অরক্ষিত রেলক্রসিং
অরক্ষিত রেলক্রসিং অধিকাংশ রেল দুর্ঘটনার জন্য দায়ী
গত মাসে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া রেলস্টেশনের কাছে খৈয়াছড়া ঝরণা এলাকায় রেললাইন পার হওয়ার সময় মাইক্রোবাসে ট্রেনের ধাক্কায় ১১ জন নিহত হন।
সিরাজগঞ্জে রেলক্রসিংয়ে নবদম্পতির ওপর দিয়ে ট্রেন চলে যাওয়ার মাত্র কয়েক সপ্তাহ পর ২৯ জুলাই দুর্ঘটনাটি ঘটে। মূলত মাইক্রোবাসটি একটি অরক্ষিত রেলক্রসিং পার হওয়ার সময় দ্রুতগামী ট্রেনের ধাক্কায় ছাত্রদের মৃত্যু হয়।
এ ধরনের ভয়াবহ দুর্ঘটনার পেছনে সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে অবৈধ ও গেটম্যানবিহীন রেলক্রসিং।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, রেলওয়ের দুই হাজার ৮২২টি রেলগেটের মধ্যে এক হাজার ৩৫৪টি অবৈধ, গেটম্যান নেই দুই হাজার ২৫৮টিতে এবং বৈধ ৯০৪টি গেটও গেটম্যানবিহীন।
রেল গেটগুলোতে যত দুর্ঘটনা ঘটছে তার ৯০ শতাংশ লেভেল ক্রসিংয়ে। যার বেশির ভাগই অবৈধ।
রেল সূত্র বলছে, রেলের অধিকাংশ বৈধ গেটও প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। গত এক যুগে রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে ৯৩৬টি। এসব দুর্ঘটনায় ৫১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে ।
বাংলাদেশ রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়, রেলে দুই হাজার ২৫৮টি অরক্ষিত গেইট অর্থাৎ সেখানে কোনো গেটম্যান নেই। শুধু তাই নয়, দুই পাশের লোহার ব্যারিকেডও নেই। এমনকি বৈধ গেটের মধ্যে ৯০৪টি গেটও অরক্ষিত। মাত্র গেটম্যান আছে ৫৬৪টিতে। এসব গেটম্যানরা বেশির ভাগ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় অস্থায়ী কর্মচারী। স্থায়ীভাবে আছে মাত্র ৩৩১ জন। একটি গেটে ন্যূনতম ৬ জন গেটম্যান থাকার কথা। অথচ সে হারে কোথাও লোকবল নেই। প্রয়োজন রয়েছে ১৬ হাজার ৯৩২ জন গেটম্যানের।
পড়ুন: মিরসরাই ট্রাজেডি: আয়াতের পর এবার চলে গেলেন তাসমির হাসান
এ বিষয়ে রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন ইউএনবিকে বলেন, ‘রেল দুর্ঘটনা বিষয়ে আমি বলতে চাই, সড়কের যান রেললাইনের ওপড়ে উঠে দুর্ঘটনা সৃষ্টি করে। ৯০ ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে রেলের লেভেল ক্রসিংগুলোতে। আপনাদের মনে রাখতে হবে ট্রেন কাউকে ধাক্কা দেয় না বরং বাইরে থেকে এসে ট্রেন কে ধাক্কা দেয়া হয়।’
তিনি আরও বলেন, ট্রেন তার নিজস্ব লাইনে চলে। অন্য কেউ এসে রেলকে ধাক্কা মারলে, ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার দায় রেলের নয়। এর জন্য আমাদের সচেতনতা জরুরি। পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে এবং যেখানে যার দায়িত্ব সেটা সঠিকভাবে পালন করতে হবে। ট্রেনকে নিরাপত্তা দেয়ার জন্যই আমরা লেভেল ক্রসিংয়ে লোক নিয়োগ দিয়ে থাকি কিন্তু বিভিন্ন সংস্থা তাদের মত করে রেললাইনের ওপর রাস্তা তৈরি করছে। এক্ষেত্রে তাদেরকেই নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে হবে।
মন্ত্রী বলেন, ‘রেলে অবৈধ ক্রসিংগুলো বন্ধ করতে পারলে দুর্ঘটনা অনেক কমে যাবে। আমরা এ বিষয়ে অনেক চেষ্টা করলেও বন্ধ করতে পারিনি। স্থানীয়ভাবে কিছু লোক এসব অবৈধ ক্রসিং তৈরি করে যা বড় অপরাধ। অবৈধ গেট বন্ধ করতে দুই পাশে আমরা লোহার বেড়া দিয়েছি এবং রাস্তা কেটে দিয়েছি তারপরও আটকাতে পারিনি। একদিকে আমরা লৌহার বেড়া দেই আবার রাতের আঁধারে এসব বেড়া তুলে ফেলে।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার ইউএনবিকে জানান, ‘লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা কমাতে একটি প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। বৈধ গেটগুলোতে সেন্সর পদ্ধতিতে বেশকিছু গেটে বিশেষ অ্যালার্ম স্থাপন করা হবে। এর ফলে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে থেকে ট্রেন থাকা অবস্থায় গেটে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই অ্যালার্ম বেজে উঠবে। ফলে দুর্ঘটনা কমে যাবে। আমরা কাজ করছি যত দ্রুত সময়ে প্রকল্পটি নেয়া যায়।’
তিনি আরও বলেন, আমরা রেলের পক্ষ থেকে বৈধ লেভেলক্রসিংগুলোতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা প্রহরী দেয়ার উদ্যোগ নিচ্ছি। আর অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোতে আমরা তাদেরকে লিখিত আকারে ও সরাসরি জানাচ্ছি বন্ধ করতে কিংবা যথাযথভাবে গেট নির্মাণ করে প্রহরী নিয়োগ করতে। কিন্তু কোনো বিষয়ে তারা কান দিচ্ছে না এবং এ বিষয়ে আমরা খুবই আতঙ্কে আছি কখন একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায়।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক চৌধুরী ইউএনবিকে বলেছেন, ‘অবৈধ লেভেল ক্রসিং যারা তৈরি করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। এ বিষয়ে রাজনৈতিক পরিচয়েও কোনো ছাড় দেয়া যাবে না।’
তিনি বলেন, এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া আরও জোরদার করতে হবে। আগের মতো রেল ব্যবস্থা থাকলে হবে না। আধুনিক করে রেলকে যেভাবে এগিয়ে নিতে হবে ঠিক এই দুর্ঘটনা চাইলেই বন্ধ করা সম্ভব যদি রেল ও স্থানীয় প্রশাসন সমন্বিতভাবে কাজ করে।
পড়ুন: মিরসরাইয়ে ট্রেন দুর্ঘটনা: গেটম্যান সাময়িক বরখাস্ত, মামলা
রেলের ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই: মন্ত্রী
২ বছর আগে
অরক্ষিত রেলক্রসিং: ফেনীতে ৭ মাসে ৯ জনের মৃত্যু
ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ফেনী অংশে শশর্দী থেকে মুহুরীগঞ্জ পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ২৩ কিলোমিটারের মধ্যে অনুমোদনহীন অরক্ষিত ১২টি ও ২১টি অনুমোদিত রেলক্রসিং রয়েছে। চলতি বছরের ৭ মাসে রেলপথের ফেনী অংশে ট্রেনে কাটা পড়ে ৯ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে।
ট্রেনকে ভ্রমণের অন্যতম নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা সত্ত্বেও প্রতি বছর বাংলাদেশে রেল দুর্ঘটনায় বহু মানুষ মারা যায়। জানুয়ারি ২০২২ সালে প্রকাশিত রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালে ১২৩টি রেল দুর্ঘটনায় প্রায় ১৪৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
গত ২৯ জুলাই মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় একসঙ্গে ১১ তরুণের মৃত্যু হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও দুজনের মৃত্যু হয়। এর মধ্য দিয়ে নিরাপদ রেলক্রসিংয়ের বিষয়টি ফের সামনে উঠে আসে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ঊর্ধ্বতন উপ সহকারী প্রকৌশলী (পথ) রিটন চাকমা জানান, প্রতিনিয়ত ইচ্ছেমতো রেলের ওপর দিয়ে পথ তৈরি করা হচ্ছে। অনুমোদনহীন এসব ক্রসিংগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে মুহুরীগঞ্জে। এখানে ৬টি অনুমোদনহীন রেলক্রসিং তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া শর্শদী, দেওয়ানগঞ্জ, ফাজিলপুরে রয়েছে আরও ৬টি। সবচেয়ে ঝূকিপূর্ণ হচ্ছে মুহুরীগঞ্জ।
ফেনীর বারাহীপুর রেলক্রসিং এলাকার দায়িত্বে থাকা গেটম্যান জীবন জানান, ট্রেন আসার আগেই গেট বন্ধ করা হয়। কিন্তু গাড়ীর ড্রাইভার ও পথচারীরা দ্রুতত রেল লাইন পার হওয়ার চেষ্টা করে। এতে অনেক সময় দুর্ঘটনার শিকার হয়।
অনুমোদনহীন এসব রেলক্রসিং প্রসঙ্গে ফেনী রেলস্টেশন মাস্টার সাইফুল ইসলাম বলেন, রেলপথের পাশে বসতঘর থাকায় বিভিন্ন সময় অনুমোদনহীন ক্রসিং তৈরি করা হয়। ফলে দুর্ঘটনার শঙ্কা অনেক বেশি বাড়ছে।
রেলওয়ে পুলিশের ফেনী ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) নফিল উদ্দিন জানান, চলতি বছরের ৭ মাসে রেলপথের ফেনী অংশে ট্রেনে কাটা পড়ে ৯ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে দুর্ঘটনায় ৯টি অপমৃত্যুর মামলাসহ ১২ মামলা রেকর্ড হয়েছে।
তিনি আরও জানান, গত বছরের ১১ অক্টোবর ভোরের দিকে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফতেহপুর রেলক্রসিংয়ে যাত্রীবাহি বাস রেললাইনে উঠে পড়লে ট্রেনের সাথে সংঘর্ষ ঘটে। এতে ৪ ব্যক্তি প্রাণ হারান। এছাড়া বারাহীপুর রেলক্রসিং, শহরের রেলগেট ক্রসিংয়ে সাম্প্রতিককালে দুর্ঘটনা ঘটে এবং প্রাণহানিও হয়।
পড়ুন: মিরসরাই ট্রাজেডি: আয়াতের পর এবার চলে গেলেন তাসমির হাসান
২ বছর আগে