বৈদ্যুতিক থ্রি-হুইলার
মেড ইন বাংলাদেশ বৈদ্যুতিক থ্রি-হুইলার ইকো ট্যাক্সি বাঘ নামছে দেশের রাস্তায়
বাংলাদেশের পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার নতুন স্তরে অবতরণের নজির হলো দেশের সড়কজুড়ে বৈদ্যুতিক থ্রি-হুইলার-এর বিচরণ। থ্রি-হুইলার বাংলাদেশে বিশেষ করে করে ঢাকার জন্য নতুন কিছু নয়। কিন্তু পরিবেশবান্ধব তিন চাকার গাড়ির ব্যাপারটি দেশের অর্থনীতি ও পরিবেশগত উন্নয়নে অভাবনীয় অবদানের হাতছানি দিচ্ছে। প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় জনজীবনকে আরও সহজ ও নিরাপদ করে তুলতে ডিজিটাল বাংলাদেশের এক অনন্য দৃষ্টান্ত এই বৈদ্যুতিক থ্রি-হুইলার ইকো ট্যাক্সি। 'বাঘ' নামে এই মেড ইন বাংলাদেশ যানটি দাপিয়ে বেড়াবে সারা দেশজুড়ে। চলুন, নতুন এই উদ্যোগের ব্যাপারে বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক।
বৈদ্যুতিক থ্রি-হুইলার ইকো ট্যাক্সির বৈশিষ্ট্য
থ্রি-হুইলারটির কাঠামোতে দেয়া হয়েছে মানসম্পন্ন ইস্পাত, যা একে অন্যান্য ইজিবাইকগুলোর তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি টেকসই করেছে। বিশেষত বড় গাড়ির জন্য ব্যবহার করা ইস্পাত দিয়ে তৈরি হয়েছে বাঘের বডি।
ছয় ফুট চওড়া ইকো ট্যাক্সি বাঘের যাত্রীর অংশে ইজি বাইকের মত পাশাপাশি ও মুখোমুখি মোট চারজনের বসার জায়গা রয়েছে। সামনে ড্রাইভারের সাথে দু’জন বসতে পারবেন। সব মিলিয়ে ড্রাইভার সহ মোট সাতজন যাত্রীকে বহন করতে পারবে বাঘ। পুরো ট্যাক্সির ধারণ ক্ষমতা ৭৮০ কেজি।
পড়ুন: অপো এফ২১ প্রো: ফ্যাশনপ্রেমীদের জন্য সানসেট অরেঞ্জ রঙের ফ্যান্টাস্টিক ফোন
১৫০ কেজি ওজনের লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি একবার পুরো চার্জ দিলে চলবে ১২০ কিলোমিটার। এই চলার সময় ইকো-ট্যাক্সির ছাদে সংযুক্ত সৌর প্যানেল সূর্যের আলোয় চার্জ হতে থাকবে। ফলে ব্যাটারির চার্জ শেষ হয়ে গেলে বাঘ সৌর বিদ্যুতের সাহায্যে আরো ২৫ থেকে ৩০ কিলোমিটার দৌড়ে যাবে।
লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির এই জ্বালানি ব্যবস্থায় গতি বাড়ানো হলেও অতিরিক্ত শব্দ সৃষ্টি হবে না। উপরন্তু অন্যান্য যানগুলোর মত এখানে শব্দ দূষণের ঝামেলা থাকছে না।
ব্যাটারি ও চার্জারের সাথে লাগানো আছে মাইক্রোচিপ, যেটি কাজ করে বিএমএস (ব্যাটারি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম) হিসেবে। এর সাথে সরাসরি সংযোগ আছে গাড়ির নিজস্ব অ্যাপের। এতে গাড়ি ব্যবহারকারি সার্বক্ষণিক ব্যাটারি চার্জের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে পারবে।
পড়ুন: ঠাকুরগাঁওয়ে রাসায়নিকের বিকল্পে জনপ্রিয় হচ্ছে কেঁচো সার
বুয়েট (বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়)-এর তথ্যমতে এই যানগুলো সর্বোচ্চ ঘন্টায় ৪৫ কিলোমিটার গতিবেগে ছুটতে পারবে।
সিএনজি বা অন্যান্য ইজিবাইকের তুলনায় এই গাড়িতে অপেক্ষাকৃত বড় চাকা ব্যবহার করা হয়েছে। এতে আছে সেরা হাইড্রলিক ব্রেকিং সিস্টেম এবিএস (এ্যান্টি-লক ব্রেক সিস্টেম), যা চূড়ান্ত মুহূর্তে গাড়িটিকে সর্বোচ্চ তিন ফুট দূরত্বের মধ্যে সম্পূর্ণ থেমে যেতে সাহায্য করবে।
যে কোন দূরত্ব থেকে যানটির সামগ্রিক তদারকের জন্য আছে নিজস্ব অ্যাপ। এটি যানটির যাবতীয় অবস্থা সম্পর্কে এর ব্যবহারকারীকে জানান দিবে।
পড়ুন: এলিয়েন কি সত্যি পৃথিবীতে এসেছিল?
গাড়িটির আশপাশ সার্বক্ষণিক মনিটরিং-এর জন্য আছে তিনটি নাইট ভিশন ক্যামেরা, যেগুলো ৩৬০ ডিগ্রী ঘুরতে পারে। অ্যাপের মাধ্যমে এই ক্যামেরাগুলো নিয়ন্ত্রণ করে ২৪ ঘন্টা গাড়িটিকে দেখাশোনার মধ্যে রাখা যাবে। গাড়িতে থাকা জিপিএস যে কোন জায়গা থেকে একে ট্র্যাক করতে সাহায্য করবে।
ভেতরে যাত্রীদের ব্যবহারের জন্য থাকছে মিনি টেলিভিশন, ওয়াইফাই ও মোবাইল ফোন চার্জ দেয়ার ব্যবস্থা। এমনকি ভাড়া মেটানোর জন্য থাকছে এটিএম কার্ডসহ যেকোনো মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপ ব্যবহারের সুবিধা।
বাঘ ইকো ট্যাক্সির গুরুত্বপূর্ণ একটি ফিচার হচ্ছে যাত্রী অংশে থাকা প্যানিক বাটন। এতে চাপ দিলে গাড়ি যে গতিতেই থাকুক না কেন, সাথে সাথেই ঘন্টায় ৫ কিলোমিটার গতিতে নেমে আসবে। পাশাপাশি ২০ মিনিট গাড়িটি চালনার যাবতীয় কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ থাকবে। একই সাথে গাড়িটির সঙ্গে যুক্ত থাকা কন্ট্রোল সেন্টারে সংকেত চলে যাবে এবং সেখান থেকে তাৎক্ষণিকভাবে গাড়িটিকে স্থায়ীভাবে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারবে।
পড়ুন: ক্রিকেট এবং রাজনীতির বাইরে ইমরান খানের বর্ণীল জীবন
সাধারণ থ্রি হুইলারের সাথে ইকো-ট্যাক্সি বাঘের তুলনা
এ ধরণের ক্যাটাগরির যানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে খরচ হয় ১৭ টাকা। কিন্তু বাঘ-এ খরচ হবে ৭ টাকা। বিদ্যুতের জন্য সিএনজিচালিত অটোগুলোতে প্রতি কিলোমিটারে খরচ উঠে ১ টাকা ৮০ পয়সা। ইজিবাইকওয়ালাদের গুনতে হয় ২ টাকা ২০ পয়সা। সেখানে বাঘের জন্য প্রতি কিলোমিটারে বিদ্যুৎ খরচ দাড়াবে ৪০ থেকে ৪৫ পয়সা। এতে করে বাঘের যাত্রীদের ভাড়াও অনেক কমে আসবে।
ইজিবাইকে ব্যবহৃত ৫টি ব্যাটারির প্রতিটিতে ১০ লিটার করে মোট ৫০ লিটার অ্যাসিড প্রয়োজন হয়। মাত্র ছয় মাস মেয়াদ থাকে এই ৫০ লিটার অ্যাসিডের, যা চালকদের বছরে মোট ১০টি ব্যাটারি ব্যবহার করতে বাধ্য করে। এর ফলে প্রতি বছর পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে প্রায় ১০০ লিটার অ্যাসিড, যা পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এছাড়া এই অ্যাসিডের সংস্পর্শে থাকা মানুষগুলোর ১০ বছরের মধ্যে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অন্যদিকে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির ক্ষেত্রে এই অনর্থগুলো ঘটার কোন সম্ভাবনা নেই।
পড়ুন: মঙ্গলগ্রহের জন্য রোবট তৈরিতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের অপার সম্ভাবনা
দেশের রাস্তায় বৈদ্যুতিক থ্রি-হুইলার ইকো ট্যাক্সি
২০২০-এর মার্চ থেকে এপ্রিল নাগাদ ১১টি যান তৈরি করা হয়। সে সময় থেকেই যানগুলো রাস্তায় নামানোর জন্য সরকারি অনুমোদনের চেষ্টা চালিয়ে আসছিলো বাঘ ইকো মোটর্স। ২০২১ এর সেপ্টেম্বরে আবেদন পেশ করা হয় বিআরটিএ (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ)-তে। ২০২২ এর ২৪ ফেব্রুয়ারি বিআরটিএ’র টেকনিক্যাল কমিটির সভায় বুয়েট সহ পুরো সভা বাঘের স্বপক্ষে সুপারিশ করে।
অতঃপর বিভিন্ন যাচাই-বাছাই নিরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হবার পর ২০২২ সালের ২০ মার্চ রবিবার বিআরটিএ’র অনুমোদন পায় বাঘ। আর কিছুদিনের মধ্যে ঢাকার রাস্তায় চলতে দেখা যাবে ইকো ট্যাক্সি বাঘকে।
পড়ুন: খেজুর খাওয়ার উপকারিতা: সারাদিন রোযা রেখে ইফতারে কেন খেজুর খাবেন?
মেড ইন বাংলাদেশ বাঘ-এর উৎপাদন
গাজীপুর জেলার হোতাপাড়া নামক স্থানে গড়ে উঠেছে বাঘের কারখানা। ইকো-ট্যাক্সিটির সব পরীক্ষামূলক ভার্সনগুলোরই উৎপাদন হয়েছে সেখানে। অত্যাধুনিক যান কারখানাটি প্রতিদিন তিন হাজার বাঘ উৎপাদনের সক্ষমতা রাখে।
বৈদ্যুতিক থ্রি-হুইলার ইকো ট্যাক্সির দাম
বাঘের সম্ভাব্য মূল্য রেজিষ্ট্রেশন সহ চার লাখ থেকে সাড়ে ছয় লাক টাকা। লিথিয়াম আয়নের ব্যাটারিতে পাঁচ বছরের ওয়ারেন্টি থাকলেও এটি সাত বছর বদলানোর প্রয়োজন পড়বে না। এছাড়া থাকছে দুই বছরের সার্ভিস ওয়ারেন্টি। মোটর আর সোলার সিস্টেমের জন্য পাওয়া যাবে দুই বছরের রিপ্লেসমেন্ট ওয়ারেন্টি। ন্যূনতম ডাউন পেমেন্ট দিয়ে শূন্য শতাংশ সুদে ইএমআই(ইক্যুয়েটেড মান্থলি ইন্সটলমেন্ট)-এর মাধ্যমে টাকা পরিশোধের ভিত্তিতে কেনা যাবে বাঘ।
এছাড়া শব্দহীন এই গাড়িটির জন্য দেয়া হবে ফার্স্ট ক্লাস বিমা। গাড়ি চালাতে গিয়ে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষতিপূরণ বাবদ পাওয়া যাবে এক লক্ষ টাকা। সর্বোপরি, অন্যান্য গাড়ির মত এর খরচবহুল রক্ষণাবেক্ষণের চাপ থাকছে না।
পড়ুন: দীর্ঘ ট্রাফিক জ্যামে সময় কাজে লাগানোর উপায়
দেশের বাজারে বৈদ্যুতিক থ্রি-হুইলার বাঘের সম্ভাবনা
পরিবেশবান্ধব লিথিয়াম ব্যাটারি ব্যবহার বছরে অন্তত ৪০০ কোটি টাকার বিদ্যুৎ খরচ বাঁচাবে। দেশের রাস্তায় বর্তমানে চলমান ২০ লাখ ইজিবাইক বন্ধ হলে ইইউ (ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন) থেকে অর্থ লাভ করবে বাংলাদেশ সরকার। প্রতিটি ইজিবাইক বন্ধের জন্য ইইউ থেকে কার্বন ক্রেডিট বাবদ আয় হবে ১৫ ডলার করে। এ ছাড়া রাস্তায় চলাচলের অনুমোদন না থাকা এই যানগুলোর অধিকাংশেরই রেজিস্ট্রেশন নেই। অর্থাৎ এ থেকো কোনও রাজস্ব আসে না। সেক্ষেত্রে বাঘ রেজিস্ট্রেশনের আওতায় এলে সরকারের প্রতি বছর রাজস্ব দাড়াবে সাড়ে ৫০০ থেকে ৭৫০ কোটি টাকা।
বাঘ ইকো মোটরসের কর্ণধার কাজী জসিমুল ইসলাম বাপ্পী এই ইকো ট্যাক্সিকে ঘিরে এক থেকে দুই বিলিয়ন ডলারের ই-কর্মাস ব্যবসার পরিকল্পনা করছেন। সেখান থেকেও এক বিরাট অংশের রাজস্ব আসবে। এছাড়া ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর আয় হবে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে বাঘ থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব হবে বছরে অন্তত বারো হাজার কোটি টাকা।
সরকারের যথাযথ নীতিমালা অনুসারে ২০ লাখ ইজিবাইক লিথিয়াম আয়ন ও সৌর শক্তি দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যাবে। এভাবে এক লাখ ৬০ হাজার টাকার ইজিবাইকগুলো পরিবেশবান্ধব করে কাজে লাগানো যেতে পারে।
পড়ুন: ডায়রিয়া বা উদরাময়: কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উপায়
সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড মনিটর করার জন্য পুলিশ বক্স ও থানাগুলোকে বানানো যেতে পারে কন্ট্রোল সেন্টার। তাছাড়া বিদেশে রপ্তানি করে এক বিরাট অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনা তো থাকছেই।
শেষাংশ
ভবিষ্যতে বাঘ-এ যুক্ত করা হবে মোশন প্রযুক্তি, যেখানে চাকা ঘোরার সাথে সাথে ব্যাটারিও চার্জ হবে। এই বৈদ্যুতিক থ্রি-হুইলারকে নিরবচ্ছিন্নভাবে দেশব্যাপী বিচরণের জন্য বেঙ্গল ব্যাটারি আগামী পাঁচ বছরে সারা দেশে স্থাপন করতে যাচ্ছে ৫,০০০ চার্জিং স্টেশন। 'মেইড ইন বাংলাদেশ' লেখা বৈদ্যুতিক থ্রি-হুইলার 'বাঘ' রপ্তানির ব্যাপারে ইতোমধ্যে কথা চলছে ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে। কম্বোডিয়া, সুদান, ইথিওপিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা এই থ্রি-হুইলারের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাঘ ইকো মোটর্স ১০টি বৈদ্যুতিক ইকো বাস নিয়ে আসবে ২০২৩ সালের জুন নাগাদ। ইকো ট্যাক্সির বদৌলতে গ্রামগঞ্জের ডেলিভারির কাজগুলো দ্রুতগতি ও বেশ কম খরচে করার লক্ষ্যে পোস্ট অফিসকে সক্রিয় করার প্রয়াস চলছে।
পড়ুন: টেলিটকের ইন্টারনেট ডাটার মেয়াদের সীমাবদ্ধতা থাকবে না: টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী
২ বছর আগে