বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বে খাবার সংরক্ষণ
বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বেই যেসব খাবার সংরক্ষণ করা জরুরি
বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের সময় বা পরবর্তী অবস্থায় খাবারের চাহিদা পূরণের জন্য দুর্যোগের আগে থেকেই খাবার সংরক্ষণ জরুরি। দুর্যোগ পরবর্তী বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে নিরাপদে থাকাটাই কঠিন। সেখানে খাবারের ব্যবস্থা করার কোন অবকাশ থাকে না। তবে পূর্বপ্রস্তুতি থাকলে এই ধাক্কাটা অনেকাংশে সামলে ওঠা যায়। মুলত এ অবস্থায় সমূহ ক্ষতির কথা বিবেচনা করেই এগোতে হবে। কেননা এমন বিপজ্জনক পরিস্থিতি মোকাবেলা করা দুরূহ ব্যাপার। এরপরেও নিজের নিরাপদে টিকে থাকাটা সুনিশ্চিত করার জন্য বিকল্প উপায়গুলো অবলম্বন করলে বিপদ কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে। এই নিবন্ধে দুর্যোগ পূর্ববর্তী বিভিন্ন ধরনের খাবার সংরক্ষণের উপায়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে।
বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের আগে কোন ধরনের খাবার সংরক্ষণ করতে হবে
চিড়া-মুড়ি-খৈ
সহজলভ্য শুকনো খাবার মানেই চিড়া, মুড়ি আর খৈ। দুর্যোগ সহ যে কোন জরুরি অবস্থায় এই শুকনো খাবারগুলো সংরক্ষণ করতে হবে। যেহেতু দুর্যোগ পরবর্তী সময়ের জন্য যে সব খাবার বানানোর প্রয়োজন হয় না সে ধরনের খাবার সাথে রাখার দিকে গুরুত্ব বেশি দিতে হবে। সে দিক থেকে চিড়া, মুড়ি, খৈ উপযুক্ত খাবার হতে পারে। তাছাড়া এগুলো দীর্ঘ সময় ক্ষুধা লাঘব করতে সক্ষম।
মুড়ির মতো চিড়াও বেশ সহজলভ্য এবং এটি দীর্ঘ সময় পেট ভরিয়ে রাখতে সক্ষম।
আরো পড়ুন: প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় পশু-পাখির সুরক্ষা: বন্যা, খরা ও শৈত্য প্রবাহে করণীয়
আলু
সবজির মধ্যে দীর্ঘ দিন সঞ্চয় করে রাখার ক্ষেত্রে সর্বাধিক জনপ্রিয় হচ্ছে আলু। যুদ্ধ, বিভিন্ন দুর্ভিক্ষ পীড়িত সময়গুলোতে মানুষ আলু দিয়েই দিন যাপন করতো। শরীরে যথেষ্ট কার্বোহাইড্রেট যোগানের জন্য কোন পূর্ব প্রস্তুতি সহ রান্না করা ছাড়াই শুকনো খাবার হিসেবে আলুর বিকল্প নেই।
নারকেল, খেজুর ও বাদাম
শুকনো ফল হিসেবে সবচেয়ে উপকারি ফল হলো এই নারকেল, খেজুর ও বাদাম। এগুলো অনেক দিন ধরে খাবার যোগ্য থাকে এবং একই সাথে এগুলো খাওয়ার ফলে শরীরের শক্তি বৃদ্ধি হয়। এখানে নারকেল একই সাথে ক্ষুধা ও তৃষ্ণা দুটোই মিটাবে। পুরো এক বেলার ক্ষুধা নিবারণের জন্য একটি খেজুরই যথেষ্ট। আর তাতে যে কোন ধরনের বাদাম যোগ হলে পুরো আহারটিই পরিপূর্ণ হয়ে যায়। তাছাড়া এগুলো শিশুদের জন্যও বেশ পুষ্টিকর খাবার।
বিস্কুট ও গুড়
মুড়ি-চিড়া ও আলুর মত বিস্কুট এবং গুড় দুর্যোগের সময়ে ব্যবহারের জন্য সার্বজনীন খাবার। ক্ষুধা নিবারণের পাশাপাশি খাবারে রুচির ভিন্নতা আনতে সহায়তা করে এই খাবারগুলো। গুড় দিয়ে চটজলদি শরবত বানিয়ে নিয়ে তৃষ্ণা মেটানো যায়। খাবার দুটি একত্রে শরীর সতেজ রাখতে সাহায্য করবে। তবে বিস্কুট সংরক্ষণের সময় অবশ্যই এর মেয়াদ দেখে নিতে হবে। নতুবা মেয়াদোত্তীর্ণ বিস্কুট খেয়ে হিতে-বিপরীত ঘটতে পারে।
আরো পড়ুন: রাতে হাইওয়েতে গাড়ি চালানোর সময় প্রয়োজনীয় কিছু সতর্কতা
বিশুদ্ধ খাবার পানি ও ঔষধপত্র
বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের পর অন্যান্য খাবারের সাথে পানিরও সংকট দেখা দেয়। আর কমপক্ষে পানি না হলে এমন ভয়াবহ অবস্থায় টিকে থাকাটাই কঠিন হয়ে যায়। তাই পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে বিশুদ্ধ পানি সংরক্ষণের দিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
আরো একটি দরকারি জিনিস হলো খাবার স্যালাইন। বন্যার সময় স্বাভাবিক ভাবেই পেটে সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ অবস্থায় কমপক্ষে শরীরে পানির ঘাটতি পুরণের ব্যবস্থা রাখা বাঞ্ছনীয়। এর বাইরে সম্ভব হলে প্রাথমিক চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ওষুধ ও সরঞ্জামগুলো সংরক্ষণ করতে হবে। স্বাভাবিক ভাবেই দুর্যোগ পীড়িত অবস্থায় ফার্মেসিতে যেয়ে ঔষধ কেনার অবস্থা থাকবে না। তাই যে ঔষধগুলো চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অব্যাহত ছিলো, কমপক্ষে সেগুলো সংরক্ষণ করা যেতে পারে।
চাল-ডাল, লবণ
দুর্যোগের পরে যদি কোন ভাবে পানি গরম করার অবস্থা বিদ্যমান থাকে সে কথা ভেবে চাল-ডাল ও লবণ সংরক্ষণ করে রাখা যেতে পারে। তাহলে নিদেনপক্ষে ডাল-ভাত খাওয়া সম্ভব হবে।
আরো পড়ুন: বাংলাদেশের বাহারি আম এবং তাদের উৎপাদনকারী অঞ্চল
বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের আগে খাবার সংরক্ষণের উপায়
বাষ্পরুদ্ধ কৌটায় চিড়া-মুড়ি-খই ও বাদাম রাখা
সবচেয়ে ভালো কৌটার মুখে কাগজ দিয়ে তারপর মুখ লাগালে। কৌটার ভেতরে পলিথিনের ভেতরে রাখলে আরো নিরাপদ হবে। এভাবে কৌটার ভেতরে বাতাস ঢুকে চিড়া-মুড়ি-খই নরম হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি দূর হবে। এটি দীর্ঘ দিন চিড়া-মুড়ি-খই খাওয়ার যোগ্য রাখার একটা ভালো পদ্ধতি।
কাঠ, পেস্তা ও কাজু বাদাম সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়। তবে বাদামের কৌটা অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা জায়গায় রাখা ভালো।
শুকনো ঠান্ডা স্থানে আলু সংরক্ষণ
পানির সংস্পর্শে আলুতে পঁচন ধরে তাই আলু সংরক্ষণের জন্য শুকনো স্থান বাছাই করা উচিত। এ জন্য বাঁশের ঝুড়ি, ডোল ও মাটির যে কোনো পাত্র নির্বাচন করা যেতে পারে। প্রতিটি ক্ষেত্রে পাত্র অবশ্যই ঠান্ডা জায়গায় রাখতে হবে। আলুতে পোকার আক্রমণ প্রতিরোধে নিশিন্দা, নিম ও বিষ কাটালি পাতার গুঁড়ো আলুর স্তুপে মিশিয়ে দেয়া যায়। প্রায় সাত থেকে আট মাস আলু সংরক্ষণের জন্য এ পদ্ধতি বেশ কার্যকর।
আরো পড়ুন: এয়ার কন্ডিশনার ছাড়াই গরমে ঘর ঠান্ডা রাখার কার্যকরী উপায়
বিস্কুট ও লবণের বয়ামে চালের পুঁটলি রাখা
খোলা জায়গায় বিস্কুটের কুড়মুড়ে ভাবটা নিমেষেই নষ্ট হয়ে যায়। তাই বায়ুরোধী পাত্রে বিস্কুট রেখে ব্লটিং পেপার দিয়ে মুখ ভাল করে লাগিয়ে রাখতে হবে। এছাড়া অল্প কিছু চাল পুঁটলি বেঁধে বিস্কুটের সাথে রাখলে বিস্কুট সহজে নেতিয়ে যায় না।
লবণের পানি পানি হওয়া রোধ করতেও একই কাজ করা যেতে পারে। এভাবে দীর্ঘ দিন বিস্কুট ও লবণ ভালো রাখা যায়।
কিছু দিন পর পর গুড় রোদে দেয়া
বায়ুরোধী পাত্র ভর্তি পাটালি গুড় খুব গরমেও না আবার খুব ঠান্ডাতেও রাখা যাবে না। পাত্রের ভেতরে কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে রাখা যেতে পারে। দানাগুড় ও ঝোলাগুড়ের ভেতরে ভেজা চামচ ডোবানো যাবে না। সেগুলোর পাত্র কিছু দিয়ে ঢেকে অথবা মুখ বন্ধ করে রাখতে হবে। পাত্রের ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের বয়াম নির্বাচন করা যাবে না। গুড়ের স্বাদ ও গন্ধ বেশি দিন অটুট রাখার জন্য সিলভার বা কাঁচের পাত্র উত্তম। তবে যেভাবেই রাখা হোক না কেন, ফাঙ্গাসমুক্ত রাখতে কিছুদিন পর পর এই গুড় রোদে দিতে হবে।
আরো পড়ুন: কোন ধরনের আগুন কীভাবে নেভাবেন?
আস্ত নারিকেল সংরক্ষণ উত্তম
নারিকেল আস্ত রেখে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করাই সবচেয়ে সহজ। খোলা অবস্থায় সংরক্ষণ করতে ফ্রিজের প্রয়োজন হয়; তাও বেশিদিন এভাবে নারকেল ভালো রাখা সম্ভব হয় না। নারিকেলের পানি কাচের বয়ামে রাখা যেতে পারে। শুকনো নারিকেল সজ্জা অন্ধকার এবং অপেক্ষাকৃত শীতল জায়গায় বেশ কিছু দিন রাখা যেতে পারে। তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে নারিকেলের নষ্ট হওয়া সম্ভাবনা বাড়ে। আবার তাপমাত্রা যত কম হয়, ফল তত দ্রুত তার স্বাদ হারিয়ে ফেলে।
রুম টেম্পারেচারে বদ্ধ জায়গায় খেজুর রাখা
অন্যান্য শুকনো খাবারগুলো মত খেজুরও মুখবন্ধ বয়ামে সংরক্ষণ করতে হবে। সিল করা যায় এমন প্লাস্টিকের ব্যাগও খেজুর রাখার জন্য ভালো। তবে পাত্রগুলো যেন সরাসরি সূর্যের আলো না পায় বা চুলার আশেপাশে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। খেজুর অল্প ভেজা রেখে রুম টেম্পারেচারে সংরক্ষণ করা উত্তম।
চাল-ডালের পোকা নির্মুল
চালের ড্রামের মধ্যে কয়েকটি শুকনো মরিচ বা গোল মরিচ ফেলে রাখলে আর পোকা আসে না। এছাড়া নিমের ডাল-সহ কয়েকটি নিমপাতা চালে ডুবিয়ে রাখলে টানা কয়েক মাস চাল পোকামুক্ত থাকে। একই ভাবে তেজপাতা চালের পাশাপাশি মসুরের ডালের ক্ষেত্রেও বেশ ভালো কাজ করে।
আরো পড়ুন: বন্যার সময় খাবার পানি পরিশোধিত করার উপায়
মুগ ডালে উদ্ভিজ্জ তেল মাখিয়ে একটি মুখবন্ধ মাটির পাত্রে রেখে দেয়া যায়। পাত্রের ভেতর কয়েকটি শুকনো লাল মরিচ ও নিম পাতা ফেলে পাত্রটি সুতি কাপড় দিয়ে আবৃত করে রাখলে অনেক দিন ডাল ভালো থাকে। ইঁদুরের উৎপাত থেকে রক্ষা করতে চারপাশে তারের জালি ঘিরে রাখা যেতে পারে। বুটের ডাল ভালো রাখার জন্য মাঝে মধ্যে রোদে দিতে হয়।
পানির বিশুদ্ধকরণ ও ঔষধপত্র সংরক্ষণ
খাবার পানি আগে থেকে বিশুদ্ধ করে রাখাটাই উত্তম। অন্যথায় দুর্যোগের মুহুর্তে ফিটকিরি, ফিল্টারসহ পানি ফুটানোর অন্য ব্যবস্থাগুলো সংরক্ষিত রাখতে হবে। ঝড়ের পর বৃষ্টির পানি জমিয়ে তা পান করা যায়।
ঔষধপত্রগুলো বিশেষ করে খাবার স্যালাইন ঘরের একটু উচু স্থানে পোকামাকড়ের থেকে দূরে রাখতে হবে। জায়গাটি যেন অবশ্যই চুলা বা ঘরের অত্যধিক গরম জায়গা না হয়ে অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা হয়।
শেষাংশ
যে কোন পরিস্থিতিতে বিকল্প রাস্তাগুলো খোলা রাখলে জটিলতাগুলোর সাথে সংগ্রাম করে টিকে থাকা যায়। আর এই বিকল্প পথ তৈরি করার সবচেয়ে উপযুক্ত উপায় হলো প্রতিরোধ বা পূর্বপ্রস্তুতি। প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোতে তাৎক্ষণিকভাবে খাবারের ব্যবস্থা করার উপায় থাকে না। তাই বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের আগে থেকেই উপরোল্লিখিত খাবারগুলো সংরক্ষণ করে রাখলে দুর্যোগের প্রাক্কালে খাদ্যাভাব দূর করা যাবে। এমন দুর্যোগে নিজেকে নিরাপদে রাখার পরপরই প্রয়োজন পরে টিকে থাকার ব্যাপারটা। কেননা এ ধরনের দুর্যোগের ধাক্কা কয়েক দিন ধরে টেনে নিয়ে বেড়াতে হয়। এ অবস্থায় আগে থেকে সঞ্চিত খাবার এই দিনগুলোতে শরীর ও মন দুটোকে সবল রাখতে সাহায্য করবে।
আরো পড়ুন: ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ কেন, কীভাবে, কারা করেন
২ বছর আগে