আম্রপালি
বাংলাদেশের বাহারি আম এবং তাদের উৎপাদনকারী অঞ্চল
জাতীয় ফল না হলেও জনপ্রিয়তার দিক থেকে বাংলাদেশের বাহারি আমগুলো অনন্য। গ্রীষ্মকালীন এই বৈচিত্র্যপূর্ণ ফলগুলো শরীরের শক্তির যোগান দিয়ে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। পুষ্টিগুণের পাশাপাশি পেটপূর্তিরও সহায়ক এই সুমিষ্ট ও রসাল ফলটি। মৌসুমী ফল হিসেবে গরমের দাবদাহে বিভিন্ন জাতের আমগুলো যেন শান্তির পরশ নিয়ে আসে। সারা বিশ্বে সর্বাধিক পছন্দনীয় ফলের মধ্যে সবার উপরে থাকায় আমকে ফলের রাজা বলা হয়। দক্ষিণ এশিয়ার জলবায়ু আমের ফলনের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশের ফল বলতে সবার আগে আমের কথাই উঠে আসে। আজকের ফিচারটি বাংলাদেশে উৎপাদিত কয়েকটি সেরা জাতের আম নিয়ে।
বাংলাদেশের ১০টি জনপ্রিয় আমের জাত
ফজলি
উত্তরবঙ্গ মানেই ফজলি আমের স্বর্গ। সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ফজলি চাষের জন্য রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সুখ্যাতি আছে সারা দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে একবার মালদহের কালেক্টর মি. র্যাভেন যাত্রা পথে তৃষ্ণা মেটানোর জন্য এক গ্রাম্য বাড়িতে আশ্রয় নেন। সে বাড়ির আঙিনায় ছিলো মস্ত এক আমগাছ। সেখানকার গৃহকর্ত্রী ফজলু বিবি তাকে আম খেতে দেন। এই আম খেয়ে মজা পেয়ে র্যাভেন সাহেব ইংরেজিতে তার কাছে ফলটির নাম জানতে চান। কিন্তু মহিলা তার কথার কিছুই বুঝতে না পেরে নিজের নাম বলে দেন। কালেক্টর সাহেবও মনে করে নেন যে ফলটির নাম ফজলি। আর সেই থেকেই আমের নাম রটে যায় ফজলি।
পড়ুন: বাম্পার ফলনের আশা সোনারগাঁও লিচু চাষিদের
ফজলি আম বেশ লম্বা ও ঈষৎ চ্যাপ্টা হওয়ায় আঁটিও একই গড়নের হয়। গড়ে এর ওজন ৬৫৪.৪ গ্রাম হয়ে থাকে। আম পাকলে এর পাতলা খোসা হলুদাভ বর্ণ ধারণ করে। শাঁসও একই রঙের তবে আঁশবিহীন। ৫ থেকে ৭ই জুলাই থেকে ১৫ আগষ্ট পর্যন্ত ফজলি আম পাকার সময়।
ল্যাংড়া
আঠারো শতকে ভারতের বিহার রাজ্যের দ্বারভাঙায় এক খোড়া ফকিরের মাধ্যমে শুরু হয় এই আমের চাষ। কিন্তু ফকিরের নামটা আমের সাথে না জুড়লেও, তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতাটি এখনো মিশে আছে এই আমের সাথে। ল্যাংড়া আমের আরেক নাম বারানসী। আম পরিপক্ক হওয়ার সাথে সাথে খানিকটা হলদে বর্ণ ধারণ করে।
পাঁকা ল্যাংড়া আম পাওয়ার সময় জুলাই মাস। ছোট ছোট টুকরো করে খাওয়ার ক্ষেত্রে এই আমের কোন জুড়ি নেই। উত্তরবঙ্গের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর ও নওগা ছাড়াও সাতক্ষীরাতেও ল্যাংড়া ভালো জাতের ল্যাংড়া আম পাওয়া যায়।
পড়ুন: গোল্ডেন মিল্কের জাদুকরি উপকারিতা
ক্ষীরশাপাতি বা হিমসাগর
রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সাতক্ষীরার আমগুলোর মধ্যে এই বিশ্ব জোড়া প্রসিদ্ধ আমটি মিষ্টি স্বাদ ও সুগন্ধ যুক্ত। হিমসাগর আমের বহুল জনপ্রিয়তার কারণে একে বলা হয় আমের রাজা। আমের ভিতরে অংশ আঁশ বিহীন এবং হলুদ ও কমলা বর্ণের। ওজনের দিক থেকে ২৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫০ গ্রাম হয়ে থাকে। আমটির জনপ্রিয়তার পেছনে মুল কারণ হলো এর প্রায় ৭৭ শতাংশই আম আর বাকি মাত্র ২৩ ভাগ আঁটি। সারা জুন মাস ধরেই গাছে পাঁকা হিমসাগরের মেলা বসে।
গোপালভোগ
গোপালভোগ বা আসবি নামের এই আমটির ফলন হয় মে মাসের শেষের দিকে। শুরুতে আমের মুকুলে ভরে উঠে, আর বৃষ্টির মধ্যে পরিপক্কতা পেতে শুরু করে। প্রথমে যখন কাঁচা থাকে তখন সবুজ এবং পাকা হয়ে গেলে হলুদ লালচে হয়ে আসে। দেশের প্রায় সব জেলাতে পাওয়া গেলেও গোপালভোগ খুব স্বল্প সময়ের জন্য বাজারে আসে। গোলাকার এই আমের ওজন সর্বনিম্ন ২০০ থেকে প্রায় ৫০০ গ্রামের হয়। মোটা খোসা পাতলা আঁটির এই আমটির স্বাদ ও গন্ধ বেশ মিষ্টি।
পড়ুন: লাল চাল: কেন খাবেন এবং কারা এড়িয়ে চলবেন?
আম্রপালি
এটি মূলত দুটি ধরনের আম- দশেরী ও নিলমের একটি হাইব্রিড নাবি জাতের আম। অর্থাৎ আমের মৌসুমের শেষব্দি পর্যন্ত এটি পাওয়া যায়। ১৯৭১ সালে ভারতীয় কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ড. পিযুষ কান্তি মজুমদার পরীক্ষাগারে তৈরি করেন আম্রপালি। আম্রপালির পরিপক্কতার সময়কাল ২৮ জুন থেকে ২৫ জুলাই। বান্দরবানের আম্রপালিগুলো দেশের অন্যান্য জায়গার আম্রপালি অপেক্ষা কমপক্ষে ১৫ দিন পূর্বে পরিপক্ব হয়। ছোট গড়নের একই গাছে প্রতিবছর ফলন হয় কমলা-লাল রঙের আম্রপালির।
লক্ষণভোগ
চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রসিদ্ধ এই আমটির আরেক নাম লখনা। লখনার বিশেষত্ব হলো গোপালভোগ বা ল্যাংড়া আমের মত এর মিষ্টতা তেমন বেশি না। তাই ডায়াবেটিকস রোগীরা এই আমটির স্বাদ আস্বাদন করতে পারেন। এই জন্য লক্ষণভোগ ডায়াবেটিক্স আমও নামের বেশ পরিচিত।
পড়ুন: আগাম আম পেড়ে বিপাকে সাতক্ষীরার চাষিরা
১৫০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের লক্ষণভোগের পরিপক্কতার সময় ১৫ জুন থেকে ১৫ জুলাই। কাঁচা লখনা আম হালকা সবুজ থাকে। অন্যদিকে পেঁকে গেলে টকটকে হলুদ রঙের হয়ে যায়।
হাড়িভাঙ্গা
বিশ্ববিখ্যাত এ হাড়িভাঙ্গা আমের উৎপত্তি রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়ন থেকে। নফল উদ্দিন পাইকার ছিলেন একজন বৃক্ষবিলাসী মানুষ। তিনি তার মালদিয়া আমগাছের নিচে মাটির হাঁড়ির ফিল্টার বানিয়ে পানি দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। একদিন রাতে হঠাৎ এই ফিল্টারটি ভেঙে যায়। কে বা কারা করেছে, তার কোন হদিস মেলেনি।
গাছটির সুস্বাদু আমগুলো বিক্রির সময় বাজারে লোকেরা প্রায়ই আমগুলোর ব্যাপারে জানতে চাইতো। নফল উদ্দিন ঠিক এইভাবেই বলতেন যে, যে গাছের নিচের হাড়ি ভেঙেছে, এগুলো সেই গাছের আম। এই কথা লোকমুখে ছড়াতে ছড়াতে মালদিয়া আমের নাম হয়ে যায় হাড়িভাঙ্গা। এই আমের গাছ লম্বায় বাড়ার চেয়ে পাশে বেশি বিস্তৃত হয়। তাই ঝড়েও গাছটি উপড়ে পড়েনা, আর আমও কম ঝরে। জুনের ২০ তারিখের পর থেকে গাছে পাকা হাড়িভাঙ্গা দেখা যেতে শুরু করে।
পড়ুন: জেনে নিন ডালিমের খোসার গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার
আশ্বিনা
সব থেকে নাবি আম আশ্বিনার পরিপক্কতার সময় ২০ জুলাই থেকে শুরু আর শেষ হয় ১৫ সেপ্টেম্বর-এ। কালচে ও সবুজ রঙের আমটির নিচের দিক সূঁচালো। মাঝারি মোটা খোসার ভেতরে হলুদাভ শাঁস থাকে।
মুকুল আসার পর বর্ষাকাল জুড়ে প্রায় ৫ থেকে ৬ মাস লেগে যায় আম পাকতে। ৪০০ থেকে ৫০০ গ্রামের এই আম তুলনামূলকভাবে কম মিষ্টি, আর কাঁচা অবস্থায় তো বেজায় টক!
সারা দেশ জুড়েই এই আমের চল থাকলেও সব থেকে বেশী আশ্বিনার ফলন হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জে।
পড়ুন: তরমুজের বাম্পার ফলন হলেও খুলনার চাষিরা হতাশ
মোহনভোগ
এটিও নাবি জাতের আম আর জুন মাসের শেষের দিকে ফলটি পোক্ত হতে শুরু করে। মোহনভোগের আসল সময় জুলাইয়ের প্রথম এবং আগষ্টের মাঝামঝি।
৩০০ থেকে ৫৫০ গ্রাম ওজনের আমটির ত্বক মসৃণ ও হালকা সবুজ রঙের, যা পাকলে হলুদ হয়ে যায়। পুরু খোসার ভেতর হলুদাভ শাঁস। হিমসাগর থেকেও আকারে বড় এই আমটি অতিরিক্ত পাকলে খোসার বিভিন্ন অংশে হালকা পচন ধরে। মাঝারি গড়নের গাছে প্রতি বছরই মিষ্টি মোহনভোগ ধরে। অন্যান্য উন্নত জাতের আমগুলোর মধ্যে বৃহত্তর রাজশাহী জুড়ে নিজের একটি স্বতন্ত্র অবস্থান করে নিয়েছে মোহনভোগ আম।
রাণী পছন্দ
আগাম বা আশু জাতের ছোট ও গোলাকার রাণী পছন্দ পাকলে মিষ্টি হলুদ রঙ ধারন করে। পাতলা, মসৃণ ও রসাল খোসার আমটিতে কোন আঁশ নেই; শাস কমলাভ। ফলে আমটি কেটে খাবারও উপায় নেই। মে মাসের একদম শেষের দিকে শুরু হয় আম পাকা। গাছ থেকে ছেড়ার ৭ থেকে ৮ দিনের মধ্যে আমে পাক ধরে যায়। জুন মাসের শেষ নাগাদ বাজারে পাওয়া যায় রাণী পছন্দ।
পড়ুন: গরমকালে কম খরচে বাংলাদেশের কোথায় কোথায় ঘুরতে যাবেন?
গড়ে ১৬৫ গ্রাম ওজনের এই আম প্রতি বছরই বেশ ভালো ফলে। ১ থেকে ১৫ জুনের মধ্যে একেকটি গাছ ভরে যায় পাকা রাণী পছন্দে। চাপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর ও নওগাতে এর যথেষ্ট চাষ হলেও সবার থেকে এগিয়ে আছে রাজশাহী জেলা।
শেষাংশ
বাংলাদেশে উৎপাদিত এই জনপ্রিয় আমের জাতগুলো আমকে দেশের প্রতীকে পরিণত করেছে। এ দেশের মাটি আম ফলনের অনুকূলে থাকায় কৃষি ক্ষেত্রে আম যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এছাড়াও কাঁচা ও পাঁকা; দুই ধরনের আম দিয়েই তৈরি করা যায় নানা ধরনের মুখরোচক খাবার। সেই খাবারের ভিন্নতা এখনো আমের বিচিত্র জাতকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। কোন কোন বছর নতুন জাতের আমগুলো ফলচাষিদের স্বপ্ন পূরনের হাতিয়ার হয়ে দাড়ায়। সর্বসাকুল্যে, এই অসামান্য রপ্তানি পণ্যটি কৃষি নির্ভর বাংলাদেশের স্বচ্ছলতার নির্ধারক।
পড়ুন: ওজন কমাতে ১০ কার্যকরী পানীয়
২ বছর আগে