ফ্ল্যাট বাসা ক্রয়ে সতর্কতা
ফ্ল্যাট বাসা ক্রয়ের পূর্বে যে বিষয়গুলো যাচাই করা প্রয়োজন
নির্ভরযোগ্য বাসস্থানের নিমিত্তে একটি ভাল মানের ফ্ল্যাট কেনা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোর একটি। একটি ফ্ল্যাট কেনার জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার মাঝে নিহিত থাকে কয়েক বছরের সঞ্চয় এবং পরিকল্পনা। তাই ফ্ল্যাট বাসা ক্রয়ের পূর্বে এর আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো ভালো মত যাচাই করা উচিত। এই তাৎপর্যপূর্ণ সম্পত্তিটি অর্জনের সাথে জড়িত থাকে প্রচুর পরিমাণে ব্যাংক-ঋণ এবং প্রতি মাসের উপার্জন থেকে উল্লেখযোগ্য অর্থ সঞ্চয়। কোন একটি জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে সমূহ বিপত্তিতে পড়তে হতে পারে। চলুন জেনে নেয়া যাক, একটি নতুন ফ্ল্যাট বাসা ক্রয়ের পূর্বে কোন বিষয়গুলো যাচাই করবেন।
ফ্ল্যাট বাসা ক্রয়ের পূর্বে যে ১০টি বিষয় যাচাই করা জরুরি
ফ্ল্যাটের বাজার মূল্যের সাথে বাজেটের সামঞ্জস্যতা
যে কোন পণ্য বা সেবার ক্রয়ের ন্যায় ফ্ল্যাট কেনারও প্রথম ধাপ হল বাজেট ঠিক করা। এই ক্রয়মূল্যের পরিসীমা যাচাইয়ের জন্য প্রথমেই কয়েকটি ফ্ল্যাট দেখা উচিত। বিভিন্ন অনলাইন সাইট থেকে শুরু করে বন্ধু-বান্ধব কিংবা আত্মীয়-স্বজনের সাথে কথা বলেও একটা ধারণা লাভ করা যেতে পারে। সব দিক বিবেচনা করে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা নির্ধারণ করে নিজে টাকা জমিয়ে তারপর ফ্ল্যাট কেনার দিকে অগ্রসর হওয়া উত্তম। এই কার্যকলাপটি একটি ত্রুটিহীন মজবুত আর্থিক পরিকল্পনার দাবি করে।
এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে ব্যাঙ্ক থেকে ফ্ল্যাট ক্রয়ের জন্য ঋণ নিয়েও এই অর্থের সঙ্কুলান করা যেতে পারে। কিন্তু এপথে অগ্রসর হওয়ার পূর্বে প্রতি মাসে কিস্তি পরিশোধের সক্ষমতা থাকবে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া আবশ্যক। নতুবা ভয়াবহ আর্থিক বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হবে।
আরও পড়ুন: রাতে হাইওয়েতে গাড়ি চালানোর সময় প্রয়োজনীয় কিছু সতর্কতা
ফ্ল্যাটের অবস্থান
শহরের প্রধান সড়কের কাছাকাছি হলে সবচেয়ে বেশি, আর সড়ক ছেড়ে যত ভেতরে যাওয়া যায় ততই কমতে থাকে ফ্ল্যাটের দাম। শহরতলীর একদম বাইরে চলে গেলে দাম আরো পড়ে যায়। গ্রামাঞ্চল বা মাত্র শহরায়নের আওতায় পড়া প্লটের ফ্ল্যাটগুলো সাধারণত সবচেয়ে কম মূল্যের হয়ে থাকে। বাসস্থান যেখানেই খোঁজা হোক না কেন, বাজার, হাসপাতাল, শপিংমল, স্কুল ইত্যাদিকে ধারের কাছে রাখাটা সবারই চাওয়া।
অবশ্য প্রায় ক্ষেত্রে সবগুলো একসাথে পাওয়াটা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এক্ষেত্রে গুরুত্বের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর একটা লিস্ট করা যেতে পারে। অতঃপর বিভিন্ন জায়গার সাথে তুলনা করে যেখানে ক্রয়মূল্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে অপেক্ষাকৃত বেশি সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে, সে জায়গাটি নির্বাচন করা যেতে পারে।
মালিকানার ধরন
বাংলাদেশে সাধারণত ব্যক্তি এবং ডেভেলপারদের থেকে ফ্ল্যাট ক্রয় করা হয়ে থাকে। ডেভেলপার কোম্পানিগুলো থেকে ফ্ল্যাট কেনার সময় প্রথম শ্রেণীর ডেভেলপার নির্বাচন করার চেষ্টা করতে হবে। খরচ একটু বেশি হলেও তাদের কাছ থেকে ফ্ল্যাট কেনার বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অভিজ্ঞতা, জনশক্তির দক্ষতা, কাজের তত্ত্বাবধান, উন্নততর কাঁচামালের ব্যবহার, অসামান্য স্থাপত্য, হস্তান্তর-পরবর্তী পরিষেবা এবং কিস্তি সুবিধা। অন্যদিকে, ব্যক্তির কাছ থেকে ফ্ল্যাট কেনাতে তুলনামূলকভাবে সস্তা দাম ছাড়া আর কোনো বিশেষ সুবিধা নেই।
আরও পড়ুন: প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় পশু-পাখির সুরক্ষা: বন্যা, খরা ও শৈত্য প্রবাহে করণীয়
সরেজমিনে ফ্ল্যাটের আকার এবং নকশা যাচাই
ফ্ল্যাট কেনার সময় সরেজমিনে লিফট, শ্যাফ্ট, সিঁড়ি এবং বিশেষভাবে ফ্ল্যাটের মেঝে দেখে নেয়া উচিত। ফ্ল্যাটের বিজ্ঞাপনে প্রদত্ত মোট স্কয়ার ফিটের সিংহভাগ-ই (প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ) থাকে ফ্ল্যাটের প্রবেশদ্বার থেকে শুরু করে বারান্দার আগ পর্যন্ত দেয়াল ঘেরা বসবাসের জায়গা। এর বাইরে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ লিফ্ট, লবি, ছাদ, গার্ডরুম, জেনারেটর কক্ষ প্রভৃতি কমনস্পেস।
বিক্রেতার কাছ থেকে ফ্ল্যাটের নকশা নিয়ে এগুলো ভালো করে মিলিয়ে দেখা জরুরি। এসময় আশেপাশের ফ্ল্যাট মালিকদের সাথে কথা বলে নেয়া যেতে পারে। পুরো জমিতে কত তলা বিল্ডিং উঠেছে এবং প্রতিটি ফ্লোরে কতটি করে ইউনিট তাও জানা দরকার। এখানে বোঝা যাবে সম্পূর্ণ জমিটি সমান ভাবে বন্টন হচ্ছে নাকি কমবেশি হচ্ছে।
ফ্ল্যাটের বৈধতা পরীক্ষা
এটি সবচেয়ে বেশি দরকারি বিষয় এবং ফ্ল্যাট নির্বাচন করার সময়েই এই কাজটি করা উচিত। অনেকেই বায়না করার পর হঠাৎ ফ্ল্যাটের অবৈধতার কথা জানতে পেরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নির্বাচিত ফ্ল্যাট, সম্পূর্ণ বিল্ডিং ও এর এলাকাটি সরকার তথা রাজউক কর্তৃক অনুমোদিত কিনা এবং অন্য কোনো আইনি সমস্যা থেকে মুক্ত কিনা তা পরীক্ষা করতে হবে। এর জন্য রাজউকের কর্তৃক প্রদানকৃত সনদপত্র বিশেষ করে ফার বা এফএআর(ফ্লোর এরিয়া রেশিও) দেখে নিতে হবে। বিদ্যুৎ সংযোগ আছে কি না এবং সেটি বাণিজ্যিক না আবাসিক তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
আরও পড়ুন: শিশুদের ই-পাসপোর্টের নিয়ম: কীভাবে আপনার অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানের পাসপোর্ট করবেন
ফ্ল্যাট বা জমির রেকর্ড পরীক্ষা
অ্যাপার্টমেন্ট কেনার আগে তার জমির রেকর্ড অনুসন্ধান আরো একটি আবশ্যক বিষয়। জমির মাটির গুণাগুণ এবং এর ভূসংস্থান সম্পর্কে জানতে হবে। মুল বিষয় যেটি দেখতে হবে তা হচ্ছে ফ্ল্যাটের কোন বকেয়া পাওনা আছে কিনা যা এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। এর জন্য ফ্ল্যাটের খাজনা-খারিজের কাগজপত্রের বৈধতা যাচাই করতে হবে। খাজনা বাকি থাকার দরুণ সম্পত্তিটি কখনো নিলামে উঠেছে কি না তা খুঁজে বের করা অতীব জরুরি।
ফ্ল্যাটটি বা যে জমিতে ফ্ল্যাটটি আছে তা আগে কারা কিনেছেন তার জন্য এর বায়া দলিল পরীক্ষা করতে হবে। ফ্ল্যাটের নামজারি খতিয়ানের পাশাপাশি সর্বশেষ জরিপ বিএস(বাংলাদেশ সার্ভে)সহ বিভিন্ন সময়ের জমি জরিপ যেমন সিএস(ক্যাডেস্ট্রাল সার্ভে), এসএ(স্টেট অ্যাকুইজিশন সার্ভে), আরএস(রেভিশনাল সার্ভে)ও দেখতে হবে।
ঝামেলা-মুক্ত ফ্ল্যাট যাচাই
নিষ্কন্টক পণ্য বা সেবার বৈশিষ্ট্য হলো সেটি আরো কোন ক্রেতার কাছে বিক্রি করা হয় নি। এই বিষয়টি ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ফ্ল্যাটটি কোন ব্যাঙ্কের নিকট বন্ধক দেয়া আছে কিনা তা খুঁজে বের করা আবশ্যক। নামজারি মামলা সহ খতিয়ানে ফ্ল্যাটের মালিকের নাম পাওয়া গেলেই কাজ শেষ নয়। দেখতে হবে মালিক ফ্ল্যাটটি বিক্রির জন্য কারো উপর দায়িত্ব ভার অর্পন করেছেন কিনা। দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকের বৈধতাও যাচাই করা দরকার। কোনো ধরনের মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে না কিনে সরাসরি মালিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ফ্ল্যাট কেনা উত্তম।
আরও পড়ুন: কোন ধরনের আগুন কীভাবে নেভাবেন?
নিরাপত্তা সহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা
ডেভেলপার বা ব্যক্তি মালিক; ফ্ল্যাট বিক্রেতা যেই হোক না কেন, ফ্ল্যাটের মূল্যের উপযুক্ততা নিরুপন করার জন্য দেখে নেয়া উচিত যে ফ্ল্যাটটিতে কি কি সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। গ্যাস সংযোগ এক সময় ফ্ল্যাটের বৈধতার বিষয় ছিলো। কিন্তু আজকাল নতুন ফ্ল্যাটে সরকার গ্যাস সংযোগ না দেয়ায় গ্যাস ছাড়াই ফ্ল্যাট ক্রয় করতে হয়। তবে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সংযোগ আবাসনের নির্ভরযোগ্যতা আরো বাড়িয়ে দেয়।
বাড়িতে থাকার মত নিরাপত্তা ব্যবস্থার সাথেও কখনো আপস করা যায় না। অ্যাপার্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের নিরাপত্তা পরিমাপ করার তাগিদে নিশ্ছিদ্র প্রহরা, সন্তোষজনক সিসিটিভি নজরদারি, ফায়ার অ্যালার্ম, জরুরি প্রস্থান ইত্যাদির প্রতি দৃষ্টিপাত করা আবশ্যক।
ফ্ল্যাট ক্রয়ে ব্যাংক ঋণের সুবিধা
ডেভেলপারদের কাছ থেকে ফ্ল্যাট ক্রয়ের ক্ষেত্রে এই বিষয়টিতে গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে। বেশিরভাগ ব্যাংকই নামীদামী ডেভেলপারদের গ্রাহকদের ঋণ প্রদান করে থাকে। এক্ষেত্রে যে প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে ফ্ল্যাট ক্রয়ে মনস্থির করা হয়েছে তাদের নেটওয়ার্কে থাকা ব্যাঙ্কগুলোতে খোঁজ নেয়া যেতে পারে। এতে ডেভেলপারদের সুখ্যাতির ব্যাপারেও নিশ্চিত হওয়া যাবে। আর যদি তাদের সাথে কোন ব্যাঙ্ক যুক্ত না থাকে, তাহলে তাদের কাছ থেকে ফ্ল্যাট কেনার ব্যাপারটি পুনর্বিবেচনা করা উচিত।
আরও পড়ুন: এটিএম বুথে কার্ড আটকে গেলে কি করবেন ? এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় কি?
ফ্ল্যাট বায়নানামা ও রেজিস্ট্রেশনের গুরুত্বপূর্ণ শর্তাবলী
সবশেষে টোকেন মানি দিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতার ফ্ল্যাট বিক্রির চুক্তি করার পালা। টোকেন মানির বিনিময়ে বিক্রেতা ক্রেতাকে একটি বরাদ্দপত্র সরবরাহ করেন। তারপর বাকি পরিমাণের জন্য ক্রেতা, ব্যাঙ্ক এবং বিক্রেতার মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় লেনদেন সংঘটিত হয়। একই সাথে ভুমি অফিস, ক্রেতা ও বিক্রেতার মাঝে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সাক্ষরিত হয়, যাকে ফ্ল্যাট বা জমি বিক্রয় চুক্তিপত্র বলা হয়। এর মাধ্যমে সম্পত্তিটি সরকারের নিকট রেজিস্ট্রেশন হয় এবং চূড়ান্তভাবে সেটি ক্রেতার নিকট হস্তান্তর হয়।
এই চুক্তিতে ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেনকৃত টাকার পরিমাণ উল্লেখ থাকে। বায়না ও বিক্রয় চুক্তিনামা উভয় চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করার আগে বিশদভাবে পড়ে বুঝে নেয়া উচিত। ক্রেতার ফ্ল্যাটে ওঠার সময়রেখার একটি সুস্পষ্টতা থাকা উচিত বায়নানামাতে। প্রায়ই ডেভেলপাররা অতিরিক্ত সময় আবেদন করে। এই আবেদনের সঠিক যৌক্তিতা বিচারপূর্বক তার শর্তগুলো স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা উচিত।
অন্যদিকে, ক্রেতা কত কিস্তিতে ফ্ল্যাটের টাকা পরিশোধ করবেন তা বায়না দলিলে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। কিস্তি শেষে ফ্ল্যাট স্থানান্তরের দিনক্ষণ এমনকি যদি কোন কারণে ক্রয় করা না যায়, সেক্ষেত্রে এটি কীভাবে নিষ্পত্তি করা হবে তারও স্পষ্ট উল্লেখ থাকতে হবে।
আরও পড়ুন: বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বেই যেসব খাবার সংরক্ষণ করা জরুরি
শেষাংশ
ফ্ল্যাট বাসা ক্রয়ের পূর্বে এই বিষয়গুলোর দিকে খেয়াল রাখলে ঝামেলাহীনভাবে সম্পন্ন হবে ফ্ল্যাট হস্তান্তর। এটা নিছক একটি পণ্য বা সেবা কেনা নয়, বরং একজন ক্রেতার জীবনের উল্লেখযোগ্য সময়কে বিনিয়োগ করা। তাই এই সম্পত্তি কেনার ক্ষেত্রে কারও দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে তাড়াহুড়ো করে কোন চুক্তিতে যাওয়া ঠিক নয়। দলিলপত্রের ঠিক-বেঠিক নিয়ে দ্বিধান্বিত থাকলে একজন দক্ষ আইনজীবীকে দেখিয়ে নেওয়া ভালো। উদ্দেশ্য যেখানে জীবনকে একটি পরম নির্ভরতার স্থায়ী ঠিকানা দেয়া, তাই তার আগে প্রতিটি পদক্ষেপ সতর্ক হওয়া চাই।
২ বছর আগে