মালয়েশিয়ান ভিসা
মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম: কীভাবে পাবেন মালয়েশিয়ান গোল্ডেন ভিসা বা ইনভেস্টর ভিসা?
মালয়েশিয়া শুধু একটি সুন্দর দেশই নয়, উন্মুক্ত অর্থনীতির পটভূমিতে বিনিয়োগকারীদের জন্য এক অপার সম্ভাবনারও জায়গা। মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম (এমএমটুএইচ) ভিসা যুক্তিযুক্তভাবে সেই বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় বিনিয়োগকারী ভিসা প্রোগ্রামটি চালু হয়েছিল ২০০২ সালে। এটি মালয়েশিয়ান গোল্ডেন ভিসা বা মালয়েশিয়ান ইনভেস্টর ভিসা নামেও পরিচিত। এরপর থেকে চীন, জাপান, যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি বিনিয়োগকারিদের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের নামও। সমূহ সুযোগ-সুবিধার কারণে অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশিদের প্রিয় গন্তব্য মালয়েশিয়া। তাছাড়া সিঙ্গাপুরের মতো দেশের প্রতিবেশী হওয়াতে দেশটি আন্তর্জাতিক ব্যবসার একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অবস্থানে অধীষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে এই এমএমটুএইচ প্রকল্প আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে দেশটিকে| এমএমটুএইচ ভিসার নানা দিক নিয়েই এবারের নিবন্ধ।
মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম (এমএমটুএইচ) ভিসা প্রকল্প
এমএমটুএইচ ভিসা মালয়েশিয়াকে বিদেশিদের কাছে বসবাসের অনুকূল স্থান হিসেবে প্রচারের জন্য একটি সরকারি উদ্যোগ। মালয়েশিয়ান পর্যটন ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রবর্তিত এই স্কিমটি সারা বিশ্ব থেকে সফল আবেদনকারীদের জন্য একটি নবায়নযোগ্য মাল্টিপল-এন্ট্রি ভিসা দিয়ে থাকে। মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রচারিত এই প্রোগ্রামে যোগ্য বিদেশিরা সর্বোচ্চ ১০ বছরের জন্য মালয়েশিয়াতে থাকার অনুমতি পান। তবে এটি কিন্তু কোনো স্থায়ী বসবাসের অনুমতি নয়। তবে এই দীর্ঘ সময়ে একাধিকবার যাওয়া-আসা করে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ভিসা নবায়ন করা যাবে।
মালয়েশিয়ান গোল্ডেন ভিসা, এমএমটুএইচ ভিসার সুযোগ-সুবিধা
এই ভিসা প্রাপ্ত বিদেশিরা তাদের ওপর নির্ভরশীল অর্থাৎ সন্তান ও বাবা-মাকে সঙ্গে আনতে পারবেন। এক্ষেত্রে সন্তানের বয়স ২১ বছরের কম হতে হবে। এর ওপরে হলে তার জন্য আলাদা ভিসা পেতে হবে।
৫০ বছর বা তার বেশি বয়সের এমএমটুএইচ ভিসাধারীরা সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে পারবেন। এটি অবশ্য সেইসব ভিসাধারীদের জন্য, যাদের নির্দিষ্ট কিছু অনুমোদিত সেক্টরে বিশেষ দক্ষতা রয়েছে। এমএমটুএইচ ধারকরা মালয়েশিয়ায় ব্যবসা স্থাপন ও বিনিয়োগ করার অনুমতি পাবেন। তারা অন্যান্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মতো একই প্রবিধানের অধীন হবেন। কিন্তু ব্যবসার দৈনন্দিন পরিচালনায় সক্রিয়ভাবে জড়িত হতে গেলে তাদেরকে অবশ্যই তাদের ভিসাকে ওয়ার্ক পারমিটে পরিবর্তন করে নিতে হবে।
আরও পড়ুন: সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভিসা সমাচার: গোল্ডেন ভিসা ও গ্রিন ভিসা
এই ভিসাধারীদের মালয়েশিয়া থেকে প্রাপ্ত আয়ের ওপর কর দিতে হবে কিন্তু আয়ের উৎস যদি অন্য দেশ হয় সেক্ষেত্রে মালয়েশিয়া সরকার তার ওপর কর আরোপ করবে না। এমনকি বিদেশি আয় বিশেষ করে পেনশনের বেলায় যদি বিদেশে কর ধার্য হয়ে থাকে, তখন মালয়েশিয়ার সরকার সেই আয় কর মুক্ত করে দেবে। এক্ষেত্রে সেই দেশটির সঙ্গে মালয়েশিয়ার দ্বৈত কর চুক্তি থাকতে হবে এবং ভিসাধারীকে নিজেকে মালয়েশিয়ার বাসিন্দা হিসেবে প্রমাণ করতে হবে।
প্রত্যেক সফল ভিসাপ্রাপ্তরা মালয়েশিয়ায় সম্পত্তি কিনতে পারবেন। সমস্ত বেচা-কেনার কার্যক্রম সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে এবং অনুমোদিত নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভেতরে হতে হবে। যেমন 'মালয় রিজার্ভ'-এর জমিগুলো বিদেশিরা কিনতে পারবেন না।
মালয়েশিয়ান ইনভেস্টর ভিসা, এমএমটুএইচ ভিসা কাদের জন্য
৫০ বছর বয়সের নিচের আবেদনকারী
→ যাদের সম্পদের মূল্য ন্যূনতম পাঁচ লাখ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত (এক লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার) এবং তিন লাখ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত (৭২ হাজার মার্কিন ডলার) ফিক্স্ড ডিপোজিট করা আছে । এক বছর ফান্ডটি গচ্ছিত রাখার পর বাড়ি কেনা, চিকিৎসা বীমা বা শিশুদের শিক্ষার খরচের জন্য এখান থেকে এক লাখ ৫০ হাজার মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত পর্যন্ত তোলা যাবে। দুই বছর পর এই ফিক্সড ডিপোজিটের অংশ প্রত্যাহার করতে তাদের গাড়ি কেনার অনুদান ব্যবহার করতে পারবেন।
→ যারা তাদের অ্যাকাউন্টে দ্বিতীয় বছর থেকে শুরু করে মালয়েশিয়ায় থাকাকালীন সময়ে সর্বনিম্ন এক লাখ ৫০ হাজার মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত ব্যালেন্স বজায় রাখতে পারবেন
→ যাদের মাসিক আয় কমপক্ষে ৪০ হাজার মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত (৯ হাজার ৫১৩ মার্কিন ডলার) বা তার সমতূল্য হতে হবে
৫০ বছর বা তার বেশি বয়সী আবেদনকারী
→ যাদের সম্পদের মূল্য তিন লাখ ৫০ হাজার মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত (৮৪ হাজার মার্কিন ডলার) এবং তারা এক লাখ ৫০ হাজার মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত (৩৬ হাজার মার্কিন ডলার) ফিক্স্ড ডিপোজিট করা আছে। এক বছর পর তারা বাড়ি কেনা, চিকিৎসা বীমা বা শিশুদের শিক্ষার খরচের জন্য এখান থেকে ৫০ হাজার মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত পর্যন্ত তুলতে পারবেন। ৫০ বছরের নিচের বয়সের আবেদনকারীদের মত এরাও দুই বছর পর তাদের ফিক্সড ডিপোজিটের অংশ প্রত্যাহার করতে তাদের গাড়ি কেনার অনুদান ব্যবহার করতে পারবেন।
আরও পড়ুন: ভারতের মেডিকেল ভিসা: আবেদনের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও ভিসা প্রসেসিং ফি
→ যারা মালয়েশিয়ায় থাকাকালীন নিজেদের অ্যাকাউন্টে নূন্যতম এক লাখ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত ব্যালেন্স বজায় রাখতে পারবেন
→ যাদের মাসিক আয় ১০ হাজার মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত বা তার বেশি। আবেদনকারী অবসরপ্রাপ্ত হলে, তাকে অবশ্যই তার দেশের সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্ত পেনশনের পরিমাণ প্রতি মাসে কমপক্ষে ১০ হাজার মালয়েশিয়ান রিঙ্গিতের সমতুল্য হতে হবে।
সকল আবেদনকারীদের জন্য প্রযোজ্য শর্তাবলী
সমস্ত আবেদনকারীদের তাদের ভিসা আবেদনের সমর্থনে একটি মালয়েশিয়ান স্পন্সর প্রয়োজন হবে। এছাড়াও, ভিসা ইস্যু করার আগে তাদের দুই হাজার মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত (৪৮০ মার্কিন ডলার) পর্যন্ত একটি ব্যক্তিগত বন্ড রাখতে হবে। আবেদনকারী যদি একজন এজেন্টকে ব্যবহার করেন তাহলে এক্ষেত্রে এজেন্ট স্পন্সর হয়ে যাবে। আর এজেন্টকে আবেদনকারীর জন্য ব্যক্তিগত বন্ড রাখতে হবে।
আবেদনকারী এবং তাদের নির্ভরশীলদের অবশ্যই মালয়েশিয়ায় বৈধ যে কোনো বীমা কোম্পানি থেকে চিকিৎসা বীমা করা থাকতে হবে। এটি বার্ধক্য পীড়িত আবেদনকারীদের জন্য প্রযোজ্য নয়। সমস্ত আবেদনকারী এবং তাদের নির্ভরশীলদের মালয়েশিয়ার যে কোনো বেসরকারি হাসপাতাল বা নিবন্ধিত ক্লিনিক থেকে ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে। শর্তসাপেক্ষ অনুমোদনের চিঠি জারি হওয়ার পরে এই উভয় শর্ত পূরণ করা হয়।
এমএমটুএইচ ভিসার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
→ প্রথমেই আবেদনপত্রের সঙ্গে একটি কভার লেটার প্রস্তুত করতে হবে।
→ জীবন বৃত্তান্তের অনুলিপি
আইএম ১২ নামে সোশ্যাল ভিজিট পাস ফর্মের তিনটি কপি। একটি আসল কপি এবং দুটি ফটোকপি কপি। আবেদনকারীকে অবশ্যই তিন কপিই পৃথকভাবে পূর্ণ করতে হবে।
আরও পড়ুন: ভারতের টুরিস্ট ভিসা কীভাবে পাবেন: আবেদনের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, প্রসেসিং ফি
→ চারটি পাসপোর্ট সাইজের ছবি
→ পাসপোর্ট বা স্ট্যাম্পসহ ভ্রমণ নথির সম্পূর্ণ কপি
→ গুড কন্ডাক্ট লেটার: আবেদনকারীর দেশ থেকে তার জন্য একটি ভালো আচরণের চিঠি নিতে হবে যেটি পুলিশ প্রতিবেদন বা দূতাবাস থেকে নেয়া যেতে পারে।
→ চিকিৎসা অবস্থার স্ব-ঘোষণা: একটি সম্পূর্ণ স্ব-ঘোষণা ফর্ম, যেখানে অংশগ্রহণকারীর চিকিৎসার ইতিহাস ও শর্তগুলো উল্লেখ করা থাকবে।
→ বিবাহের সনদপত্রের প্রত্যায়িত অনুলিপি (বিবাহিত হলে)
→ জন্ম সনদপত্রের প্রত্যায়িত অনুলিপি (শিশুদের ক্ষেত্রে)
→ ব্যাংক স্টেটমেন্টের সার্টিফাইড কপি: আয়ের প্রমাণ নিশ্চিত করতে প্রাসঙ্গিক ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট, বেতন স্লিপ এবং আর্থিক নথিপত্র। এখানে সাম্প্রতিক ৩ মাসের পে স্লিপ এবং ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বিভিন্ন ধরনের পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে আরো কিছু প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টেশন থাকতে পারে। তাই আবেদনের জন্য সমস্ত চূড়ান্ত চাহিদাগুলো সংশ্লিষ্ট এজেন্ট বা এমএমটুএইচ এজেন্সির থেকে চেক করিনে নেয়া উচিত।
এমএমটুএইচ ভিসার আবেদন পদ্ধতি
আবেদনের জন্য পর্যটন ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত পেশাদার এজেন্সির সাহায্য নেয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে সুবিধা হলো- তারা স্পন্সরের কাজটা করে দিবে। সমস্ত এমএমটুএইচ আবেদনকারীদের অবশ্যই মালয়েশিয়ার জাতীয় স্পন্সর থাকতে হবে। দুই হাজার মালয়েশিয়ান রিঙ্গিতের ব্যক্তিগত বন্ডের অর্থটি অবশ্যই আসতে হবে এই স্পন্সর থেকে। ভিসা আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্নের জন্য এজেন্সির চার্জে তারতম্য হয়। সাধারণত প্রায় আট থেকে ১০ হাজার মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত (এক হাজার ৯০০ থেকে ২৪ হাজার মার্কিন ডলার) হয়ে থাকে। এছাড়া এজেন্সি ছাড়া সরাসরি অনলাইনেও আবেদন করা যেতে পারে।
আবেদন সফলভাবে করার পর অনুমোদিত হলে একটি শর্ত অনুমোদনের চিঠি বা ডিজিটাল ইলেক্ট্রনিক ভিসা অনুমোদনপত্র (ই-ভিএএল) দেয়া হবে। এটি আসতে চার বা পাঁচ মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। এটি বিদেশিদের বৈধভাবে মালয়েশিয়া ভ্রমণের অনুমতি দেয়। মালয়েশিয়ার যাবার পর আবেদনের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে কোথাও কোনো ঘাটতি বা কোনটি অনুপস্থিত আছে কিনা তা যাচাইয়ের জন্য ছয় মাস সময় নেয়া হয়।
এমএমটুএইচ ইনভেস্টর ভিসা করতে কত টাকা লাগবে
ভিসা প্রসেসিং ফি বাবদ ডিউটি স্ট্যাম্প অফিসে একটি নিরাপত্তা বন্ড এবং একটি ব্যক্তিগত বন্ড দিতে হয়। নিরাপত্তা বন্ড মাত্র ১০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত (২.৪০ মার্কিন ডলার) এবং আর ব্যক্তিগত বন্ড সেই দুই হাজার মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত। এছাড়া ভিসা ইস্যু করার জন্য অল্প কিছু নামমাত্র অর্থ দিতে হয়। এমএমটুএইচ’র অধীনে সোশ্যাল পাসের জন্য প্রতি বছর ৯০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত (২১ মার্কিন ডলার) দিতে হয়।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ-ব্রাজিলের ভিসা অব্যাহতি চুক্তি স্বাক্ষর
পরিশেষে
শেষ কথা হলো মালয়েশিয়ান গোল্ডেন ভিসা বা মালয়েশিয়ান ইনভেস্টর ভিসা অনেক বাংলাদেশি ব্যবসায়ী এবং নাগরিকের জন্য সৌভাগ্যের দাঁড় উন্মোচন করতে পারে। সঠিক পদ্ধতিতে আবেদন করলে যোগ্য ব্যক্তিরা মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম ভিসা প্রোগ্রামে সুযোগ পেতে পারেন। মালয়েশিয়ান সরকার তার সীমানার মধ্যে নতুন ব্যবসার সহজলভ্যতা এবং অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের আর্থিক সুবিধা দেয়ার সুদূরপ্রসারি প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। স্বল্প আয়কর এবং সহজসাধ্য স্থানীয় ব্যবসায়িক আইনের মাধ্যমে এই এমএমটুএইচ ভিসা প্রোগ্রামটি উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ীদের জন্য সম্ভাবনাময় উদ্যোগ নেয়ার জায়গা প্রশস্ত করছে। এতে করে একদিকে যেমন ব্যবসায়ীদের ব্যবসার প্রসার ঘটবে, অন্যদিকে অর্থনীতি শ্রীবৃদ্ধির মাধ্যমে মালয়েশিয়ার জনশক্তি পরিণত হবে জনসম্পদে।
২ বছর আগে