অ্যান্টিবায়োটিক-এর অপপ্রয়োগ
অ্যান্টিবায়োটিক-এর অপপ্রয়োগ: কেন অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করছে না?
১৯২৮ সালে আলেকজান্ডার ফ্লেমিং-এর পেনিসিলিন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয় অ্যান্টিবায়োটিক। গিণিপিগ হিসেবে পশুর উপর সর্বপ্রথম অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ শুরু হয় ১৯৮০-এর দশকে। অ্যান্টিবায়োটিকগুলো ক্যান্সারের চিকিৎসা, অঙ্গ প্রতিস্থাপন এবং অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতির পথ প্রশস্ত করেছে, যা ওষুধ শিল্পে অভাবনীয় পরিবর্তন এনেছে। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিকের অপপ্রয়োগ এবং কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে।
ভুল সময়ে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার রোগাক্রান্ত অবস্থার আরো অবনতি ঘটায়। প্রেসক্রিপশন ছাড়া রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ তো আছেই, কোন কোন ক্ষেত্রে অনেক ডাক্তারও ছোট ছোট ক্ষেত্রে শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক নেয়ার পরামর্শ দেয়। মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে অ্যান্টিবায়োটিকটি এক সময় কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। চলুন, অ্যান্টিবায়োটিকের কাজ না করার সাথে অ্যান্টিবায়োটিক-এর অপপ্রয়োগের সম্পর্কটি নিরূপণ করা যাক।
বিশ্বজুড়ে অ্যান্টিবায়োটিক-এর অপপ্রয়োগ
শিশুদের আপাত ভাইরাল শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা প্রায়ই অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ প্রধানত ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট হওয়া সত্ত্বেও, ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। শিশুদের কানে টিউবযুক্ত সমস্যায় কানে অ্যান্টিবায়োটিক ইয়ারড্রপ না দিয়ে মুখে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানোহয়। এতে অবাঞ্ছিত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। সাঁতারুদের কানে অ্যান্টিবায়োটিক ইয়ারড্রপ দিয়ে চিকিৎসা করা উচিত, মুখে অ্যান্টিবায়োটিক খাইয়ে নয়।
পড়ুন: তীব্র গরমে হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচতে করণীয়
মানসম্মত নির্দেশিকা ছাড়া অনেক দেশে এমনকি উন্নত বিশ্বেও প্রায়শই স্বাস্থ্যকর্মী এবং চিকিৎসকরা জনসাধারণকে অ্যান্টিবায়োটিক নেয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
চিকিৎসা ছাড়াই সমাধানযোগ্য সাইনোসাইটিস-এর সমস্যার ক্ষেত্রেও অ্যান্টিবায়োটিক নিতে বলা হয়। প্রায়ই রোগীর ব্যাকটেরিয়াজনিত কনজাংটিভাইটিস আছে কিনা তা নিশ্চিত না হয়েই অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়। বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রস্রাবে ব্যাকটেরিয়া থাকে যা নিয়মিত প্রস্রাব পরীক্ষায় সনাক্ত করা হয়। এখানে ব্যক্তির মূত্রনালীর সংক্রমণের লক্ষণ না থাকলেও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে ধাবিত করা হয়। মুখ দিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ একজিমার চিকিৎসা নয়। শুষ্ক ত্বক বা অন্যান্য উপসর্গের চিকিৎসায় লোশন ব্যবহার করা যেতে পারে।
অস্ত্রোপচারের ক্ষতগুলো সারানোর জন্য নন-অ্যান্টিবায়োটিক মলম বা কোনও মলমের চেয়ে ভালো কাজ না করলেও টপিক্যাল অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়।
পড়ুন: উচ্চ রক্তচাপ (হাই প্রেশার) হলে যা এড়িয়ে চলা উচিত: ক্ষতিকর খাবার, পানীয়, অভ্যাস
অ্যান্টিবায়োটিক-এর অপপ্রয়োগের কুফল
যখন প্রথম সারির অ্যান্টিবায়োটিক দ্বারা সংক্রমণের চিকিৎসা করা যায় না, তখন আরও ব্যয়বহুল ওষুধ ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়ে। এতে অসুস্থতা এবং চিকিৎসার দীর্ঘ সময়কাল প্রায়ই হাসপাতালটিতে চিকিৎসা খরচ বাড়ায়; সেইসাথে পরিবার এবং সমাজের উপর আর্থিক বোঝা গেড়ে বসে। কখনো কখনো এর কারণে মৃত্যুর আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়।
মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলায় সমূহ ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয়। অঙ্গ প্রতিস্থাপন, কেমোথেরাপি এবং সিজারিয়ানের মত অস্ত্রোপচারগুলো অনেক বেশি বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। এন্টিবায়োটিকগুলো কম কার্যকর হওয়ার কারণে সংক্রমণের ক্রমবর্ধমান তালিকা - যেমন নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা, রক্তে বিষক্রিয়া, গনোরিয়া এবং খাদ্যজনিত রোগের চিকিৎসা করা কঠিন এবং কখনও কখনও অসম্ভব হয়ে উঠছে।
যে কোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি আগে থেকেই অ্যালার্জি থাকলে, সেই রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া যাবে না। অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়াগুলোর মধ্যে ত্বকের ফুসকুড়ির মতো উপসর্গগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকে, যাকে অ্যানাফিল্যাক্সিস বলা হয়। এই রোগে শ্বাস নিতে অসুবিধা হতে পারে এবং ঠোঁট বা জিহ্বা এবং মুখ ফুলে যেতে পারে।
পড়ুন: ডায়রিয়া বা উদরাময়: কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উপায়
অ্যান্টিবায়োটিক-এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া স্বরূপ পেট খারাপ বা ফুসকুড়ির মতো হালকা উপসর্গ থেকে শুরু করে মারাত্মক অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া, কিডনির আঘাত এবং লিভারের ক্ষতি পর্যন্ত হতে পারে।
অ্যান্টিবায়োটিক কাজ না করার কারণ: অ্যান্টিবায়োটিক নিরোধক
অ্যান্টিবায়োটিক নিরোধক হল সেই অবস্থা, যখন ব্যাকটেরিয়াকে তাকে ধ্বংস করার জন্য ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে আর ধ্বংস করা যায় না। অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ব্যবহার এবং অপব্যবহারের ফলাফল-ই হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক নিরোধক।
অ্যান্টিবায়োটিকগুলো ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত ওষুধ। অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ তখনি ঘটে যখন ব্যাকটেরিয়া এই ওষুধগুলো ব্যবহারের প্রতিক্রিয়াতে আর সাড়া দিতে পারে না। আর এই সময়টি হলো যখন অ্যান্টিবায়োটিক অত্যধিক হারে ব্যবহার করা হয়।
পড়ুন: হঠাৎ প্রেসার কমে গেলে করণীয়
যতবারই একটি নতুন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রবর্তিত হয়, তার সাথে সাথে ঔষধের প্রতিরোধী হিসেবে অ্যান্টিবায়োটিকও আসে। পেনিসিলিনের প্রথম ক্লিনিকাল ট্রায়ালের এক দশকের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক নিরোধকের আবির্ভাব ঘটে। অতঃপর এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকে।
শেষাংশ
অ্যান্টিবায়োটিক-এর অপপ্রয়োগ সমগ্র জাতিকে ঠেলে দিচ্ছে এক পোস্ট-অ্যান্টিবায়োটিক যুগের দিকে, যেখানে ছোটখাটো আঘাতই মৃত্যু ঘটাতে পারে। চিকিৎসকদের অপর্যাপ্ত পেশাদার দক্ষতা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের সাথে সম্পর্কিত জটিলতাগুলোকে আরও খারাপ করে তুলতে পারে। প্রেসক্রিপশন বা রোগ নির্ণয় ছাড়াই শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিকের সহজলভ্যতা এবং উচ্চ কার্যকারিতা অত্যধিক ব্যবহার বিশেষ করে অপব্যবহারের দিকে পরিচালিত করছে। তাই এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের নিমিত্তে শিগগিরই অ্যান্টিবায়োটিক নিরোধকের ব্যাপকতা রুখতে হবে। আর তার জন্য প্রয়োজন অ্যান্টিবায়োটিকের অপপ্রয়োগ স্থায়ীভাবে বন্ধ করা।
পড়ুন: টেক্সট নেক সিন্ড্রোম: অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলাফল
২ বছর আগে