উচ্চ রক্তচাপের জন্য ক্ষতিকর খাবার
উচ্চ রক্তচাপ (হাই প্রেশার) হলে যা এড়িয়ে চলা উচিত: ক্ষতিকর খাবার, পানীয়, অভ্যাস
উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেশার একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা, যেখানে রক্তচাপ স্বাভাবিক মাত্রা অপেক্ষা বেশি হয়ে থাকে। প্রতিটি মানুষের নিত্য-নৈমিত্তিক কার্যকলাপের উপর ভিত্তি করে তার রক্তচাপের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এই পরিবর্তন কখনো এতটাই জটিল আকার ধারন করে যে, মানবদেহের ভেতরে ধমনীর প্রাচীরে দীর্ঘ সময় ধরে অতিরিক্ত রক্তচাপের সৃষ্টি হয়। একটি স্বাভাবিক রক্তচাপের মাত্রা প্রতি পারদ চাপে ১২০/৮০ মিলিমিটারের মধ্যে থাকে। রক্তচাপকে এই মাত্রার মধ্যে রাখার জন্য কিছু কিছু খাবার ও পানীয়ের পাশাপাশি কিছু ক্ষতিকর অভ্যাস পরিত্যাগ করা জরুরি। চলুন, সেই করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক।
উচ্চ রক্তচাপে যে খাবারগুলো এড়িয়ে চলা উচিত
লবণযুক্ত খাবার
উচ্চ রক্তচাপে সবচেয়ে ক্ষতিকর ভূমিকা হচ্ছে লবণের, যার প্রধান উপাদান সোডিয়াম। বেশিরভাগ চিপস, ক্র্যাকার এবং পপকর্ন সোডিয়ামে ভরপুর থাকে। ১-আউন্স প্লেইন পটেটো চিপসে সোডিয়ামের পরিমাণ প্রায় ৫০ থেকে ২০০ মি.গ্রা. (মিলিগ্রাম)। একজন প্রাপ্তবয়স্কের দিনে ২,৩০০ মি.গ্রা. বা এক চামচের বেশি সোডিয়াম খাওয়া উচিত নয়। এছাড়াও যে লবণযুক্ত খাবারগুলো প্রায় খাওয়া হয় সেগুলো হলো- রুটি, পনির পিজা, স্যান্ডউইচ, প্রোসেস করা মাংস, স্যুপ, এবং টাকোস।
আরো পড়ুন: স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পিংক সল্ট বা হিমালয় লবণের উপকারিতা
চিনিযুক্ত খাবার
রক্তচাপ বাড়ানোর পেছনে কোন কোন ক্ষেত্রে চিনিযুক্ত খাবার লবণের চেয়েও বেশি প্রভাব ফেলতে পারে। চিনি প্রাপ্তবয়স্ক এবং শিশুদের ওজন বৃদ্ধিতে অবদান রাখে। অতিরিক্ত ওজন এবং স্থূলতা উচ্চ রক্তচাপের সম্ভাবনা বাড়ায়। এছাড়া উচ্চ ফ্রুক্টোজ কর্ন সিরাপ যুক্ত খাবার রক্তচাপ বৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ। এধরনের খাবারের মধ্যে প্রক্রিয়াজাত মিষ্টি, বিভিন্ন ধরনের প্যাকেটজাত খাবার, পিনাট বাটার অন্যতম।
ট্রান্স বা স্যাচুরেটেড ফ্যাটযুক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবার
একজন প্রাপ্তবয়স্কের জন্য নির্ধারিত দৈনিক ক্যালোরির ৫ থেকে ৬ শতাংশের বেশি ক্যালোরি স্যাচুরেটেড ফ্যাট থেকে আসা উচিত নয়। এধরনের খাবার এখন খুব বেশি দেখা যায় আর এর চাহিদাও দিন দিন বাড়ছে।
মিষ্টি খাবারের মধ্যে চকোলেট, টফি, কেক-পেস্ট্রি, পুডিং, এবং বিস্কুটে অনেক স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে। লাল মাংস যেমন গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষে মাংস, আর প্রক্রিয়াজাত মাংস যেমন সসেজ, বার্গার এবং কাবাবের মধ্যে এ ধরনের ফ্যাট প্রচুর পরিমাণে থাকে। রান্নার চর্বি যেমন মাখন, ঘি, হাসের চর্বি থেকেও এই ফ্যাট আসে। এছাড়া তেলের মধ্যে আছে নারকেল তেল এবং পাম তেল আর পূর্ণ চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত পণ্য, যেমন ক্রিম, দুধ, দই এবং পনিরও এধরনের খাবারের অন্তর্ভূক্ত।
আরো পড়ুন: হঠাৎ প্রেসার কমে গেলে করণীয়
সস এবং মশলাদার খাবার
যারা অতিরিক্ত মশলাদার খাবার পছন্দ করেন তাদেরকে সাবধান হতে হবে। অতিরিক্ত মশলা মানেই উচ্চ পরিমাণে চিনি বা সোডিয়ামের যোগান। অনেক সময় নোনতা স্বাদের না হওয়া সত্ত্বেও মশলাগুলোতে সোডিয়াম ভরপুর থাকতে পারে। বেশিরভাগ টিনজাত টমেটো সস ও কেচাপ, পাস্তা সস, টমেটোর রস, চিলি সস, ও সয়া সসে সোডিয়াম বেশি থাকে।
আচারযুক্ত খাবার
আচারযুক্ত খাবার লবণের একটি ভালো উৎস। আচার তৈরির প্রক্রিয়াটাই এমন যে, এখানে খাবার লবণের সাথে অন্যান্য স্বাদ বর্ধক উপাদান মিশিয়ে খাবার সংরক্ষণ করা হয়। এই কারণে আচারযুক্ত খাবারে প্রায়শই লবণের পরিমাণ বেশি থাকে। তাছাড়া খাবার লবণ যে কোন খাবারকে ক্ষয় হওয়া থেকে রক্ষা করে এবং এর মাধ্যমে খাবারটি দীর্ঘ সময় ধরে খাবারের উপযুক্ত থাকে। যাদের প্রায় আচার খাওয়ার অভ্যেস তাদের উচ্চ রক্তচাপের সম্ভাবনা বেশি।
আরো পড়ুন: মাইগ্রেনের ব্যথা কমানোর ঘরোয়া উপায়
উচ্চ রক্তচাপে যে পানীয়গুলো এড়িয়ে চলা উচিত
ক্যাফেইনযুক্ত পানীয়
ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় যেমন কফি, সোডা এবং এনার্জি ড্রিংক্স শরীরে অ্যাড্রেনালিন নিঃসরণের মাধ্যমে রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। অনেকেরই সাত সকালে ক্যাফেইন নেয়ার অভ্যেস আছে। এ বিষয়টি তাদের খেয়াল রাখা উচিত যে ক্যাফেইন গ্রহণটি নিমেষেই আসক্তিতে পরিণত হতে পারে।
আর ইতোমধ্যে যারা কফির প্রতি আসক্ত তাদের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য এখনি সাবধান হতে হবে। কেননা এক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের ঘটনাগুলো প্রথমে অস্থায়ী থাকে তারপর ধীরে ধীরে জটিল সমস্যার সৃষ্টি করবে। সারাদিনে একবার এক কাপ কফি তেমন ক্ষতিকর কিছু নয়। তবে কফি দিয়ে দিন শুরুর পর দুপুরের খাবারের সাথে ক্যাফেইনযুক্ত সোডা এবং বিকেলে এনার্জি ড্রিংক নেয়া সব মিলিয়ে দিনটিতে বিপজ্জনক মাত্রার ক্যাফেইন সরবরাহ করতে পারে।
চিনিযুক্ত পানীয়
লেবুর শরবতে হালকা চিনি তেমন ক্ষতিকর নয়। এমনকি সপ্তাহে দু’একবার চিনি একটু বেশি দিয়ে কোন মিষ্টি শরবত পান করাটা সমস্যা করবে না। কিন্তু শরীরে চিনির এই প্রবেশটা নিয়মিত হতে থাকলে রক্তচাপের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। এমনকি, অনেক চিনিযুক্ত পানীয়তে ক্যাফেইন থাকে, যা রক্তচাপকে অতিরিক্ত মাত্রায় বাড়িয়ে তুলতে পারে। উচ্চ ফ্রুক্টোজ কর্ন সিরাপযুক্ত সোডা এবং ফলের রস এই পানীয়ের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত।
আরো পড়ুন: মধু কি সত্যি অমৃত?
দোকানের স্যাকারিন দেয়া ফলের জুসগুলো সাময়িকভাবে গলা ঠান্ডা করলেও তা সামগ্রিকভাবে শরীরকে দুর্বল করে ফেলে। প্রতিদিন যে কোন কাজে বা খেলাধুলার সময় এগুলোর একটি করে পান করা শরীরে প্রচুর চিনির যোগান দেয়। ফলে বেশ স্বল্প হারে বাড়তে থাকে রক্তচাপ। এরকম মিষ্টি স্বাদের জুস বা কার্বনেটেড পানীয় দিনে ৩৫৫ মিলিলিটারের বেশি পান করা মানেই শরীরে রক্তচাপের ভারসাম্য নষ্ট করা।
অ্যালকোহল
অত্যধিক অ্যালকোহল সেবন নিশ্চিত ভাবে রক্তচাপের মাত্রা ছাড়িয়ে দিতে পারে। যারা রক্তচাপ সহ অন্যান্য রোগের জন্য নিয়মিত ঔষধ খাচ্ছেন তাদের শরীরের জন্য অ্যালকোহল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। কারণ অ্যালকোহল ওষুধগুলোকে রোগ প্রতিরোধে সক্রিয় হতে দেয় না। এভাবে একসময় ঔষধগুলো কার্যকারিতা হারায়।
সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হলো, ঔষধগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া শরীরে থেকে যাওয়ার দরুণ ঔষধ খাওয়ার ফলে উল্টো হিতে বিপরীত ঘটে। এছাড়াও অনেক অ্যালকোহলযুক্ত পানীয়তে চিনি এবং ক্যালোরির পরিমাণ এতটাই থাকে যে, তা অতিরিক্ত ওজন এবং স্থূলতার কারণ হয়ে দাড়ায়। এ সবকিছু একত্রে উচ্চ রক্তচাপের দিকে ধাবিত করে।
আরো পড়ুন: ডায়রিয়া বা উদরাময়: কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উপায়
উচ্চ রক্তচাপের সময় যে অভ্যাসগুলো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে
অতিরিক্ত ওজন এবং পর্যাপ্ত ব্যায়ামের অভাব
যারা নিজেদের অতিরিক্ত ওজন নিয়ে ভাবছেন না তাদের জন্য রক্তচাপ অনাকাঙ্ক্ষিত সংবাদ নিয়ে আসতে পারে। একটি স্বাস্থ্যকর ওজন শুধু উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণই করে না; পাশাপাশি অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যারও সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। নিয়মিত শরীরচর্চা এরকমাত্র উপায় এই স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখার। একটি প্রাপ্তবয়স্ক দেহে প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে আড়াই ঘন্টা মাঝারি ব্যায়ামের চাহিদা থাকে। অল্প সময়ের জন্য ম্যারাথন হাঁটা হৃদপিণ্ডের স্পন্দন দ্রুত করে এবং ফুসফুসে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি অক্সিজেন প্রবেশ করে।
ধূমপান
প্রতিটি সিগারেট ধূমপান শেষ করার পর কয়েক মিনিটের জন্য রক্তচাপ বাড়ায়। এভাবে ঘন ঘন ধূমপান রক্তচাপ বাড়ানোর বিরতিটাকে কমিয়ে এনে বিপদের কারণ হতে পারে। তাই বলে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ধূমপান মানে এই নয় যে সে সময়টাতে ফুসফুস আবার তার আগের সুস্থতায় ফিরে আসবে।
আরো পড়ুন: এয়ার কন্ডিশনার ছাড়াই গরমে ঘর ঠান্ডা রাখার কার্যকরী উপায়
অল্প ধূমপানও ধীরে ধীরে উচ্চ রক্তচাপের অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করে। এতে তাৎক্ষণিকভাবে মারা না গেলেও জীবনের আয়ু তো কমেই; পাশাপাশি শেষ বয়সে বিধ্বস্ত ফুসফুস নিয়ে মৃত্যুর দিন গুণতে হয়। যারা কখনো ধূমপান ছাড়েন নি, তাদের চেয়ে যারা ধূমপান ত্যাগ করেন তারা বেশি দিন বাঁচতে পারেন।
দীর্ঘ সময় যাবত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকা
দুশ্চিন্তা শুধুমাত্র মানসিক সমস্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর দৈহিক প্রভাবও বেশ ভয়াবহ। সবচেয়ে বড় ফলাফল হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ। আর এটিই দেহের মধ্যে অনেক বিপজ্জনক রোগের ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে পারে। অনেকে দুশ্চিন্তার কারণে অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, অ্যালকোহল পান বা ধূমপানের দিকে অগ্রসর হন। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই সারা দেহ উচ্চ রক্তচাপের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। জীবনের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব, বদরাগ, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাও দুশ্চিন্তার সাথে সম্পৃক্ত। এগুলোর কারণেও রক্তচাপ দীর্ঘ সময় ধরে মাত্রাতিরিক্ত অবস্থায় থাকতে পারে।
শেষাংশ
উচ্চ রক্তচাপের সময় ক্ষতিকর খাবার ও পানীয়গুলো এড়িয়ে চললে রক্তচাপকে স্বাভাবিক মাত্রার মধ্যে নিয়ে আসা সম্ভব হবে । এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে এই উদ্যোগকে ফলপ্রসু করতে প্রয়োজন জীবন ধারণ পদ্ধতি তথা কিছু উপরোক্ত অভ্যাসগুলো পরিত্যাগ করা। এ কথা অনস্বীকার্য যে, রাতারাতি সুস্বাস্থ্যের অধিকারি হওয়া সম্ভব নয়। এখানে প্রয়োজন দীর্ঘ দিনের পরিশ্রম, ধৈর্য্য ও আত্মবিঃশ্বাস। যৌবন থেকে বার্ধক্যে পদার্পণের পরেও সুস্থ দেহ ও মন নিয়ে দিন যাপনে স্বাস্থ্যচর্চার কোন বিকল্প নেই।
আরো পড়ুন: ‘মাত্রাতিরিক্ত গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ সেবনের ফলে ৪৫ শতাংশ গ্যাস্ট্রিক আলসার হয়’
২ বছর আগে