ভাসমান পেয়ারা বাজার
ভিমরুলি ভাসমান পেয়ারা বাজার: বাংলার ভেনিস বরিশালের সৌন্দর্য্যে সেরা সংযোজন
থাইল্যান্ডের ড্যামনোয়েন সাদুয়াক বাজার অথবা ইতালির ভেনিসের রিও সান বার্নাবা বাজার নয়। ভাসমান পেয়ারা বাজার বলতে এখানে বোঝানো হচ্ছে বাংলার ভেনিস বরিশালের ভাসমান হাটকে।
বিগত কয়েক বছর ধরে দর্শনীয় স্থানটি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে যাওয়ায় দেশীয় পর্যটকদের ভাসমান বাজারের অভিজ্ঞতা নিতে আর বিদেশমুখী হতে হচ্ছে না। উল্টো বাইরে থেকে বিদেশি পরিব্রাজকরা হাতে ডিএসএলআর নিয়ে ভিড় জমাচ্ছেন বাংলাদেশের দক্ষিণের এই ভাসমান কাঁচাবাজারে। চলুন, ঐতিহাসিক বরিশালের সৌন্দর্য্যে দারুণ এই সংযোজনটির সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।
ভাসমান পেয়ারা বাজারের অবস্থান
ভাসমান পেয়ারা বাজার বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি জেলা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। তিনটি খালের সঙ্গমস্থলে এই ভাসমান বাজার। ঝালকাঠি, বরিশাল এবং পিরোজপুরের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করায় এটি এশিয়ার বৃহত্তম পেয়ারা বাজার। বরিশাল, ঝালকাঠি ও পিরোজপুরের ২৬টি গ্রামের প্রায় ২০ হাজার পরিবার নিজেদের জীবিকা নির্বাহের জন্য ৩১ হাজার একর জমিতে বিস্তৃত এই পেয়ারা বাগানের ওপর নির্ভরশীল।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের সেরা ১০টি প্রাকৃতিক ঝর্ণা, জলপ্রপাত কোথায়? কীভাবে যাবেন?
ভাসমান পেয়ারা বাজারের নামকরণ
২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই ভাসমান পেয়ারা বাজারটি গড়ে উঠেছে। ঝালকাঠি ও পিরোজপুর সীমারেখায় অবস্থিত ছোট্ট গ্রামের নাম ভিমরুলি। এখানেই চর্তুমুখী ছোট-বড় খালের মোহনায় প্রতিদিন বিপণী শুরু হয়। তাই ভিমরুলি গ্রামটির নাম-ই শেষমেষ বাজারটির নামের সঙ্গে স্থায়ীভাবে জুড়ে যায়। স্থানীয় ব্যক্তিদের মুখে অবশ্য এই বাজারকে উদ্দেশ্য করে কথা বলার সময় গোইয়ার হাট নামটা শোনা যায়।
ভাসমান বিপণীর প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য
ছোট খাল জুড়ে সপ্তাহের প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাজার চলে। পেয়ারা বোঝাই শত শত নৌকা দেখলে বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। ফল চাষিরা ফল দিয়ে নৌকা বোঝাই করে এবং ক্রেতাদের সন্ধান করে। ভিমরুলির আশেপাশের সব গ্রামেই অসংখ্য পেয়ারা বাগান রয়েছে। কৃষকরা এসব বাগান থেকে পেয়ারা সংগ্রহ করে নৌকায় করে সরাসরি হাটে নিয়ে আসে। ভাসমান বাজারের উত্তর প্রান্তে খালের ওপর একটি ছোট সেতু আছে, যেটি এখানকার মূল আকর্ষণ। কেননা সেতু থেকে বাজারের পুরোটা খুব ভালোভাবে দেখা যায়।
মজার ব্যাপার হলো এই বাজারে পেয়ারা বহনকারী সব নৌকার নকশা ও আকার প্রায় একই। মনে হয় একই কারিগর সব নৌকা বানিয়েছে।
আরও পড়ুন: গরমকালে কম খরচে বাংলাদেশের কোথায় কোথায় ঘুরতে যাবেন?
পেয়ারা বাগানে প্রবেশের জন্য ছোট ছোট পরিখা করা হয়েছে। ছোট নৌকা নিয়ে সেখানে ঢুকে চাষিরা পেয়ারা পাড়েন। খাল সংলগ্ন প্রতিটি বাড়িতে একটি করে ডিঙ্গি নৌকা থাকে। স্থানীয়রা এগুলোকে কষা নৌকা বলে। এগুলো দিয়েই বাজার-হাট, যাতায়াত যাবতীয় কাজ করা হয়। ছোট নৌকাগুলো সরাসরি পরিখা দিয়ে বাগানে ঢুকে পড়তে পারে। বড়গুলোকে পাড়ে রেখে চাষিরা বাগানে নেমে পড়ে।
খাল সংলগ্ন বাড়িঘর, স্কুল, ব্রিজ, রাস্তাঘাটের দৃশ্য যে কাউকে বাংলার বুকে এক টুকরো থাইল্যান্ড বা ইতালির ভেনিসের অনুভূতি দেবে। আর মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলে কোনো ভ্রমণপিপাসু মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ার অবকাশ পাবেন না।
ভাসমান পেয়ারা বাজার ভ্রমণের উপযুক্ত সময়
ভিমরুলি বাজারে ব্যস্ততম সময় দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৩টা। এই সময়ে খালে নৌকা সংখ্যার চমকপ্রদভাবে বেড়ে যায়। এমনকি কয়েকশ ছাড়িয়ে যায়। সারা বছর ভাসমান বাজার বসলেও পেয়ারার মৌসুমে প্রাণ আসে। মৌসুম জুলাই ও আগস্ট মাস হলেও মাঝে মাঝে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাজার চলে। ভাসমান পেয়ারা বাজার ঘুরে আসার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় আগস্ট মাস। পেয়ারা বাজারের ভিড় বেলা ১১টার পর হালকা হয়ে যায়, তাই এর আগে বাজারে উপস্থিত থাকা ভালো।
আরও পড়ুন: ঢাকার কাছেই প্রকৃতির মাঝে ক্যাম্পিং সাইট
ঢাকা থেকে ভাসমান পেয়ারা বাজার যাবার উপায়
ঢাকা থেকে বরিশালে পৌঁছানোর জন্য সড়কপথ, নৌপথ দুইভাবেই যাওয়া যেতে পারে। তবে জলপথে ভ্রমণ সবচেয়ে আরামদায়ক, সুবিধাজনক এবং আনন্দদায়ক।
ঢাকার সদরঘাট থেকে প্রতিদিন বেশ কিছু লঞ্চ বরিশালের পথে যাতায়াত করে এবং ভোর ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে পৌঁছায়। ডেকের ভাড়া জন প্রতি ২০০ টাকা, যেখানে নন এসি সিঙ্গেল কেবিন ভাড়া ৯০০ টাকা এবং নন এসি ডাবল কেবিন ভাড়া ১৮০০ টাকা।
বরিশাল লঞ্চ ঘাট থেকে অটোরিকশার মাধ্যমে চৌরাস্তায় এসে তারপর বাসে স্বরূপকাঠি লঞ্চ ঘাটে যেতে হবে, যেখানে ভাড়া পড়বে ৫০ টাকা। স্বরূপকাঠি লঞ্চ ঘাট থেকে ট্রলার ভাড়া করে অপরূপ সন্ধ্যা নদী পেরিয়ে আটঘর, কুড়িয়ানা এবং ভীমরুলি বাজার ঘুরে দেখা যায়। ভালো দর কষাকষি করলে ১০০০ থেকে ২০০০ টাকায় ট্রলার ঠিক করে নেয়া যেতে পারে।
আরও পড়ুন: ঢাকার সেরা ১০টি জাদুঘর: ইতিহাস রোমন্থনের সঙ্গে জ্ঞান আহরণের অভাবনীয় সুযোগ
আরেকটি বিকল্প উপায় হচ্ছে- স্বরূপকাঠি লঞ্চঘাট থেকে ২০ টাকায় অটো ভাড়ায় কুরিয়ানা বাজারে পৌঁছা। তারপর সেখানকার আশেপাশের বাজার এবং খালগুলো দেখার জন্য ২০০ থেকে ৪০০ টাকায় নৌকা বা ট্রলার ভাড়া করা। তবে এ পথে ভিমরুলিতে গেলে ভাড়া বেশি পড়ে।
এছাড়া রাস্তা ভালো থাকলে অটোতে করে আটঘর, কুড়িয়ানা, ভিমরুলি বাজার ঘোরা যায়। তবে রাস্তা ও সেতুর অবস্থা ভালো কিনা তা এলাকাবাসীর কাছ থেকে জেনে নেয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে অটোতে করে ব্রিজপ পর্যন্ত এসে সেখান থেকে পায়ে হেঁটে ব্রিজ পার হয়ে আবার অটো নিতে হবে।
আর বাসের পথটা এখন অনেকাংশে উন্নত হয়েছে। যে পথ অতিক্রমে আগে দুই দিন লাগতো পদ্মা সেতুর কল্যাণে সেই যাত্রা এখন একদিনেই শেষ করা যাবে। এমনকি পানিপথের প্রতিকূল আবহাওয়ার আশঙ্কায় পড়া লাগবে না। এখন ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু দিয়ে পিরোজপুর বাসে যেতে সময় লাগবে মাত্র ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা।
আরও পড়ুন: কমলদহ ও সহস্রধারা-২ ঝর্ণা ভ্রমণ গাইডলাইন: ভ্রমণপিপাসুদের প্রিয় ঝিরিপথ
অতঃপর পিরোজপুর থেকে ওপরে উল্লেখিত পথে ভিমরুলি চলে যাওয়া যাবে। অর্থাৎ খুব ভোরে রওনা হলে দুপুরেই মধ্যেই ভাসমান বাজারে পৌঁছে যাওয়া যাবে। অতঃপর ঘণ্টাখানেক সময় কাটিয়ে আবার রাতেই ঢাকায় ফেরা যাবে।
ভাসমান পেয়ারা বাজার ভ্রমণে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা
রাত্রি যাপন করতে হলে চলে আসতে হবে ঝালকাঠি শহরে। সেখানে ১০০ থেকে ২৫০ টাকায় মোটামুটি মানের আবাসিক হোটেল পাওয়া যায়। নদীর ধারে রাত্রিযাপন করতে চাইলে স্বরূপকাঠিতে নদীর ধারে হোটেল পাওয়া যাবে। তবে ভালো মানের হোটেল নির্বাচনের জন্য চলে যেতে হবে বরিশাল সদরে।
ভোজন রসিকদের জন্য ভিমরুলি দারুণ একটি জায়গা। এখানকার ঐতিহ্যবাহী স্থানীয় খাবারের মধ্যে রয়েছে ভিমরুলি বাজারের সাদা ও লাল মিষ্টি, কুরিয়ানা বাজারের ঋতুপর্ণার গরম মিষ্টি, বউদির হোটেলে দুপুরের খাবার এবং গুঠিয়ার মিষ্টি। এ ছাড়া বটতলা এলাকার শশির রসোমালাই, নয়াবাজার মোড়ের নিতাইয়ের স্পঞ্জ মিষ্টি।
আরও পড়ুন: বান্দরবান ট্যুর গাইড: সেরা দর্শনীয় স্থানসমূহ
তাছাড়া বিবি পুকুর পাড়ের ছোটপটি, দধিঘরের দই, ঢেঁড়স, ও ঝোলা চালের মিশ্রণ লোকালয়ে বেশ জনপ্রিয়। সুযোগ পেলে বরিশাল শহরের পুরান বাজারে রসোমালাই, রসগোল্লা এবং ছানা চেখে দেখা যেতে পারে।
আশেপাশের দর্শনীয় স্থানসমূহ
ভাসমান পেয়ারা বাজার থেকে বরিশাল যাওয়ার পথে ঘুরে দেখা যেতে পারে গুঠিয়া মসজিদ এবং দুর্গাসাগর দীঘি। ২০০৮ সালে গুঠিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা, শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এস সরফুদ্দিন আহমেদ সান্টু নিজ উদ্যোগে গুঠিয়া মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদের স্তম্ভগুলো কাবা শরীফ, মসজিদে নববী, যমযমের পবিত্র পানিসহ বিশ্বের পবিত্র স্থানগুলোর মাটি দিয়ে তৈরি।
১৭৮০ সালে চন্দ্রদ্বীপ পরগণার রাজা শিবনারায়ণ স্থানীয়দের পানির সংকট দূর করার জন্য মাধবপাশায় দুর্গাসাগর দীঘি খনন করেন। দীঘির কাছে ৩০০ বছরের পুরনো লাকুটিয়া জমিদার বাড়িটিও দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিত।
আরও পড়ুন: বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা ১০ শহর
কুড়িয়ানা বাজার থেকে জনপ্রতি ১৫ টাকায় অটোতে করে প্রথমে নারায়ণকাঠি নামতে হবে। সেখান থেকে অটো বদলে মাথাপিছু ১০ টাকা ভাড়ায় গুটিয়া মসজিদ যাওয়া যায়। সেখান থেকে দুর্গাসাগর দিঘীর দূরত্ব মাত্র দুই কিলোমিটার।
পরিশেষে
ভাসমান বাজারে নৌকায় ভেসে যাওয়ার সময় লাইফ জ্যাকেট পরে নেয়া ভালো। বাগান থেকে কিছু খেতে চাইলে বাগান মালিকের অনুমতি নিতে হবে। পানিতে ময়লা ফেলে খালের পরিবেশকে নষ্ট করা যাবে না।
শেষ কথা হচ্ছে, বরিশালের ভাসমান পেয়ারা বাজার দারুন একটি ডে-ট্যুর হতে পারে। গ্রাম্য চাষিদের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাওয়া নিমেষেই ভুলিতে দিতে পারে শহরের কৃত্রিম শপিং মলের যান্ত্রিকতা। আগস্টের যে কোনো ব্যস্ত দিনে দলবেধে হারিয়ে যাওয়া যেতে পারে এই অদ্ভুত কোলাহলে।
আরও পড়ুন: হাকালুকি হাওর ভ্রমণ: এক নিঃসীম জলজ মুগ্ধতা
২ বছর আগে