ঈদুল আযহার শিক্ষা
মানবজীবনে পবিত্র ঈদুল আযহার শিক্ষা
পবিত্র হজ্জ্বের মৌসুমের সাথে সামঞ্জস্য রেখে হিজরি বর্ষপঞ্জির জিলহজ্জ্ব মাসের ১০ থেকে ১২ এই তিন দিন মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু কুরবানি করা হয়। এর মাধ্যমে মুসলমানগণ নিজের সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করে আত্মত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হন। একই সাথে প্রত্যেকের মধ্যে চেষ্টা থাকে অন্তরের পাশবিকতাকে ধ্বংস করে আত্মশুদ্ধি এবং খোদাভীতি অর্জনের। হযরত ঈসমাইল (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে নিজ পুত্রকে কুরবানি করতে উদ্যত হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর এই আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, ভয় ও ভালোবাসার উপহার স্বরূপ আল্লাহ তাঁর পুত্রকে নিরাপদে রেখে তার স্থানে একটি দুম্বাকে রেখে দেন। ফলে ঈসমাইল (আঃ)-এর ছুড়িতে দুম্বাটি জবাই হয়ে যায়। সেই দিন থেকে বিশ্বের প্রতিটি মুসলমানের ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আযহা। চলুন জেনে নেয়া যাক, পবিত্র ঈদুল আযহার তাৎপর্যপূর্ণ শিক্ষা দিয়ে জীবনকে কিভাবে সমৃদ্ধ করা যায়।
জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পবিত্র ঈদুল আযহার ১০টি শিক্ষা
ত্যাগ-তীতিক্ষা
পৃথিবীতে বড় বড় অর্জনগুলোর নেপথ্যে রয়েছে হাজারো আত্মত্যাগ। দানবাকৃতির স্থাপনাগুলোর মধ্যে নিহিত আছে শত শত শ্রমিকের ঘাম পানি করা কষ্ট। বিশ্ব জুড়ে প্রতিটি বিপ্লবের পেছনে রয়েছে লাখ লাখ বিসর্জনের গল্প।
জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হলেও প্রতিটি মানুষকে তার আরামপ্রদ দিনগুলোকে জলাঞ্জলি দিয়ে পরিশ্রম করে যেতে হয়। আর প্রতিটি পরিশ্রম মানেই ত্যাগ-তীতিক্ষা, যার শিক্ষা যুগ যুগ ধরে দিয়ে আসছে এই কুরবানির ঈদ। জীবনে চূড়ান্ত সফলতা পেতে হলে স্বস্তির জায়গাগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে হয়। ত্যাগ করতে হয় জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটিও। এখানে কুরবানির পশুটিও সেই বস্তুগুলোকে প্রতিনিধিত্ব করছে যেগুলো আঁকড়ে পড়ে থাকার জন্য সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌছা সম্ভব হচ্ছে না।
পড়ুন: পদ্মা সেতু কোরবানির আয়োজনে অভাবনীয় সুযোগ তৈরি করেছে: মন্ত্রী
আত্মশুদ্ধি
বাহ্যিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা একটি মানুষকে যেমন বিভিন্ন রোগ থেকে দূরে রাখে, মনের পরিচ্ছন্নতা তেমনি মানসিক শক্তি বাড়িয়ে তোলে। লোভ, হিংসা, অহঙ্কার, গীবত ইত্যাদি হচ্ছে মনের রোগ যেগুলো একটি মানুষকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দেয়।
ঈদে পশু জবাই দেয়া মানে মনের পশুকে হত্যা করা, যেটি এর ধারক মানুষটি সহ তার আশেপাশের সবাইকে ক্ষতি করতে পারে। এই পশুর বিনাশের ফলে মানুষের ভেতরে থাকা ভালো ও খারাপ সত্ত্বার মধ্যে শুধুমাত্র ভালো সত্ত্বাটাই বিরাজ করতে থাকে। এই ভালো সত্ত্বাটি মানুষকে প্রতিনিয়ত সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার দিকে ধাবিত করে। এভাবে তার জীবনে আসল শুদ্ধতা আসতে শুরু করে।
দায়বদ্ধতা
যে কোন কাজের ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতার অভাব থাকলে সেই কাজের প্রতি গুরুত্ব থাকে না। এই দায়বদ্ধতা আসতে পারে ভালবাসা থেকে, শ্রদ্ধা থেকে অথবা কোন নিয়ম মানা থেকে। মনুষ্য সমান মানেই কতগুলো সম্পর্কের সমষ্টি আর এই সম্পর্কগুলো টিকে থাকে দায়বদ্ধতার কারণে।
পড়ুন: ঈদুল আযহার বাংলা সিনেমা ২০২২: সিনেমাপ্রেমিদের ঈদ আনন্দ
একটি মানুষের সফলতা শুধু তার ব্যক্তিগত সাফল্য নয়। তার এই অর্জনের উপর নির্ভর করে তার আশেপাশের মানুষগুলো। তাই সে যখন তা ভুলে যায় তখন তা শুধু তার সাফল্যের পথেই বাধা নয়, সেই মানুষগুলোর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যকে অবহেলা করার শামিল। কুরবানির জন্য উপযুক্ত প্রতিটি মুসলমানকে কুরবানি যথাযথভাবে পালন না করার জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। আর এভাবেই কুরবানির ঈদ দায়বদ্ধতার শিক্ষা দেয়।
সম্পদের সমবন্টন
কুরবানির মাংস সমভাবে তিন ভাগ করতে হয়। এক ভাগ ফকীর-মিসকিনের জন্য, এক ভাগ আত্মীয়- স্বজনের এবং এক ভাগ নিজের জন্য। এখানে কোন এক ভাগে বেশি দেয়ার নিয়ম নেই। অবশ্য কেউ চাইলে নিজের ভাগটুকু ফকীর-মিসকিন ও আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে বিলিয়ে দিতে পারেন। তবে সেখানে পরিবারের সকলের সম্মতি থাকতে হবে। কারণ পরিবারের হক নষ্ট করা ঠিক নয়।
এই বন্টন পদ্ধতি শুধু এই ঈদের জন্য নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বন্টনের সময় সমতা বিধানের তাগিদ দেয়। যে কোন পণ্য বিনিময়ের সময় ক্রেতা-বিক্রেতা কিংবা দাতা-গ্রহীতা উভয়কে খেয়াল রাখতে হবে যেন লেনদেনে কোন ত্রুটি না থাকে।
পড়ুন: কোরবানির হাট মাতাবে ‘সম্রাট’ ও ‘ট্রাম্প’
গরীব-দুঃখীদের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি
গরীবদের কথা উপেক্ষা করা হলে কোন ঈদ-ই সঠিক ভাবে পালন করা হবে না এবং এর জন্য গুণাহগার হতে হবে। কুরবানির মাংসের এক ভাগ তো আছেই, পাশাপাশি দান-সাদকা করার কথাও বলা হয়েছে। যারা একবেলা আহার যোগাড় করাই কষ্টসাধ্য ব্যাপার তাদের মুখে খাবার তুলে দেয়ার মাধ্যমে ঈদের খুশী ছড়িয়ে দেয়াটাই ঈদের মুল বার্তা।
হত-দরিদ্র মানুষের একবেলা চাল যোগাড়ে যেখানে সমস্যা সেখানে মাংস কিনে খাওয়ার কথা তারা চিন্তাও করতে পারে না। তারা ঈদুল আযহার এই দিনটির জন্য রীতিমত অপেক্ষা করে থাকে। তাই নিজের ভাগে মাংস বেশি পড়লো কিনা এবং লোক দেখানো কুরবানি এসব কিছু বাদ দিয়ে গরীব-দুঃখীদের পাশে দাড়ালে ঈদের আসল উদ্দেশ্য হাসিল হবে।
সামাজিকতা
কুরবানির ঈদের কার্যক্রমগুলোর জন্য অনেকগুলো হাত একত্রিত হয়। কুরবানির জন্য পরিকল্পনা থেকে শুরু করে মাংস বন্টন পর্যন্ত কাজগুলো একের পক্ষে করা সম্ভব হয় না। এভাবে এই ঈদটি মানুষকে পরস্পরের কাছে আনে। পুরনো ঝগড়া-বিবাদ ভুলে প্রতিটি প্রাণে সৌহার্দ্য ও সহমর্মিতা ছড়িয়ে দেয়।
পড়ুন: কোরবানির পশু কেনাবেচায় ডিজিটাল হাট চালু
কেউ একা পুরো একটা পশু কুরবানি দিতে অপারগ হলে প্রয়োজনে সে অন্যদের সাথে বড় পশু কুরবানিতে শরীক হতে পারে। এতে শরীক হওয়া প্রত্যেকে সমান ভাবে কুরবানির নেকী অর্জন করতে পারে। এই সম্মিলিত হওয়ার রেশ থেকেই ঈদ পরবর্তী বিভিন্ন সাহায্য-সহযোগিতায় একে অপরের দিকে এগিয়ে আসে।
নিয়মানুবর্তিতা
ঈদে প্রতিটি ক্রিয়াকলাপ কিছু সুনির্দিষ্ট পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে পালন করতে হয়। ঈদের পশু নির্বাচন, ঈদের নামায আদায়, পশু কুরবানি, মাংস বন্টন সবকিছুর জন্য সঠিক সময় ও পদ্ধতি আছে। এর বাইরে কেউ নিজের খেয়াল-খুশী মত এই কাজগুলো সম্পন্ন করতে গেলে ঈদুল আযহার আসল লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে না। এই পদ্ধতিগুলো কারো উপর বোঝা নয়, বরং প্রতিটি মুসলমান নিজেদের সাধ্য মত এগুলো পালন করতে পারে।
এভাবে ঈদুল আযহা জীবনের প্রতিটি কাজে নিয়ম মেনে চলার শিক্ষা দেয়। প্রতিটি কাজে সফলতা পাবার মুলমন্ত্র হচ্ছে সেই কাজের প্রাসঙ্গিক নিয়মগুলোর বাইরে না যেয়ে তা সঠিকভাবে মেনে চলা।
পড়ুন: ঈদ উপলক্ষে ১ লাখ ৩০০ মেট্রিক টন ভিজিএফ চাল বরাদ্দ
হালাল উপার্জন
যে কোন স্বাভাবিক জ্ঞানসম্পন্ন ও প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তার উপর কোরবানি দেওয়া ওয়াজিব। সম্পূর্ণ যাকাতের ন্যায় এই নিসাব পরিমাণটি হলো সাড়ে ৭ ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে ৫২ ভরি রুপা কিংবা এর সমতূল্য বিক্রয়ের জন্য প্রস্তুতকৃত পণ্য। এমনকি সেই সমমূল্যের নগদ টাকা কারো কাছে থাকলে তিনি কুরবানি দেয়ার জন্য উপযুক্ত হবেন। এই পরিমাণটি খাদ্য, বাসস্থান এবং উপার্জনের উপকরণের বাইরে হতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই সমমূল্যের অর্থ অবশ্যই হালাল উপার্জনের হতে হবে। নতুবা হারাম উপার্জনের টাকা থেকে কুরবানি আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য হয় না।
পরিকল্পনা মাফিক ব্যবস্থাপনা
যে কোন কাজ সম্পন্ন করা যেমন কাজটির জন্য পূর্ব পরিকল্পনার সাথে জড়িত ঠিক তেমনি কাজের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে প্রয়োজন সঠিক ব্যবস্থাপনা। বছর ঘুরে মাত্র একবার আসে ঈদুল আযহা। আর তাই এর জন্য আগে থেকে প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে।
পড়ুন: ঈদুল আযহা: মহামারির মধ্যে নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে অনলাইনে গরু ক্রয়
হিসেবের সংসারে প্রতি মাসের খরচ থেকে কুরবানির জন্য টাকা বাঁচিয়ে রাখা এই পরিকল্পনার অন্তর্ভূক্ত। আর এই পরিকল্পনার মাধ্যমেই স্পষ্ট হয় একজন মুসলমান কতটা গুরুত্বের সাথে কুরবানির ঈদকে গ্রহণ করছেন। অতঃপর কুরবানির পশু কেনা, কুরবানির কসাই ঠিক করা, কুরবানির পরবর্তী পরিস্কার করণ, মাংস বন্টন প্রভৃতির জন্য পূর্ব পরিকল্পনা থাকা দরকার। এভাবে জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে পথ দেখায় এই ঈদ।
মিতব্যয়ীতা
লোক দেখানো কুরবানি বা কুরবানির পশুর পিছনে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করা যেমন অপচয়ের শামিল, তেমনি দায়সাড়া গোছের পশু ক্রয় করাও ঠিক নয়। বাজার দর যাচাই করে, বিক্রেতা যেন প্রতারিত না হয় এবং একই সাথে অন্যদেরও যেন পশু কিনতে সুবিধা হয় সেদিকে লক্ষ রেখে কুরবানির পশু কিনতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়তা অর্থাৎ যতটুকু না হলেই নয় সেদিকে গুরুত্ব দিলে অপচয় রোধ করে পশু ক্রয় সম্ভব হবে।
তাছাড়া পশু ক্রয়ে খরচকৃত টাকা এবং পশুর রক্ত-মাংস নয়; এখানে আল্লাহর নির্দেশ পালনটাই আসল। এভাবে নিত্য-নৈমিত্তিক লেনদেনে মিতব্যয়ী হওয়ার শিক্ষা পাওয়া যায়।
পড়ুন: ঈদুল আজহা: হাটের জন্য প্রস্তুত ঠাকুরগাঁওয়ের ‘বারাকাত’
পরিশিষ্ট
এভাবে পবিত্র ঈদুল আযহার শিক্ষা শুধু ধর্মীয় দিক থেকে নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষকে উপকৃত করতে পারে। তাই কুরবানির যথাযথ ভাব গাম্ভীর্য অনুসারে এর কার্যকলাপগুলো পালিত হচ্ছে কিনা সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা বাঞ্ছনীয়। আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রদর্শন, অর্থের অপচয়, গরীব-দুঃখীদের উপেক্ষা করা এবং কুরবানির পশুকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থেকে কুরবানির আসল উদ্দেশ্যের প্রতি খেয়াল করা উচিত। অন্যথায় এত ঘটা করে পালিত উৎসবের কোন অর্থ তো থাকবেই না, বরং আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবেন। সর্বপরি, আত্মত্যাগ ও খোদাভীতিকে সামনে রেখে শুধু প্রয়োজনীয়তাটুকুতে গুরুত্বারোপ করলে ঈদুল আযহার উদ্দেশ্য হাসিল সম্ভব হবে।
২ বছর আগে