এভারেস্ট
এভারেস্টজয়ী ৬ বাংলাদেশি: লাল-সবুজের পতাকা হাতে বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয়ের অনুপ্রেরণা
৮ হাজার ৮৪৮ দশমিক ৮৬ মিটার উচ্চতার অতিকায় এভারেস্ট বিজয় হাজারও পর্বতারোহীর চিরঞ্জীব অভিলাষ। মৃত্যুঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও পৃথিবীর সর্বোচ্চ এই বিন্দুতে নিজেকে আবিষ্কারের নেশা যেন কিছুতেই এড়িয়ে যাওয়ার নয়। আর তাই দুঃসাহসিক সব অভিযানের সাক্ষী হয়ে আছে চীন ও নেপালের সীমান্তবর্তী এই সামিট পয়েন্টটি। কখনও দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে নেপাল হয়ে কিংবা উত্তর দিক থেকে তিব্বত হয়ে। দুটো পথেই অভিযাত্রী দলের চূড়ান্ত গন্তব্য হিমালয়ের মহালাঙ্গুর হিমাল সাব-রেঞ্জ।
হৃদয় কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো এই শিখরটি বাংলাদেশিদের জন্য একদমি নতুন নয়। এ নিয়ে মোট ৬বার এভারেস্ট চূড়া দেখেছে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা। সেই পতাকাবাহীদের নিয়েই আজকের নিবন্ধ। চলুন, এভারেস্টজয়ী ৬ বাংলাদেশিদের নিয়ে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
যে ৬ বাংলাদেশি এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছেছেন
মুসা ইব্রাহীম
মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণকারী প্রথম বাংলাদেশি নাগরিক মুসা ইব্রাহীম। তিনি ২০১০ সালের ২৩ মে বাংলাদেশ সময় ৫ টা ৫ মিনিটে বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে পা রাখেন। এই অভিযানে তিনি ব্যবহার করেছিলেন তিব্বতের দিকে উত্তর আলপাইন রুটটি। বাংলাদেশ সময় ভোর ৫টা ১৬ মিনিটে পৃথিবীর শীর্ষবিন্দুতে তিনি বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
এরপর থেকে ৬৭-তম দেশ হিসেবে এভারেস্ট জয়ী দেশগুলোর তালিকায় নিজের অবস্থান করে নেয় বাংলাদেশ। অভিযানে মুসার সহযাত্রীরা ছিলেন ছয়জন ব্রিটিশ, তিনজন মন্টিনিগ্রো, একজন আমেরিকান এবং একজন সার্বিয়ান। চায়না তিব্বত পর্বতারোহণ সমিতি মুসার আরোহণকে প্রত্যয়িত করে।
আরও পড়ুন: এবার এভারেস্ট জয় করলেন চট্টগ্রামের বাবর
মুসা ১৯৭৯ সালে লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার গন্ধমারুয়া (বসিন্তরী) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নটরডেম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর তিনি অনার্স এবং মাস্টার্স করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
মুসা নর্থ আলপাইন ক্লাব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক। তিনি পর্বতারোহণসহ দুঃসাহসিক নানা কার্যকলাপে যুবকদের ব্যাপক অংশগ্রহণের জন্য ২০১১ সালে তিনি এভারেস্ট একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন।
মোহাম্মদ আবদুল মুহিত
২০১১ সালের ২১ মে দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয় করেন মোহাম্মদ আবদুল মুহিত। এর আগের বছর মুসা ইব্রাহীমের পাশাপাশি তিনিও এভারেস্ট জয়ের জন্য গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে সেবার তার ভাগ্য সহায় হয়নি। কিন্তু এতেই তিনি থেমে থাকেননি। পরের বছর বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাবের একজন সদস্য হয়ে আবারও নেমে পড়েন এভারেস্ট জয়ের যাত্রায়। ২০১১ সালের মার্চের শেষ সপ্তাহে তিনি শুরু করেন তার অভিযান এবং এইবার তিনি পৌঁছাতে পারেন তার অভীষ্ট লক্ষ্যে। খবরটি ঢাকায় অবস্থিত নেপাল দূতাবাসের মাধ্যমে নিশ্চিত করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহিঃপ্রচারণা বিভাগ। এরপর ২০১২ সালের ১৯ মে নেপাল তথা দক্ষিণ দিক দিয়ে আরও একবার এভারেস্ট জয় করেন মুহিত।
মুহিতের জন্ম ১৯৭০ সালের ৪ জানুয়ারি ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার গঙ্গাপুরে। নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে তিনি ঢাকা সিটি কলেজ থেকে বাণিজ্যে স্নাতক ডিগ্রি নেন। মুহিত ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।
আরও পড়ুন: রেকর্ড ভেঙে ১০ বার এভারেস্ট চূড়ায় লাকপা শেরপা
২০০৪ সালে কালাপাথর ট্রেকিং ও এভারেস্ট বেস ক্যাম্পয়ে অংশ নেন মুহিত। অতঃপর ভারতের দার্জিলিংয়ের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে মৌলিক ও উচ্চতর পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন।
২০০৯ সালে বাংলাদেশি পর্বতারোহীদের মধ্যে তিনি প্রথমবারের মতো জয় করেন বিশ্বের ষষ্ঠ সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ‘চো ওয়ো’, যার উচ্চতা ৮ হাজার ২০১ মিটার।
নিশাত মজুমদার
বাংলাদেশের প্রথম এভারেস্ট বিজয়ী নারী নিশাত মজুমদার। তার সহযাত্রী ছিল লাকপা, পেম্বা দোর্জে, মিংমা নামের তিন শেরপা এবং মোহাম্মদ আব্দুল মুহিতের পরিচালিত একটি বড় দল। এই পুরো দলকে সঙ্গে নিয়েই তিনি ২০১২ সালের ১৯ মে’তে পাহাড়ের উত্তর দিকে পৌঁছান।
নিশাতের জন্ম ১৯৮১ সালের ৫ জানুয়ারি নোয়াখালী জেলার রামগঞ্জে। তিনি ঢাকা সিটি কলেজ থেকে হিসাব বিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
নিশাতের এভারেস্টে ওঠার নেপথ্যে ছিল তার প্রায় দশ বছরের প্রস্তুতি। ২০০৩ সালের শেষের দিকে তিনি বাংলাদেশ মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাবে (বিএমটিসি) যোগ দেন। এই সংগঠনের সুবাদেই পরবর্তীতে একের পর এক অভিযানে অংশ নেন তিনি।
আরও পড়ুন: তাজিংডং ভ্রমণ গাইড: যাওয়ার উপায় ও খরচ
২০০৭ সালে নিশাত প্রশিক্ষণ নেন ভারতের দার্জিলিং মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাব থেকে। এরই ফলশ্রুতিতে ২০০৮ সালে আরোহণ করেন হিমালয়ের ‘সিঙ্গু চুলি’তে।
২০২০ সালের ১১ জানুয়ারী নিশাত বঙ্গবন্ধু জাতীয় আ্যডভেঞ্চার উৎসব, ২০২০-এ বঙ্গবন্ধু আ্যডভেঞ্চার সম্মাননা পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৮ সালে তিনি ভূষিত হন অনন্যা শীর্ষ দশের একজন হিসেবে।
অনন্যা শীর্ষ দশের মূল উদ্দেশ্য বিভিন্ন অঙ্গনে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশের নারীদেরকে স্বীকৃতি দেওয়া।
ওয়াসফিয়া নাজরীন
নিশাত মজুমদারের এভারেস্টের উত্তর প্রান্তে পৌঁছানোর ঠিক ৬ দিন পর নেপালের দিক দিয়ে স্বাধীনভাবে চূড়ায় পৌঁছেন ওয়াসফিয়া নাজরীন। এটি ছিল তার ৭টি মহাদেশের ৭টি সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয়ের অভিযান ‘সেভেন সামিট’ এর একটি। ২০১৫ সালে প্রথম বাংলাদেশি এবং প্রথম বাঙালি হিসেবে তিনি এই সেভেন সামিট শেষ করেন। ওয়াসফিয়া একই সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিতীয় এবং সর্বকনিষ্ঠ এভারেস্টজয়ী নারী। তার চূড়ায় আরোহণের সময়টি ছিল ২০১২ সালের ২৬ মে সকাল পৌঁনে ৭টা। এছাড়া ২০২২ সালের ২২ জুলাই তিনি প্রথম বাঙালি এবং প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কে২ জয় করেন।
আরও পড়ুন: বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড় ভ্রমণ: বাংলার দার্জিলিং যাওয়ার উপায় ও খরচের বৃত্তান্ত
৬ মাস আগে
রেকর্ড ভেঙে ১০ বার এভারেস্ট চূড়ায় লাকপা শেরপা
লাকপা শেরপা নামের একজন নারী নেপালি শেরপা বৃহস্পতিবার বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছে সবচেয়ে সফল নারী পর্বতারোহী হিসেবে নিজের রেকর্ড ভেঙেছেন।
লাকপা শেরপার ভাই ও অভিযানের সংগঠক মিংমা গেলু জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার ভোরে লাকপা শেরপাসহ আরও বেশ কয়েকজন পর্বতারোহী আট হাজার ৮৪৯ মিটার (২৯,০৩২ ফুট) চূড়ায় পৌঁছায়। তিনি আরও জানান, সকলে সুস্থ আছেন এবং নিরাপদে নেমে আসছেন।
৪৮ বছর বয়সী এই নারী শেরপা বৃহস্পতিবারের সফল আরোহনের মধ্য দিয়ে রেকর্ড ১০ বারের মতো এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছেছেন।
আরও পড়ুন: রেকর্ড ভেঙে ২৬তম বার এভারেস্ট চূড়ায় কামি রিতা
লাকপা শেরপা বলেছেন, তিনি সকল নারীদের অনুপ্রাণিত করতে চান যাতে তারাও তাদের স্বপ্নগুলো অর্জন করতে পারে৷
তিন সন্তানের সঙ্গে নেপালের এই শেরপা বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কানেকটিকাটের ওয়েস্ট হার্টফোর্ডে বসবাস করছেন।
এর আগে শনিবার আরেক নেপালি শেরপা গাইড কামি রিতা ২৬তম বারের মতো চূড়ায় পৌঁছে নিজের রেকর্ড ভেঙেছেন।
উল্লেখ্য মে মাসের আবহাওয়া এভারেস্টে আরোহণের জন্য সবচেয়ে অনুকূল সময়।
২ বছর আগে