিক রাখার জন্য বেশ সুখ্যাতি থাকলেও এগুলো হাড়ের স্বাস্থ্য উন্নতিতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তবে যাদের বাদামে অ্যালার্জি আছে তাদের এই খাবারগুলোর ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
বাঁধাকপি
চর্বি, চিনি ও কোলেস্টেরল-মুক্ত এবং স্বল্প পরিমাণে সোডিয়াম ও ক্যালরি যুক্ত বাঁধাকপি দেহের প্রয়োজনীয় খনিজ উপাদানের সেরা উৎস। দুই কাপ কাঁচা বাঁধাকপিতে ক্যালসিয়াম থাকে প্রায় ১.৮ গ্রাম। অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর এই সবুজ সবজি কোষ প্রাচীরের ক্ষয়কে বিলম্বিত করতে পারে।
অন্যান্য উদ্ভিজ্জ খাবারের ন্যায় বাঁধাকপিতেও আছে অক্সালেটের মতো যৌগ, যেগুলো ক্যালসিয়াম শোষণে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। তাই এই অক্সালেটের পরিমাণ হ্রাস করার জন্য বাঁধাকপি ভালোভাবে রান্না করে নেওয়া উচিৎ। রান্না ছাড়া সেদ্ধ করে প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় সালাদ হিসেবেও রাখা যেতে পারে।
আরও পড়ুন: নিরাপদ ব্রয়লার মুরগি কী, কেন খাবেন
ব্রকলি বা সবুজ ফুলকপি
একই গোত্রভুক্ত উদ্ভিদ হওয়ায় বাঁধাকপির মতো ফুলকপিও ভিটামিন, খনিজ ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ। বিপাকের সময় শরীরে নানা ধরনের ফ্রি র্যাডিকেল নামক জৈব অণু তৈরি হয়। খুব বেশি পরিমাণে এই ফ্রি র্যাডিকেল এতটাই বিষাক্ত যে তা কোষের ক্ষতি সাধন করে ক্যান্সারের দিকে ধাবিত করতে পারে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এই জৈব অণুগুলোর পরিমাণকে মাত্রা ছাড়াতে দেয় না।
দেহের শক্ত হাড়ের জন্য ক্যালসিয়ামের সঙ্গে এক হয়ে কাজ করে কোলাজেন। এই কোলাজেন তৈরিতে প্রয়োজন হয় ভিটামিন সি। রক্ত জমাটের পাশাপাশি হাড়ের গঠনে কাজ করে ভিটামিন কে। আর এই ক্যালসিয়াম, ভিটামিন সি ও কে সবই থাকে ব্রকলিতে। এক কাপ হিমায়িত ব্রকলিতে প্রায় ০.৮৭ গ্রাম ক্যালসিয়াম থাকে।
ছোট মাছ
মানবদেহের কাঠামোকে সুদৃঢ় করে রাখে হাড়গুলো, আর এই হাড়ের দৃঢ়তা প্রদানের দরকারি উপাদান রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ছোট মাছের মধ্যে। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর ছোট মাছ আর দুধ একই পরিমাণে ক্যালসিয়ামের যোগান দেয়।
আরও পড়ুন: কাঁসা, পিতল ও তামার তৈজসপত্র ব্যবহার কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মত, বিজ্ঞান কী বলে?
ছোট মাছে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ গ্রাম প্রতি ৮.৬ থেকে ১ হাজার ৯০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়াও রয়েছে ভিটামিন এ, আয়রন এবং জিঙ্ক, যেগুলো দৃষ্টি শক্তি বৃদ্ধি ও রক্তের সুস্থ পরিচলনে অবদান রাখে। গ্রামে ও শহরে অধিক বিক্রিত ছোট মাছগুলোর মধ্যে পুটি, কাচকি, মলা-ঢ্যালা ও দারকিনা অন্যতম।
মিষ্টি আলু
তিন বেলা খাবারে সঙ্গে মিষ্টি আলুর সংযোজন হতে পারে প্রতিদিনের সর্বোচ্চ পুষ্টির নিশ্চয়তা। একটি বড় মিষ্টি আলু খাওয়া মানে প্রায় ০.৬৮ গ্রাম ক্যালসিয়াম শরীরে প্রবেশ করা। কম ফ্যাটযুক্ত এই সবজিতে আছে ভিটামিন সি, এ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ফাইবার। এই পুষ্টিগুলো বার্ধক্যজনিত প্রভাবগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে, ক্যান্সার প্রতিরোধে এবং দৃষ্টিশক্তি উন্নত করতে উপযোগী।
সরিষা শাক
শাক-সবজি ভিত্তিক খাদ্যাভ্যাস পরিচালনার শুরুটা হতে পারে সরিষা শাক দিয়ে। থায়ামিন (বি-১) নিয়াসিন (বি-৩) এবং পাইরিডোক্সাইন (বি-৬) সহ বি ভিটামিনের এক বিরাট উৎস এই শাক। এরা মূলত হৃৎপিণ্ড এবং মস্তিষ্কের কার্যকারিতায় কাজ করে। তবে সরিষায় থাকা ভিটামিন কে অংশ নেয় হাড়ের শক্তি বৃদ্ধি করতে এবং ফ্র্যাকচার থেকে রক্ষা করতে। কাটাছেড়ার সময় ধমনীতে ক্যালসিয়ামের প্রাচীর গড়ে রক্তক্ষরণ রোধ হয়। এই প্রাচীর গড়াতে যেন কোনো বাধা সৃষ্টি না হয় তার জন্য প্রতিরোধের ব্যবস্থা করে ভিটামিন 'কে'।
আরও পড়ুন: নিপাহ ভাইরাস সতর্কতা: কাঁচা খেজুরের রস খাওয়ার ঝুঁকি
এক কাপ রান্না করা সরিষার শাকে ১.০৩ গ্রাম ক্যালসিয়াম থাকে। এর সঙ্গে বাঁধাকপি যুক্ত করে তৈরি খাবার দৈনিক ক্যালসিয়ামের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে পারে।
পালং শাক
দেশের সাধারণ উপাদেয় সবজি পালং শাকের প্রধান উপাদান ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, ভিটামিন এ, সি, কার্বোহাইড্রেট, ফাইবার, এবং পটাসিয়াম। প্রতি কাপ শাকে ২৫০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়ামের উপস্থিতি বিদ্যমান। দাঁত ও হাড়ের যত্নে প্রতিদিন খাবারের সঙ্গে পালং শাক রাখাই শ্রেয়।
এতে থাকা ভিটামিন কে হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষার পাশাপাশি শরীর যথাযথভাবে ক্যালসিয়াম শোষণ করতে পারছে কি না তা নিশ্চিত করে। কম ক্যালরি থাকায় এটি ওজন কমানোর জন্যও উপযুক্ত। এছাড়াও এই শাকে আছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষমতা, যেটি ডায়াবেটিসের মতো রোগের ক্ষেত্রেও সহায়তা করতে পারে।
আরও পড়ুন: অপরাজিতা ফুলের নীল চা: জাদুকরী স্বাস্থ্যগুণ, বানানোর পদ্ধতি
ঢেঁড়শ
বিস্ময়কর হলেও দুগ্ধজাত খাবারের ভালো একটি বিকল্প হচ্ছে ঢেঁড়শ। এক কাপ ঢেঁড়শে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ প্রায় ০ দশমিক ৮২ গ্রাম। এছাড়াও একটি সুষম খাবার হওয়ার জন্য যতটুকু পুষ্টি প্রয়োজন তার সবটুকুই আছে এতে। ভিটামিন সি, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ফোলেট এবং ফাইবারের এই উৎকৃষ্ট বাহক ব্যবহৃত হয় নিত্যদিনের তরকারিতে। এতে থাকা প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম এবং পটাসিয়াম সামগ্রিকভাবে শরীরিক সুস্থতা বজায় রাখে।
এর উপযোগীতার মধ্যে আরও রয়েছে বদ হজম দূরীকরণ, কোলেস্টেরলের মাত্রা কমানো, রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রদাহ-বিরোধী বৈশিষ্ট্য।
শুকনো ডুমুর
সুস্বাদু ফল ও মিষ্টি জলখাবারের ক্ষেত্রে ক্যালসিয়ামের একটি উপযুক্ত জৈব উৎস হচ্ছে ডুমুর। আধা কাপ শুকনো ডুমুর প্রায় ১.২১ গ্রাম ক্যালসিয়াম সরবরাহ করতে পারে। এছাড়া উচ্চ মাত্রায় ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম এবং ফসফরাসের উপস্থিতি হাড়ের রক্ষণাবেক্ষণে সম্মিলিত ভাবে কাজ করে।
আরও পড়ুন: খেজুর খাওয়ার উপকারিতা: সারাদিন রোযা রেখে ইফতারে কেন খেজুর খাবেন?
ডুমুর প্রাকৃতিকভাবেই মিষ্টি, তাই এতে আলাদা করে কোনও চিনি দেওয়া লাগে না। তাই চকোলেট, কেক এবং বিস্কুটে মতো প্রক্রিয়াজাত মিষ্টির ক্ষেত্রেও এটি একটি স্বাস্থ্যকর বিকল্প। এতে থাকা ভিটামিন এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান বার্ধক্যজনিত লক্ষণগুলো দূর করতে সহায়তা করে।
শেষাংশ
সর্বপরি, এই ১০টি খাবার গরুর দুধের বিকল্প হিসেবে একটি সুষম খাদ্যাভ্যাসের সহায়ক হতে পারে। বাদামসহ বীজ জাতীয় দানাদার খাবারের সাইড ডিশগুলোর যে কোনোটি যথেষ্ট নিত্যদিনের ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণে। এরকম হাল্কা নাস্তার তালিকায় দারুণ প্রতিস্থাপন হতে পারে শুকনো ডুমুর অথবা মিষ্টি আলু। দুপুর ও রাতের খাবারের সঙ্গে তরকারিতে রাখা যেতে পারে বাঁধাকপি, ফুলকপি, পালং শাক বা সরিষা শাক। এছাড়া ঢেঁড়শ কিংবা ছোট মাছ দিয়েও পরিপূর্ণ করা যেতে পারে প্রতিদিনের স্বাস্থ্যকর খাদ্যতালিকা।
সবমিলিয়ে, এই খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত হওয়া মানেই দীর্ঘ মেয়াদে সুস্থ জীবনের মাইলফলক রচনা।
আরও পড়ুন: শহরে রান্নার জন্য গ্যাসের চুলার সেরা কয়েকটি বিকল্প
১০ মাস আগে
ডায়রিয়া বা উদরাময়: কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উপায়
বাংলাদেশের মত ঘনবসতিপূর্ণ দেশে ডায়রিয়া রোগের ভয়াবহ রূপ নতুন নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ডায়রিয়া সংক্রমণ দেশজুড়ে শঙ্কার সৃষ্টি করছে। আইসিডিডিআরবি (আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ)-এর তথ্যানুসারে, বিগত নয় দিনে ভর্তি হওয়া ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা ১১ হাজার ১৬১ জন। কর্মকর্তাদের দাবি-প্রতিষ্ঠানটির ৬০ বছরের ইতিহাসে রোগীর এমন চাপ নজিরবিহীন। এমনকি হাসপাতালের বাইরেও তাঁবু টানিয়ে চিকিৎসা চলছে। বিশুদ্ধ পানির যথেষ্ট যোগান না থাকায় এবং অতি ব্যস্ততার ফলে বাসি খাবারের উপর নির্ভরশীলতা ডায়রিয়ার সংক্রমণ বাড়াচ্ছে। এমন সংকটাপন্ন সময়ে সতর্ক থাকতে চলুন, ডায়রিয়া রোগের ব্যাপারে বিশদ জেনে নেয়া যাক।
কী কী কারণে ডায়রিয়া হয়
ভাইরাস
ডায়রিয়া সংক্রমণে শক্তিশালী ভূমিকা রাখা ভাইরাসগুলোর মধ্যে রয়েছে নরোভাইরাস, অ্যাস্ট্রোভাইরাস, এন্টারিক অ্যাডেনোভাইরাস, ভাইরাল হেপাটাইটিস এবং সাইটোমেগালোভাইরাস। রোটাভাইরাস বাচ্চাদের ডায়রিয়ার তীব্রতার জন্য দায়ী। কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসও ডায়রিয়া সংক্রান্ত জটিলতার সৃষ্টির পেছনে কাজ করে।
দূষিত পানি নরোভাইরাস, অ্যাস্ট্রোভাইরাস, হেপাটাইটিস এ ভাইরাস, এবং স্যাপোভাইরাসের একটি বড় উৎস। হিমায়িত সবজি হেপাটাইটিস এ ভাইরাসের বড় উৎস। নোরোভাইরাস থাকে পাতাযুক্ত সবুজ শাকসবজি এবং তাজা ফলের মধ্যে। হেপাটাইটিস এ এবং নোরোভাইরাস সংক্রমণ অনুপযুক্ত খাদ্য পরিচালনার মাধ্যমেও হয়ে থাকে।
ব্যাকটেরিয়া এবং পরজীবী
দূষিত খাবার ও পানির মাধ্যমে ই কোলাইয়ের মত প্যাথোজেনিক ব্যাকটেরিয়া বা পরজীবীর সংস্পর্শে আসার ফলে ডায়রিয়া হয়। দূষিত পানি ছাড়াও ই কোলাই কাঁচা বা কম রান্না করা গরুর মাংস, কাঁচা শাকসবজি এবং পাস্তুরিত দুধে থাকে।
পড়ুন: খুলনায় শিশুরোগ ও ডায়রিয়া বেড়েছে
ওষুধ সেবন
কিছু অ্যান্টিবায়োটিক আছে যেগুলো দেহের খারাপ ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলার পাশাপাশি ভালো ব্যাকটেরিয়াও মেরে ফেলে। ফলে অন্ত্রে ব্যাকটেরিয়ার স্বাভাবিক ভারসাম্যে ব্যাঘাত ঘটে, যা পুরো শারীরিক অবস্থাকে ডায়রিয়ার দিকে ধাবিত করে। এছাড়াও অ্যান্টি-ক্যান্সার ওষুধ এবং ম্যাগনেসিয়ামযুক্ত অ্যান্টাসিড ডায়রিয়া সৃষ্টির জন্য দায়ী।
ল্যাকটোজ সমস্যা
ল্যাকটোজ হল দুধ এবং অন্যান্য দুগ্ধজাত দ্রব্যে পাওয়া এক ধরনের চিনি। যাদের ল্যাকটোজ হজম করতে অসুবিধা হয় তাদের দুগ্ধজাত খাবার খাওয়ার পর ডায়রিয়া হয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই সমস্যাটি বাড়তে পারে, কারণ যে এনজাইমটি ল্যাকটোজ হজম করতে সাহায্য করে বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার মাত্রা কমতে থাকে।
ডায়রিয়ার লক্ষণসমূহ
ডায়রিয়ার প্রধান উপসর্গগুলো হল মলত্যাগের জন্য প্রচন্ড চাপ অনুভূত হওয়া, এবং ঘন ঘন পাতলা পায়খানা। এছাড়াও বমি বমি ভাব, পেটে ব্যথা, পেটে চাপ অনুভূত হওয়া, পেট ফোলা থেকে শুরু করে চূড়ান্ত অবস্থায় ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা হয়।
ডায়রিয়ার গুরুতর জটিলতা হল পানিশূন্যতা। ডায়রিয়ার কারণে শরীর থেকে প্রয়োজনী তরলের একটি বিশাল অংশ বেরিয়ে যায়। আর এর ফলেই পানিশূন্যতার ঝুঁকি বাড়ে। পানিশূন্যতার লক্ষণগুলো হলো প্রচন্ড ক্লান্তি, শুকনো শ্লেষ্মা, হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি, মাথাব্যথা, তৃষ্ণা বৃদ্ধি, প্রস্রাব হ্রাস এবং শুষ্ক মুখ।
বাচ্চারা ডায়রিয়া এবং পানিশূন্যতার ক্ষেত্রে বেশ সংবেদনশীল। এ সময় বাচ্চাদের প্রস্রাব কমে যায়, মুখ শুকিয়ে যায়, মাথাব্যথা হয়, ক্লান্ত দেখায়, কান্নার সময় চোখে পানি থাকে না, চোখ আধবোজা- আধখোলা অবস্থায় থাকে, তন্দ্রাতুর দেখায় এবং সবসময় বিরক্ত থাকে।
পড়ুন: ফরিদপুরে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বাড়ছে
ডায়রিয়া হলে করণীয়
সাধারণ অবস্থায় ডায়রিয়া কয়েক দিনের মধ্যে চিকিৎসা ছাড়াই ভালো হয়ে যেতে পারে। শরীর খারাপের সময়টুকু বিশ্রামের পাশাপাশি পর্যাপ্ত পানীয় পান করতে হয় এবং অন্যান্য খাবারের সময় সতর্ক থাকতে হয়।
শরীরকে পানিপূর্ণ রাখার জন্য পরিষ্কার তরল পান ও ফলের রস খেতে হবে। এ সময় দিনে প্রায় ২ থেকে ৩ লিটার পানি পান করা প্রয়োজন। একবারে টান দিয়ে পুরো গলধঃকরণের পরিবর্তে অল্প পরিমাণে চুমুক দিয়ে পান করা যেতে পারে।
ডায়রিয়া হলে দেহকে পানিপূর্ণ রাখতে ডাক্তার লবণ, পটাসিয়াম এবং ক্লোরাইড-এর মত স্পোর্টস পানীয়গুলো পানের পরামর্শ দিতে পারে। ঘন ঘন বমি বমি ভাব হলে ধীরে ধীরে তরলে চুমুক দিয়ে পান করা ভালো। এ সময়ের জন্য উপযুক্ত খাবারের মধ্যে রয়েছে আলু, চিনাবাদামের মাখন, টার্কির মাংস এবং দই।
যে খাবারগুলো ডায়রিয়া বা শরীরে গ্যাসের অবস্থা আরও খারাপ করে এমন খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। এগুলোর মধ্যে আছে চর্বিযুক্ত বা ভাজা খাবার, কাঁচা ফল এবং শাকসবজি, মশলাদার খাবার, মটরশুটি এবং বাঁধাকপি এবং ক্যাফেইনযুক্ত পানীয়, যেমন কফি ও সোডা।
যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে চিকিৎসা ছাড়াই শরীর উন্নতির দিকে যায় এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডায়রিয়া ভালো হয়ে যায়। যদি উপসর্গ ২ দিনের বেশি সময় ধরে চলতে থাকে, তখন ডাক্তারের সরণাপন্ন হওয়া আবশ্যক। এক্ষেত্রে কিছু উপসর্গ গুরুত্বের সাথে নিতে হবে এবং তাৎক্ষণিকভাবে জরুরি অবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এগুলো হলো- অবিরাম বমি, ক্রমাগত ডায়রিয়া, পানিশূন্যতা, উল্লেখযোগ্য হারে ওজন হ্রাস, মলের মধ্যে পুঁজ ও রক্ত, কালো মল বের হওয়া ইত্যাদি।
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে যে উপসর্গগুলো অবিলম্বে চিকিৎসার দাবি রাখে সেগুলো হলো- ২৪ ঘন্টা বা তার বেশি সময় ধরে ডায়রিয়া, জ্বর ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার বেশি, রক্ত ও পুঁজ মল এবং কালো মল।
ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণে ডায়রিয়া হলে ডাক্তার অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের কথা বলতে পারেন। অবশ্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পূর্বে ডাক্তার রোগীর কিছু শারীরিক অবস্থা নিরীক্ষা করবেন। সেগুলো হলো- ডায়রিয়া তীব্রতা, পানিশূন্যতার তীব্রতা, রোগীর স্বাস্থ্যের সামগ্রিক অবস্থা, চিকিৎসা ইতিহাস, বয়স, এবং রোগীর বিভিন্ন পদ্ধতি বা ওষুধ সহ্য করার ক্ষমতা।
পড়ুন: চট্টগ্রামে বেড়েছে ডায়রিয়া: চাপ সামলাতে মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখার নির্দেশ
ডায়রিয়া প্রতিরোধের উপায়
নিয়মিত হাত ধোয়া
যে কোন ভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচার মোক্ষম উপায় হলো খাবার তৈরি ও খাওয়া আগে এবং পরে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নেয়া। রান্না করা, টয়লেট ব্যবহার, বাচ্চার ডায়াপার পরিবর্তন, হাঁচি, কাশি এবং নাক ফুঁকানোর পরে হাত ধুয়ে নেয়া জরুরি। হাতে সাবান লাগানোর পরে কমপক্ষে ২০ সেকেন্ডের জন্য দুই হাত একসাথে ঘষতে হবে। হাত ধোয়ার বিকল্প হিসেবে হ্যান্ড স্যানিটাইজারও ব্যবহার করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে অ্যালকোহল-যুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা উচিত। এ সময় হাতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার এমনভাবে প্রয়োগ করতে হবে যেন তা উভয় হাতের সামনে এবং পিঠে ভালোভাবে লাগে। একটি ভালো হ্যান্ড-স্যানিটাইজারে কমপক্ষে ৬০ শতাংশ অ্যালকোহল থাকে।
ভ্রমণের ক্ষেত্রে সতর্কতা
ডায়রিয়া বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণের সময় সংক্রমণ হতে পারে। যেখানে ভ্রমণ করা হচ্ছে সেখানকার অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন এবং দূষিত খাবার নিমেষেই শরীরকে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার সংস্পর্শে নিয়ে আসে। এ ক্ষেত্রে ঝুঁকি কমাতে করণীয়গুলো হলোঃ
নতুন জায়গায় খাবারের ব্যাপারে সতর্কতা
গরম ও ভালোভাবে রান্না করা খাবার খান। কাঁচা ফল এবং শাকসবজি এড়িয়ে চলতে হবে। অবশ্য সেগুলো রান্নার জন্য প্রস্তুত করা থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ নিজেই করলে খাওয়া যেতে পারে। এছাড়াও কাঁচা বা কম রান্না করা মাংস এবং দুগ্ধজাত খাবার এড়িয়ে চলা জরুরি।
পড়ুন: রাজধানীতে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাবে হাসপাতালে ভর্তি শতাধিক
নতুন জায়গার পানীয়র ব্যাপারে সতর্কতা
বোতলজাত পানি বা সোডা বোতল থেকেই পান করা উচিত। কলের পানি এবং বরফের টুকরো এড়িয়ে চলতে হবে। এমনকি দাঁত ব্রাশ করার জন্যও বোতলজাত পানি ব্যবহার করা জরুরি। গোসল করার সময় বোতলের মুখ বন্ধ রাখতে হবে। সিদ্ধ পানি দিয়ে তৈরি কফি এবং চা নিরাপদ। এক্ষেত্রে মনে রাখা উচিত যে অ্যালকোহল এবং ক্যাফেইন ডায়রিয়াকে বাড়িয়ে তোলে যা পানিশূন্যতাকে আরও অবনতির দিকে ঠেলে দেয়।
ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ
দীর্ঘ সময়ের ভ্রমণের জন্য আগে থেকেই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে অ্যান্টিবায়োটিক নেয়া যেতে পারে। এ সময় ডাক্তার শরীরের যাবতীয় অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে এবং রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাচাই করে সঠিক অ্যান্টিবায়োটিকের পরামর্শ দিবেন।
পরিশিষ্ট
কোভিডের চাপটা কমতে না কমতেই শুরু হয়ে গেছে ডায়রিয়ার প্রকোপ। মুলত এরকম সংক্রমণ আকস্মিক নয়। বরং সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক অবস্থার অস্থিতিশীলতা এ ধরণের রোগবালাইয়ের কারণকে সুসঙ্গত করে। জীবন ও জীবিকা সামলানোর অনিয়ন্ত্রিত দৌড়ে আশেপাশের পরিবেশ ও শরীর-স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে। আর এর সাথে যখন উদাসীনতা যোগ হয় তখনই চাপের ভয়াবহতা বাড়তে থাকে।
পড়ুন: ঢাকার কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী ইফতার বাজার
২ বছর আগে