বাংলাদেশের জাতীয় ভোক্তা অধিকার আইন
পণ্য, সেবা ক্রয়ে প্রতারিত হলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার আইনে অভিযোগ করার উপায়
দেশে নতুন পণ্য বা সেবা তৈরির মাধ্যমে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থনীতিকে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যায়। আবার একই ভাবে অনিয়ম ও অনৈতিকতার কারণে ত্রুটিপূর্ণ সেবা বা পণ্য কিনে প্রতারণার শিকার হন ভোক্তারা। তাই প্রতিটি ব্যবসায়ের পণ্যের মান নিশ্চিত করার জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট নীতিমালা। আর তা অনুসরণ করে গ্রাহকদের চাহিদার সদ্ব্যবহার করা হচ্ছে কি না তা তদারক করতে আছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার আইন। যে কোন পণ্য কিনে প্রতারিত হলে একজন বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে ভোক্তা সেই আইন মোতাবেক অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন। চলুন জেনে নেয়া যাক এই অভিযোগ দাখিলের নিয়ম-নীতি।
বাংলাদেশের জাতীয় ভোক্তা অধিকার আইনে অভিযোগ করার পদ্ধতি
যথাযথ প্রমাণ সংগ্রহ
অভিযোগের পূর্বে যে কাজটি অবশ্যই করতে হবে তা হলো অভিযোগের স্বপক্ষে সঠিক প্রমাণাদি সংগ্রহ করা। অভিযোগপত্রের সাথে সংযুক্তি হিসেবে পণ্য বা সেবা গ্রহণের রশিদটি অবশ্যই দিতে হবে। এর পাশাপাশি পণ্য ও দোকানের ছবিটিও দেয়া যেতে পারে।
আরও পড়ুন: গরমকালে কম খরচে বাংলাদেশের কোথায় কোথায় ঘুরতে যাবেন?
অভিযোগ ফরম পূরণ
প্রথমে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট-এর জাতীয় ভোক্তা অভিযোগ-কেন্দ্র বক্স থেকে অভিযোগ ফরম ডাউনলোড করতে হবে। অতঃপর ফরমটি প্রিন্ট করে তাতে প্রাপক অংশের শূন্যস্থানে জেলার নাম লিখতে হবে।
তারপরেই সঠিকভাবে লিখতে হবে অভিযোগের বিবরণ। এরপর পিতা-মাতার নামসহ অভিযোগকারির পূর্ণাঙ্গ তথ্য উল্লেখ করতে হবে। এ অংশে অভিযোগকারির মোবাইল নম্বর দেয়া বাঞ্ছনীয়। সবশেষে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের পূর্ণ নাম ও ঠিকানা লেখার মাধ্যমে ফরম পূরণ সম্পন্ন হবে।
এবার পূর্বে সংগৃহীত পণ্য ক্রয়ের রশিদটি এই ফরমের সঙ্গে সংযুক্তি হিসেবে দিতে হবে।
আরও পড়ুন: ভোক্তার সচেতনতা নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে ভূমিকা রাখবে: খাদ্যমন্ত্রী
পণ্য কিনে প্রতারিত হলে কোথায় অভিযোগ করতে হয়
সংযুক্তিসহ পূরণকৃত ফরম নিয়ে সরাসরি চলে যেতে হবে কাওরান বাজারে অবস্থিত টিসিবি (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) ভবনে। এর অষ্টম তলায় সহকারী পরিচালকের কার্যালয়ে অভিযোগ জমা নেয়া হয়। এছাড়া জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবরও অভিযোগ করা যায়। এই দাখিলকৃত অভিযোগপত্র পরবর্তীতে বিভাগীয় প্রধান অধিদপ্তরে এসে জমা হয়। এখানে উল্লেখ্য যে এই অভিযোগ দাখিলে কোন রকম ফি প্রয়োজন হয় না।
অভিযোগ নিষ্পত্তিকরণ
অভিযোগ দাখিলের পর অধিদপ্তর থেকে একটি মামলা নম্বর দেয়া হবে, যা পরবর্তীতে অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজন হবে। অতঃপর প্রায় এক মাসের মধ্যে শুনানির জন্য অভিযোগকারির ঠিকানায় চিঠি যাবে। আর এই শুনানির মাধ্যমেই চূড়ান্তভাবে অভিযোগ নিষ্পত্তির দরুণ অভিযুক্তকে সংশ্লিষ্ট অভিযোগ যাচাই করে নির্ধারিত জরিমানা ধার্য করা হয় এবং নির্দিষ্ট শাস্তি প্রদান করা হয়। জরিমানার ২৫ শতাংশ অভিযোগকারিকে দেয়া হবে।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের বাহারি আম এবং তাদের উৎপাদনকারী অঞ্চল
পণ্য কিনে প্রতারিত হলে কিভাবে অনলাইনে অভিযোগ করবেন
সংযুক্তির জন্য নথি প্রস্তুত করা
অভিযোগকারির স্বাক্ষর, পণ্য ক্রয়ের রশিদসহ প্রয়োজনীয় প্রমাণাদি স্ক্যান করে অথবা মোবাইল দিয়ে ছবি তুলে কম্পিউটারে সংরক্ষণ করতে হবে। এগুলো আগে থেকেই প্রস্তুত করে রাখা উচিত, কেননা তা হলে অনলাইনে অভিযোগ পূরণের পরপর খুব সহজেই কম্পিউটার থেকে আপলোড করে দেয়া যাবে।
আমার সরকার ওয়েবসাইটে নিবন্ধন
অনলাইনে অভিযোগের জন্য আমার সরকার ওয়েবসাইটের জাতীয় ভোক্তা অধিকার অভিযোগ সেবার পেজটিতে যেতে হবে। এখানে অভিযোগকারির নাম ও মোবাইল নম্বর বা ইমেইল আইডি দিয়ে নিবন্ধন করতে হবে। মোবাইল বা ইমেইল আইডিটি যাচাইয়ের জন্য ছয় সংখ্যার একটি কোড বার্তা পাঠানো হবে। সেই কোড দেয়ার পর নিবন্ধন সম্পন্ন হলে অনায়াসেই অভিযোগকারি তার নতুন তৈরি হওয়া অ্যাকাউন্টে লগইন করতে পারবেন।
আরও পড়ুন: জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কিছু বোঝা ভোক্তাদের বহন করতে হবে: অর্থমন্ত্রী
অনলাইনে অভিযোগ ফরম পূরণ
এবার অভিযোগকারির প্রোফাইল পেজ-এর বামে প্রদর্শিত মেনু থেকে নতুন আবেদন-এ ক্লিক করলে জাতীয় ভোক্তা অভিযোগ ফরমের ওয়েব পেজটি দেখাবে। আগে থেকে অভিযোগকারির যাবতীয় তথ্য দিয়ে প্রোফাইলটি সম্পন্ন করা থাকলে এখানে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই অভিযোগকারির তথ্য অংশগুলো পূরণ দেখাবে। আর তা না হলে নাম, ঠিকানা, পেশা, পিতা-মাতার নাম টাইপ করতে হবে।
অতঃপর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ তথা অভিযোগের বর্ণনা দিতে হবে। এরপরেই নিচে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের নাম ও ঠিকানা বক্স দুটি পূরণ করতে হবে।
সংযুক্তি আপলোড ও অভিযোগ দাখিল
বিনীত নিবেদকের নিচে অভিযোগকারির নামের পাশে ছোট্ট বাটনটিতে ক্লিক করে পূর্বে কম্পিউটারে সংরক্ষণকৃত স্বাক্ষরের ছবিটি সংযুক্ত করতে হবে। পরিশেষে পণ্য ক্রয়ের রশিদের ছবি সহ অন্যান্য প্রমাণাদি আপলোড করতে হবে। এরপর সবার নিচে আবেদন প্রেরণ করুন বাটনে ক্লিক করলেই চূড়ান্ত ভাবে অভিযোগটি দাখিল হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন: রাতে হাইওয়েতে গাড়ি চালানোর সময় প্রয়োজনীয় কিছু সতর্কতা
পণ্য কিনে প্রতারিত হলে অভিযোগ করার শর্তাবলি
অভিযোগটি সংশ্লিষ্ট কারণ উদ্ভব হওয়ার ত্রিশ দিনের মধ্যে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অথবা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট দাখিল করতে হবে। নতুবা অভিযোগটি নাকচ করে দেয়া হবে।
অভিযোগকারী অধিদপ্তরের কোনো কর্মকর্তা হলে তিনি দোষী সাব্যস্ত অভিযুক্তের নিকট থেকে আদায়কৃত জরিমানার ২৫ শতাংশ পাবেন না।
পণ্য ক্রয়ে হয়রানির শিকার হলে অভিযোগের অন্যান্য মাধ্যম
পণ্য বা সেবা কিনে হয়রানির শিকার হলে ভোক্তা ফ্যাক্স, ইমেইল, এমনকি ফোনের মাধ্যমেও অভিযোগ জানাতে পারবেন। যোগাযোগের ফোন নম্বর- ০২৫৫০১৩২১৮, মোবাইল- ০১৭৭৭৭৫৩৬৬৮ এবং ইমেইল- [email protected]। এছাড়া ভোক্তা হটলাইন ১৬১২১ নাম্বারে ফোন করেও নির্দেশনা সমূহ অনুসরণ করে অভিযোগ দায়ের করা যাবে।
আরও পড়ুন: নিত্যপণ্যের লাগামহীন দামে নাকাল ভোক্তারা
শেষাংশ
জাতীয় ভোক্তা অধিকার আইনে অভিযোগের উপায় প্রতিটি নাগরিকের গণতন্ত্র চর্চার পরিচায়ক। জনসাধারণের মৌলিক চাহিদাগুলোর অপব্যবহার করে অসাধু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো ত্রুটিযুক্ত পণ্যগুলো তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। এতে প্রায়ই অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় সত্ত্বেও ক্রয়কৃত পণ্য নিয়ে বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয়। এতে শুধু জনগণের মৌলিক অধিকার ব্যহত হচ্ছে তা-ই নয়, একই সাথে তারা আর্থিক, সময় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যগত দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইতোমধ্যে নির্ধারিত আইনের সঠিক ও সক্রিয় প্রয়োগই পারে এ থেকে জনগণকে রক্ষা করতে।
২ বছর আগে