দূষিত পানি পরিশোধিত করার উপায়
বন্যার সময় খাবার পানি পরিশোধিত করার উপায়
অতিবৃষ্টি ও দুর্যোগপ্রবণ মৌসুমগুলোতে বন্যা একটি স্বাভাবিক বিষয়। আর বাংলাদেশে প্রতি বছর এই দুর্যোগটি রীতিমত মহামারির আকার ধারণ করে। ঘরবাড়ি, কৃষিজমি, শিল্প-কারখানাসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগুলো পানি দূষণের শিকার হয়। বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান, জ্বালানি, ব্যাকটেরিয়ার মত দূষকগুলো বন্যার পানির সঙ্গে খুব বেশি পরিমাণে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে খাবার পানি সরবরাহের ব্যবস্থাগুলো কয়েক সপ্তাহ ধরে বন্যার দূষিত পানিতে সম্পূর্ণরূপে প্লাবিত হয়ে থাকে। তাই এই সময়টিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় খাবার পানি পরিশোধিত করার বিষয়টি আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। আজকের নিবন্ধে আলোচনা বিষয় হচ্ছে খাবার পানির বিশুদ্ধকরণের নানা উপায় নিয়ে।
দূষিত পানি পান করার পরিণতি
দূষিত পানি ও দুর্বল পয়োঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা কলেরা, ডায়রিয়া, আমাশয়, হেপাটাইটিস-এ, টাইফয়েড ও পোলিওর মতো রোগের সংক্রমণ ঘটায়। অপর্যাপ্ত বা অনুপযুক্ত খাবার পানি সরবরাহের ব্যবস্থাগুলো এ সময় স্বাস্থ্যহানীকর রোগ জীবাণুর উৎসে পরিণত হয়। বাড়ি-ঘর ও হাসপাতালগুলোতে রোগী ও সেবা দানকারী উভয়েই সংক্রমিত এবং রোগাক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে একে অপরের জন্য ঝুঁকি হিসেবে কাজ করে। সেখানে স্বাস্থ্যবিধি পরিষেবার ঘাটতি থাকলে বিপদ আরও বাড়তে থাকে।
যেসব পোকামাকড় পানিতে বাস করে বা বংশবিস্তার করে তারা ডেঙ্গু জ্বরের মতো রোগ বহন করে। এই পোকামাকড়গুলো যে কোনো স্থানে জমে থাকা পানির মধ্যে বংশবৃদ্ধি করে।
পানিতে দূষিত পদার্থের উপস্থিতি অন্ত্র ও পাকস্থলিতে অসুস্থতা, প্রজনন সমস্যা ও স্নায়বিক ব্যাধিসহ নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে শিশু, অন্তঃসত্ত্বা, বয়স্ক, এইডস রোগী, কেমোথেরাপি বা ট্রান্সপ্লান্ট ওষুধের কারণে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেছে, তাদের জন্য দূষিত পানি হুমকি স্বরূপ।
আরও পড়ুন: আট বিভাগেই বৃষ্টির পূর্বাভাস
বন্যার সময় দূষিত পানি বিশুদ্ধ করার উপায়
পানি ফুটানো
পানি ফুটালে এতে থাকা ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও পরজীবীসহ রোগ-সৃষ্টিকারী জীবাণু মরে যায়। এই পানি সিদ্ধ করার কাজটি বিভিন্নভাবে করা যেতে পারে।
পানি ফুটতে শুরু করলে, প্রথমে একটি পরিষ্কার কাপড়, কাগজের তোয়ালে বা কফি ফিল্টার দিয়ে ছেকে নিতে হবে এবং ফুটন্ত পানিকে স্থির হতে দিতে হবে। এভাবে পাওয়া পরিষ্কার পানিকে এক মিনিটের জন্য আবার ফুটিয়ে নিতে হবে। ফুটন্ত বিশুদ্ধ পানি ঠান্ডা হওয়ার পর আঁটসাঁট কভারসহ পরিষ্কার স্যানিটাইজড পাত্রে তা সংরক্ষণ করতে হবে।
সিদ্ধ পানির স্বাদ ভালো করার জন্য এটি এক পাত্র থেকে অন্য পাত্রে ঢেলে কয়েক ঘণ্টার জন্য অপেক্ষা করা যেতে পারে। এছাড়া প্রতি লিটার সিদ্ধ পানিতে এক চিমটি লবণ যোগ করেও স্বাদ উন্নত করা যায়।
আরও পড়ুন: এবারের বর্ষায়ও ঢাকায় জলাবদ্ধতার আশঙ্কা, নেই কোনো স্থায়ী সমাধান
রাসায়নিক জীবাণুনাশক ব্যবহার
পানি ফুটানো সম্ভব না হলে রাসায়নিক জীবাণুনাশক যেমন গন্ধহীন ক্লোরিন ব্লিচ, আয়োডিন বা ক্লোরিন ডাই অক্সাইড ট্যাবলেট ব্যবহার করে অল্প পরিমাণ পানি পান করার জন্য নিরাপদ করতে পারেন। এগুলো বিভিন্ন আকারে পাওয়া যায় এবং নির্দিষ্ট পরিমাণে পানি চিকিৎসা করার জন্য তৈরি করা হয়ে থাকে।
জীবাণুনাশকগুলো বেশির ভাগ ক্ষতিকারক বা রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলতে পারে। কিন্তু ক্রিপ্টোস্পোরিডিয়াম ও গিয়ার্ডিয়ার মতো আরও প্রতিরোধী জীবাণু মারার জন্য এই পদ্ধতি কার্যকর নয়। এর জন্য পানি ফুটাতে হবে।
তবে ক্লোরিন ডাই অক্সাইড ট্যাবলেটগুলো ক্রিপ্টোস্পোরিডিয়াম ধ্বংস করতে পারে। কিন্তু এর জন্য ট্যাবলেটের লেবেল বা প্যাকেজে থাকা প্রস্তুতকারকের নির্দেশাবলী সঠিকভাবে অনুসরণ করতে হবে।
পানিতে ক্ষতিকারক রাসায়নিক বা তেজস্ক্রিয় উপাদান থাকলে সেখানে একটি জীবাণুনাশক যোগ করলেই তা পানযোগ্য হবে না। আয়োডিন দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা পানি গর্ভবতী নারীদের, থাইরয়েড সমস্যাযুক্ত ব্যক্তিদের বা আয়োডিনের প্রতি অতি সংবেদনশীলদের জন্য ক্ষতিকর। এটি ক্রমাগত ব্যবহারের করাও ঠিক নয়। একবারে সর্বোচ্চ কয়েক সপ্তাহ ব্যবহার করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন: দোয়ারাবাজারে কমেছে পানি, বাড়ছে দুর্ভোগ
ব্লিচ ব্যবহার
ব্লিচের বিভিন্ন ঘনত্বের হয়ে থাকে। ব্লিচ দিয়ে পানি জীবাণুমুক্তকরণ পদ্ধতি শুরুর আগে এর ঘনত্ব জানতে হবে। আর এটি পাওয়া যাবে ব্লিচের লেবেলে। একেক দেশে ঘনত্ব একেক রকম হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ব্লিচে সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইটের ঘনত্ব ৫ থেকে ৬ শতাংশ।
ব্লিচ দিয়ে জল জীবাণুমুক্ত করার জন্য প্রথমেই পানি ফুটিয়ে পরিষ্কার পানি আলাদা করে নিতে হবে।
সাধারণত খাবার পানি জীবাণুমুক্ত করার নির্দেশনা ব্লিচের লেবেলেই দেয়া থাকে। তবে তা না থাকলে, লেবেলে উল্লেখিত ‘সক্রিয় উপাদান’থেকে সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট শতাংশ নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে। তারপর একদম অতি সামান্য পরিমাণে ব্লিচ চা-চামচে নিয়ে বিশুদ্ধ পানির প্রতি লিটারে যোগ করতে হবে। মিশ্রণটি ভালো করে নাড়াতে হবে। এরপর কমপক্ষে ৩০ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। জীবাণুমুক্ত পানি পরিষ্কার ও স্যানিটাইজড পাত্রে শক্ত কভারসহ সংরক্ষণ করতে হবে।
আরও পড়ুন: হালদায় আশানুরূপ মাছের ডিম মিলছে না
ফিল্টার-এর মাধ্যমে পরিশোধন
কিছু পোর্টেবল ওয়াটার ফিল্টার আছে, যা খাবার পানি থেকে রোগ সৃষ্টিকারী পরজীবী যেমন- ক্রিপ্টোস্পোরিডিয়াম ও গিয়ার্ডিয়া দূর করতে পারে।
অধিকাংশ পোর্টেবল ওয়াটার ফিল্টার ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া অপসারণ করে না। তাই ফিল্টার নির্বাচনে বেশ সাবধানী হতে হবে। অধিক প্রতিরোধী পরজীবীগুলোকে অপসারণ করার জন্য ফিল্টারের ছিদ্রের আকার যথেষ্ট ছোট হতে হবে। আকারে যা প্রায় এক মাইক্রন বা তার থেকে ছোট। পানি ফিল্টারের সময় এর লেবেলে থাকা প্রস্তুতকারকের নির্দেশাবলী সতর্কতার সঙ্গে পড়ে অনুসরণ করতে হবে।
ফিল্টার করার পরে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার ধ্বংস নিশ্চিত করতে ফিল্টার করা পানিতে আয়োডিন, ক্লোরিন বা ক্লোরিন ডাই অক্সাইডের মতো জীবাণুনাশক যোগ করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন: তরমুজের বাম্পার ফলন হলেও খুলনার চাষিরা হতাশ
পাতন প্রক্রিয়া
পাতন একটি পানি বিশোধন পদ্ধতি, যেখানে মূলত তাপ ব্যবহার করে বাষ্প আকারে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করা হয়। এই পদ্ধতিটির কার্যকারিতা বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত। পানিতে থাকা অন্যান্য দূষিত এবং রোগ সৃষ্টিকারী উপাদানের তুলনায় পানি অল্প তাপেই ফুটতে শুরু করে। স্ফুটনাঙ্কে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত পানিতে তাপ দিতে হয়। তারপর এটি বাষ্পীভূত না হওয়া পর্যন্ত ফুটন্ত অবস্থায় রেখে দেয়া হয়। এই বাষ্প ঠান্ডা করার জন্য একটি কনডেন্সার ব্যবহার করা হয়। শীতল হওয়ার পরে বাষ্প পরিষ্কার এবং নিরাপদ পানযোগ্য পানিতে পরিণত হয়। উচ্চতর স্ফুটনাঙ্কযুক্ত অন্যান্য পদার্থগুলো পাত্রে পলি হিসেবে রেখে দেয়া হয়।
এই পদ্ধতি ব্যাকটেরিয়া, জীবাণু, লবণ এবং অন্যান্য ভারী ধাতু যেমন সীসা, পারদ এবং আর্সেনিক দূর করতে কার্যকর। পাতন কাঁচা ও অপরিশোধিত পানির জন্য আদর্শ পদ্ধতি। এই পদ্ধতির সুবিধা এবং অসুবিধা উভয়ই রয়েছে। একটি উল্লেখযোগ্য অসুবিধা হল এটি পানি বিশুদ্ধকরণের সব থেকে ধীর প্রক্রিয়া। উপরন্তু, এই পরিশোধন কাজটি করার জন্য একটি তাপীয় উৎস প্রয়োজন। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের সস্তা তাপীয় উৎস তৈরি হলেও পাতনের মাধ্যমে পানি বিশুদ্ধ করা এখনো ব্যয়বহুল প্রক্রিয়াই রয়ে গেছে। এটি অল্প পরিমাণে পানি বিশুদ্ধ করার ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী। বড় আকারের, বাণিজ্যিক বা শিল্প পর্যায়ে পানি পরিশোধনের জন্য এই পদ্ধতি আদর্শ নয়।
আরও পড়ুন: বাড়িরপাশে মরিচের আড়ৎ, ন্যায্য মূল্য পেয়ে খুশি কৃষক
সৌর জীবাণুমুক্তকরণ
জরুরি অবস্থায় পানির গুণমান উন্নত করতে এটি একটি আদর্শ পদ্ধতি। এখানে প্রথমে একটি পরিষ্কার প্লাস্টিকের বোতল পরিষ্কার পানি দিয়ে ভরতে হবে। যেহেতু ফুটন্ত পানিতে সৌর জীবাণুমুক্তকরণ কার্যকর নয়, তাই এভাবে পানি বিশোধন করার পূর্বে পানি ফুটিয়ে স্বচ্ছ পানি আলাদা করে নিতে হবে। এবার সূর্যালোক ব্যবহার করে সেই পানিকে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
রৌদ্রজ্জ্বল দিনে বোতলগুলো উন্মুক্ত অবস্থায় পাশাপাশি ৬ ঘণ্টা এবং মেঘলা দিনে দুদিন রেখে দিতে হবে। সূর্যের রশ্মির মাধ্যমে পানিকে আরও কার্যকরভাবে জীবাণুমুক্ত করার জন্য বোতলগুলোকে শুইয়ে রাখা যেতে পারে। বোতলগুলোকে কালো রঙের পৃষ্ঠতলের ওপরে রাখলে সূর্যের রশ্মিগুলি আরও কার্যকরভাবে পানিকে জীবাণুমুক্ত করতে পারবে।
পরিশেষে বলা যায়, বন্যার সময় খাবার পানি পরিশোধিত করতে হলে এই উপায়গুলো সঠিকভাবে জানা ও মানা জরুরি। বন্যা পরবর্তী সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি সারা দেশ জুড়ে জনসচেতনতা অপরিহার্য। যেহেতু এমন দুর্যোগ নতুন নয়, তাই এর জন্য পূর্বপ্রস্তুতি নেয়ার ক্ষেত্রে সবার এগিয়ে আসা জরুরি। প্রতি বছর একই ভুলের পুনরাবৃত্তি যেন না হয় সে জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ প্রত্যেক ব্যক্তিকে সতর্ক থাকতে হবে। তবেই গনমাধ্যমগুলোতে প্রতি বছর বন্যাকালীন একই দুঃসংবাদের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। নিদেনপক্ষে বন্যার ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
আরও পড়ুন: মোবাইল ফোন পানিতে পড়ে গেলে করণীয়
২ বছর আগে