রক্তের গ্রুপ
রক্তের গ্রুপ: কে কাকে রক্ত দিতে পারবে?
নিরাপদ রক্তদানের জন্য দাতা-গ্রহীতাসহ রক্তদানের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেককে যে বিষয়টিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হয়, তা হচ্ছে রক্তের শ্রেণীবিভাগ। রক্তের ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপের মধ্যে রক্তের আদান-প্রদানের সামঞ্জস্যতার ওপর নির্ভর করে জরুরি চিকিৎসার অগ্রীম প্রস্তুতি। সঠিক সময়ে সঠিক রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে বেঁচে যেতে পারে একটি জীবন। আর এই মহৎ উদ্দেশ্যকে সাধুবাদ জানিয়েই প্রতিবছর ১৪ জুন পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। এই উপলক্ষটি নিরাপদ রক্তের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ায় এবং উদ্বুদ্ধ করে এই মহান কাজে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে। চলুন, বিভিন্ন ধরনের রক্তের গ্রুপের বৈশিষ্ট্য এবং তাদের মধ্যকার সামঞ্জস্যতা সম্বন্ধে সম্যক ধারণা নেওয়া যাক।
বিভিন্ন ধরনের রক্তের গ্রুপ
রক্তের শ্রেণীবিন্যাসের নেপথ্যে রয়েছে রক্তে বিদ্যমান দুটি উপাদান।
১. লোহিত রক্তকণিকার (আরবিসি) পৃষ্ঠে থাকা প্রোটিন অণু, যার নাম অ্যান্টিজেন। অ্যান্টিজেন মুলত 'এ', 'বি', এবং ‘রেসাস (আরএইচ) ডি’ – এই ৩ ধরনের হয়ে থাকে।
২. প্লাজমাতে অবস্থিত বিভিন্ন ধরনের প্রোটিন, যেগুলো অ্যান্টিবডি নামে পরিচিত। অ্যান্টিবডি ‘অ্যান্টি-এ’ এবং ‘অ্যান্টি-বি’ – এই ২ শ্রেণীর হয়ে থাকে।
এই উপাদানগুলো মা-বাবার থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে সন্তানের দেহে আসে। রক্তের শ্রেণীবিন্যাসের মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত দুটি ব্যবস্থা হচ্ছে- ‘এবিও’ এবং ‘রেসাস (আরএইচ) ফ্যাক্টর’।
আরও পড়ুন: মুখের দুর্গন্ধ দূর করার ঘরোয়া উপায়
এবিও সিস্টেমে রক্তের ধরন ৪ প্রকার- 'এ', 'বি', 'এবি', এবং 'ও'। রক্তে অ্যান্টিজেন এবং অ্যান্টিবডির উপস্থিতির উপর নির্ভর করে এগুলোর ভিন্নতা হয়।
আরএইচ সিস্টেমে রক্তে 'আরএইচডি'র উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে এবিওর প্রত্যেকটি গ্রুপ পজিটিভ বা নেগেটিভ হয়ে থাকে। এভাবে আরএইচ সিস্টেম অনুসারে গ্রুপ হয় মোট ৮টি। চলুন, এবার এই গ্রুপগুলোর বিস্তারিত জানা যাক।
এ+
লোহিত রক্তকণিকার পৃষ্ঠে অ্যান্টিজেন 'এ' এবং 'আরএইচডি’র উপস্থিতির মাধ্যমে গ্রুপ 'এ+' চিহ্নিত করা হয়। এই গ্রুপের রক্তের প্লাজমাতে অ্যান্টি-বি অ্যান্টিবডি থাকে। এই অ্যান্টিবডিগুলো 'বি' অ্যান্টিজেনযুক্ত লোহিত রক্ত কোষকে আক্রমণ করে। 'আরএইচডি'র উপস্থিতির অর্থ হলো এই রক্ত 'এ-' রক্তের প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে। বিশেষ করে গর্ভাবস্থা এবং রক্তদানের সময় এই দুই মেরুর রক্ত শরীরের উপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে।
এ-
এই গ্রুপেও লোহিত রক্তকণিকায় অ্যান্টিজেন 'এ' উপস্থিত থাকে। তবে 'আরএইচডি'র অভাবে গ্রুপটি 'আরএইচডি-' হিসেবে প্রতীয়মান হয়। 'এ+' রক্তের মতো 'এ-' রক্তের প্লাজমাতেও অ্যান্টি-বি অ্যান্টিবডি থাকে। ফলে এটি 'বি' গ্রুপের রক্তের বিরুদ্ধে নেতিবাচক অবস্থান নেয়। অন্যদিকে, 'আরএইচডি'র অনুপস্থিতি গর্ভাবস্থায় আরএইচ অসামঞ্জস্যতার মতো জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। এ ক্ষেত্রে একজন ‘আরএইচডি-’ মায়ের রক্ত একটি ‘আরএইচডি+’ ভ্রূণের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। এতে করে নবজাতকের হেমোলাইটিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়।
আরও পড়ুন: থ্যালাসেমিয়া রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধ
বি+
বি অ্যান্টিজেন এবং 'আরএইচডি' সমন্বিত লোহিত রক্তকণিকার পৃষ্ঠ রক্তকে 'বি+' গ্রুপ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে। এই ধরনের রক্তের প্লাজমাতে থাকে অ্যান্টি-এ অ্যান্টিবডি, যা অ্যান্টিজেন 'এ' সমৃদ্ধ লোহিত রক্তকণিকার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। 'বি+' রক্তের 'আরএইচডি' 'বি-' রক্তের তুলনায় ভিন্ন প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি করতে পারে।
বি-
এই গ্রুপটি রক্তের এমন ধরনকে প্রতিনিধিত্ব করে, যার লোহিত রক্ত কণিকায় অ্যান্টিজেন 'বি' থাকে কিন্তু 'আরএইচডি' থাকে না। এই রক্তের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এর প্লাজমায় অ্যান্টি-এ অ্যান্টিবডি বিদ্যমান। আরএইচ ফ্যাক্টর না থাকার ফলে 'বি-' রক্তের অধিকারী ব্যক্তিরা রক্ত সঞ্চালন এবং গর্ভাবস্থায় মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। কেননা ‘আরএইচডি+’ ভ্রূণ বহনকারী একজন 'আরএইচডি-' মায়ের রক্ত আরএইচ ফ্যাক্টরের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে।
ও+
এই গ্রুপের রক্তে লোহিত রক্তকণিকার পৃষ্ঠে 'এ' এবং 'বি' কোনো অ্যান্টিজেনই থাকে না, কিন্তু 'আরএইচডি' থাকে। 'ও+' রক্তের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর প্লাজমায় অ্যান্টি-এ এবং অ্যান্টি-বি দুই অ্যান্টিবডিই থাকে। এতে করে এই রক্ত ‘এ’ এবং 'বি' উভয় অ্যান্টিজেন থাকা লোহিত রক্তকণিকাকে আক্রমণ করে। 'এ' এবং 'বি' অ্যান্টিজেনের অনুপস্থিতির কারণে অন্যান্য রক্তের সঙ্গে এর ব্যাপক সামঞ্জস্যতা রয়েছে।
আরও পড়ুন: সার্কেডিয়ান রিদম বা দেহ ঘড়ি নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
ও-
এটি এমন একটি গ্রুপ যার রক্তের লোহিত রক্তকণিকায় অ্যান্টিজেনে 'এ', 'বি', এবং 'আরএইচডি' কোনোটাই থাকে না। 'ও+' এর মতো এই রক্তেও প্লাজমা অ্যান্টি-এ এবং অ্যান্টি-বি অ্যান্টিবডিতে সমৃদ্ধ। এই সমস্ত অ্যান্টিজেনের অনুপস্থিতির কারণে 'ও-' রক্ত সার্বজনীন দাতার গ্রুপ হিসেবে বিবেচিত। এটি অ্যান্টিজেন সংক্রান্ত কোনো স্বাস্থ্য ঝুঁকি ছাড়াই যে কোনো রক্তের রোগীদের দেওয়া যেতে পারে।
এবি+
যে রক্তের লোহিত রক্তকণিকার পৃষ্ঠে অ্যান্টিজেন 'এ' এবং 'বি' এর পাশাপাশি আরএইচ ফ্যাক্টরও থাকে, সে রক্তের গ্রুপের নাম 'এবি+'। এ ধরনের রক্তের প্লাজমায় অ্যান্টি-এ বা অ্যান্টি-বি কোনো অ্যান্টিবডিই থাকে না। এই বৈশিষ্ট্যটি 'এবি+' রক্তকে সার্বজনীন গ্রহীতা গ্রুপ হিসেবে প্রতীয়মান করেছে। 'এ' এবং 'বি' উভয় অ্যান্টিজেন এবং আরএইচ ফ্যাক্টরের উপস্থিতির কারণে রক্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এটি সর্বাঙ্গীনভাবে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ গ্রুপ।
এবি-
লোহিত রক্ত কণিকায় 'আরএইচডি' নেই অথচ 'এ' এবং 'বি' উভয় অ্যান্টিজেনই বিদ্যমান, এমন রক্তকে চিহ্নিত করা হয় 'এবি-' হিসেবে। 'এবি+' এর মতো এই রক্তের প্লাজমাও অ্যান্টি-এ বা অ্যান্টি-বি অ্যান্টিবডি-বিহীন। 'এবি-' রক্তের অধিকারীদের আরএইচ সংবেদনশীলতা রোধ করতে অবশ্যই আরএইচ পজিটিভ রক্ত গ্রহণ থেকে দূরে থাকতে হবে।
আরও পড়ুন: অটিজম কী? অটিজম সচেতনতা ও সহমর্মিতা কেন জরুরি?
রক্তের গ্রুপগুলোর মধ্যে কে কাকে রক্ত দিতে পারবে
যে রক্তগুলো পারস্পরিক সহাবস্থানে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, অনাকাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে সেগুলোর ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরী। চলুন, রক্তের বিভিন্ন গ্রুপগুলোর মধ্যকার রক্ত সঞ্চালনের সামঞ্জস্যতা এক নজরে দেখে নেওয়া যাক।
টেবিল: রক্তের বিভিন্ন গ্রুপের সামঞ্জস্যতা সারণী
রক্তের গ্রুপ
গ্রহীতা গ্রুপ
দাতা গ্রুপ
এ+
এ+, এবি+
এ+, এ-, ও+, ও-
এ-
এ+, এ-, এবি+, এবি-
এ-, ও-
বি+
বি+, এবি+
বি+, বি-, ও+, ও-
বি-
বি+, বি-, এবি+, এবি-
বি-, ও-
ও+
এ+, বি+, এবি+, ও+
ও+, ও-
ও-
সব গ্রুপ
ও-
এবি+
এবি+
সব গ্রুপ
এবি-
এবি+, এবি-
এবি-, এ-, বি-, ও-
আরও পড়ুন: নারীদের চেয়ে পুরুষদের আত্মহত্যার হার বেশি যে কারণে
'এ+' গ্রুপের ব্যক্তিরা 'আরএইচডি' নির্বিশেষে 'এ' বা 'ও' গ্রুপ থেকে রক্ত গ্রহণ করতে পারবে, কিন্তু দিতে পারবে শুধুমাত্র 'এ+' এবং 'এবি+' গ্রুপের ব্যক্তিদের। 'এ-' গ্রুপ শুধু 'এ-' এবং 'ও-' গ্রুপ থেকে রক্ত নিতে পারবে, তবে দান করতে পারবে 'আরএইচডি' নির্বিশেষে 'এ' এবং 'এবি' উভয় গ্রুপকে।
'বি+' এর দাতা হিসেবে করতে পারে 'বি+', 'বি-', 'ও+', এবং 'ও-' গ্রুপ। অন্যদিকে গ্রহীতা হিসেবে কাজ করতে পারবে শুধু 'বি+' এবং 'এবি+' গ্রুপ। 'বি-' গ্রুপ 'বি-' এবং 'ও-' গ্রুপের রক্ত নিতে পারবে, আর রক্ত দিতে পারবে 'বি+', 'বি-', 'এবি+', এবং 'এবি-' গ্রুপগুলোকে।
'ও+' রক্তের গ্রহীতারা হলো যেকোনো আরএইচ+ গ্রুপ, তবে দাতা গ্রুপ হলো শুধু 'ও+' এবং 'ও-'। 'ও-' রক্ত গ্রহীতা হিসেবে শুধু 'ও-' রক্ত নিতে পারে, কিন্তু সার্বজনীন দাতা হিসেবে রক্ত দিতে পারে সমস্ত গ্রুপকে। অপরদিকে, সার্বজনীন গ্রহীতা হিসেবে 'এবি+' গ্রুপ সব ধরনের রক্ত গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু দাতা হিসেবে শুধু 'এবি+' গ্রুপভুক্ত ব্যক্তিদেরকেই রক্ত দিতে পারে। 'এবি-' রক্তের দাতা গ্রুপ হলো 'এবি-', 'এ-', 'বি-', এবং 'ও-' এবং গ্রহীতা গ্রুপ 'এবি+' এবং 'এবি-'।
আরও পড়ুন: সাইলেন্ট হার্ট অ্যাটাক: কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধ
শেষাংশ
সর্বপরি, লোহিত রক্তকণিকায় অ্যান্টিজেন 'এ' এবং 'বি' থাকা এবং না থাকার ভিত্তিতে রক্তের গ্রুপ যথাক্রমে 'এ' এবং 'বি' হিসেবে চিহ্নিত হয়। দুটো অ্যান্টিজেনই থাকলে 'এবি' গ্রুপ এবং দুটোর কোনটিই না থাকলে নির্ধারিত হয় গ্রুপ 'ও' হিসেবে।
পাশাপাশি আরএইচ ফ্যাক্টরের উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতি সংশ্লিষ্ট গ্রুপের সঙ্গে যথাক্রমে পজিটিভ এবং নেগেটিভি মার্ক যুক্ত করে। ৮টি গ্রুপের প্রত্যেকটি নিদেনপক্ষে নিজ গ্রুপের সঙ্গে রক্তের আদান-প্রদান করতে সক্ষম। তন্মধ্যে প্রতিটি ‘আরএইচ+’ গ্রুপকে রক্ত দিতে পারে বিধায় 'ও+' রক্তের চাহিদা থাকে সর্বাধিকা। উপরন্তু, সর্বদাতা গ্রুপ হিসেবে পরিচিত 'ও-' এবং সর্বগ্রহীতা 'এবি+'।
আরও পড়ুন: মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ: কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধ
৬ মাস আগে
মশা কেন আপনাকেই কামড়ায়?
কোথাও ঘুরতে যেয়ে বা আড্ডাতে অন্যান্যরা যখন দীর্ঘ সময় ধরে আনন্দ-উৎসবে ব্যস্ত থাকে, তখন আপনাকে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে হয় মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য। এত মানুষ থাকতে মশা যেন বেছে বেছে আপনাকেই খুঁজে পায়। আপনার রক্ত মিষ্টি-বন্ধুদের কাছে এ কথা শুনতে শুনতে আপনি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কথাটা যদিও একদম ফেলে দেয়ার মত নয়। মশারা সত্যিই মিষ্টি জিনিসের পেছনে ছুটে। তবে এটি তাদের রক্ত চোষার আসল কারণ নয়। মশা মানুষকে কামড়ায় কারণ মানুষের রক্তে মশার ডিম তৈরির প্রয়োজনীয় পুষ্টি থাকে। আর তার জন্যে রক্ত মিষ্টি হওয়ার প্রয়োজন নেই। মশা কেন আপনাকে কামড়ায় তা যাচাই করার জন্য চলুন, আগে খুঁজে বের করা যাক- ঠিক কিভাবে এত মানুষের ভীড়ে মশা আপনাকেই খুঁজে নেয়।
বেছে বেছে মশা কিভাবে আপনাকেই খুঁজে নেয়
শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় নিঃসৃত কার্বন-ডাই-অক্সাইড
মশা তার ম্যাক্সিলারি প্যাল্প নামক প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শনাক্ত করতে পারে। শ্বাস ছাড়ার সময় মানুষ বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত করে। আর গ্যাস নির্গত হওয়ার অনুপাত আরো বেড়ে যায় অত্যধিক পরিশ্রম ও ব্যায়ামের সময়। মশা পরিবেশে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের তারতম্য বুঝতে পারে। আর এভাবে সে শনাক্ত করতে পারে বেশি পরিমাণের কার্বন-ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণটা ঠিক কোন উৎস থেকে আসছে। এগুলোর মধ্যে অপেক্ষাকৃত কাছাকাছি থাকা হোস্টের দিকে মশা অগ্রসর হয়। একটি মশা ১৬৪ ফুট দূর থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণকারিকে শনাক্ত করতে পারে।
শরীরের গন্ধ
মশা কিছু নির্দিষ্ট যৌগের প্রতি আকৃষ্ট হয় যা মানুষের ত্বক এবং ঘামে থাকে। এগুলোর মধ্যে ল্যাকটিক অ্যাসিড, অ্যামোনিয়ার, ইউরিক অ্যাসিড এবং কোলেস্টেরলের প্রভাব বেশি। এই কেমিক্যাল গুলোর তারতম্য মানুষের জীনগত বৈশিষ্ট্য এবং ত্বকে থাকা নানা ধরনের ব্যাকটেরিয়ার উপর নির্ভরশীল। ল্যাকটিক অ্যাসিডের উপস্থিতি মশাদের প্রিয় মানব গন্ধ হিসেবে মনে করা হয়। ব্যায়াম করার সময় প্রচুর পরিমাণে ল্যাকটিক অ্যাসিড তৈরি হয়। তাই ব্যায়াম করার পর পরই সাবান দিয়ে গোসল করার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়।
মানুষের ত্বক আসলে বেশ কিছু আণুবীক্ষণিক ব্যাকটেরিয়ার আশ্রয়স্থল। এই ব্যাকটেরিয়া ঘামের সাথে মিশে একটি স্বতন্ত্র গন্ধ তৈরি করে। কখনো কখনো ত্বকের জীবাণুর উচ্চ বৈচিত্র্য শরীরে গন্ধের উপর প্রভাব ফেলে, যার ফলে শরীরটির প্রতি মশাদের আকর্ষণ কমে যায়। প্রভাবের এই ভালো-খারাপটি আসলে নির্ভর করে ব্যক্তির ত্বকে ব্যাকটেরিয়ার ধরনের উপর। কখনো কখনো এই ব্যাকটেরিয়াই মানুষের গোড়ালি এবং পায়ের পাতার প্রতি মশাদের বিশেষ আকর্ষণটা নির্ধারণ করে দেয়।
পড়ুন: ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু কম, তবুও আমরা উদ্বিগ্ন: স্থানীয় সরকারমন্ত্রী
দেহের তাপ
মশা আপনার যত কাছাকাছি হয়, এটি ততই আপনার শরীরের তাপ অনুভব করতে পারে। মশার পায়ে এক ধরনের সেন্সর আছে, যা ব্যবহার করে সে যে কারো শরীরের অধিক তাপ উৎপাদনকারি অংশ খুঁজে বের করতে পারে। প্রতিটি মানুষের শরীরই নির্দিষ্ট পরিমাণে তাপ উৎপন্ন করে। তাই কোন ভাবে একবার আপনার শরীরের উপর বসতে পারলেই মশা কামড়ানোর জন্য আপনার শরীরের সবচেয়ে সেরা জায়গাটি খুঁজে নিতে পারে। আর পরিশ্রম ও ব্যায়াম তাপ ও জলীয় বাষ্পের উৎপাদনশীলতাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। তাছাড়া তাপ উৎসের দিকে ধাবিত হওয়ার প্রতি স্বাভাবিকভাবেই ছোট-উড়ন্ত কীটপতঙ্গগুলোর এক ধরনের বাতিক আছে।
অন্যদের তুলনায় মশা কেন আপনাকেই বেশি কামড়ায়
রক্তের গ্রুপ
আপনার রক্তের গ্রুপ মশা কেন আপনাকেই কামড়ায়-এর ঊত্তর অনেকটাই নিশ্চিত করে দেয়। যাদের রক্তের গ্রুপ এ, তাদের প্রতি মশারা তেমন একটা আকৃষ্ট হয় না। অন্যদিকে ও গ্রুপের রক্ত মশাদের জন্য সুস্বাদু পানীয় হিসেবে দেখা হয়। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, যে মশাটি আপনাকে কামড়ায় সে যদি ম্যালেরিয়া জীবাণু বহনকারী হয়, তবে অন্যান্য রক্তের গ্রুপের লোকদের তুলনায় আপনার ম্যালেরিয়া হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম।
স্ত্রী মশারা ডিম উৎপাদনের জন্য মানুষের রক্তের প্রোটিনের উপর নির্ভর করে। এই রক্তের ধরন নির্ধারিত হয় মানুষের জীনগত বৈশিষ্ট্য দ্বারা। প্রতিটি রক্তের ধরন নির্ভর করে লোহিত রক্তকণিকার পৃষ্ঠে অ্যান্টিজেন নামক প্রোটিনের উপর। তবে রক্তের এই প্রোটিন সংগ্রহের ব্যাপারটা একেক মশার জন্য একেক রকম। যেমন এডিস মশা ও গ্রুপ থেকে প্রোটিন নেয়, যেখানে অ্যানোফিলিস পছন্দ করে এবি গ্রুপকে।
পড়ুন: ডেঙ্গুতে আজও ১ জনের মৃত্যু, শনাক্ত ৩৯৯
শরীরের স্থুলতা
মশারা সাধারণত মোটা, লম্বা বা দীর্ঘদেহী লোকদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। কারণ জায়গা যেহেতু বিশাল, সঞ্চালিত রক্ত ও পরিবহনকৃত তাপের পরিমাণও তাই একটু বেশিই হয়। এর সাথে সেই স্থুল শরীরের মানুষটি যত বেশি শ্বাস ছাড়বেন, তত বেশি মশারা তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে উঠবে। যেহেতু নাক ও মুখ দিয়েই সাধারণত কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছাড়া হয়, তাই মশা বিশেষ করে মাথাকে টার্গেট করে।
পরিধেয় কাপড়ের রঙ
মশারা কালো রঙের দিকে বেশি অগ্রসর হয়। তাই পরিধেয়ের ক্ষেত্রে যারা কালো বা অন্যান্য গাঢ় রঙ পছন্দ করেন তাদের জন্য দুঃসংবাদ। আসলে রক্ত চোষার জন্য সঠিক দেহ খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে মশারা অত্যন্ত পাকা শিকারী। তাই যারা বেশি উপদ্রবে ভুগছেন, তাদের অবশ্যই গাঢ় রঙের পোশাক যেমন কালো, নেভি এবং লাল এড়িয়ে চলা জরুরি।
গর্ভাবস্থা
সাধারণ মহিলাদের তুলনায় গর্ভবতী মহিলারা বেশি মশার উৎপাতের শিকার হন। এর কারণ গর্ভবতী মহিলাদের শরীরের তাপমাত্রা অন্যান্যদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি থাকে এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইডও বেশি নিঃসরণ করে। গর্ভাবস্থায় মহিলাদের রক্তের পরিমাণ এবং বিপাকীয় হার বেশি থাকে। এটি গর্ভবতী মহিলাদেরকে মশার কামড়ের জন্য সংবেদনশীল করে তুলে।
পড়ুন: তীব্র গরমে হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচতে করণীয়
নানা ধরনের রোগ-জীবাণু
মানুষের দেহে নানান প্রজাতির ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও পরজীবীর সংক্রমণের সাথে মশার প্রতিক্রিয়ার তারতম্য ঘটে। ডেঙ্গি এবং জিকা ভাইরাস মানবদেহের গন্ধে বেশ পরিবর্তন আনে, যা তাদেরকে মশার কামড়ের জন্য উপযুক্ত করে তোলে। এটি বেশ ফলপ্রসূ পরিস্থিতি, কারণ এটি মশাকে পোষককে কামড় দিতে, সংক্রামিত রক্ত বের করতে এবং তারপর জীবাণুটি অন্য ব্যক্তিতে ছড়াতে সহায়তা করে।
কিছু ভাইরাস আছে যেগুলো অ্যাসিটোফেনন নামের সুগন্ধযুক্ত কিটোনের নির্গমনকে পরিবর্তন করে দেহকে মশার জন্য উপযুক্ত পোষকে পরিণত করে।
মানুষের ত্বক সাধারণত একটি অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল পেপটাইড তৈরি করে যা ব্যাকটেরিয়ার বংশবিস্তার করে। ডেঙ্গ বা জিকা দ্বারা সংক্রমিত মানুষের ক্ষেত্রে, এই পেপটাইডের ঘনত্ব কমে যায় এবং কিছু ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে অ্যাসিটোফেনন উৎপাদনকে সহায়তা করে। ডেঙ্গু রোগীদের শরীরের গন্ধে সুস্থ মানুষের তুলনায় বেশি অ্যাসিটোফেনন থাকে।
কিছু জীবাণু মানবদেহকে সংক্রমনযোগ্য করে তোলার পাশাপাশি দেহের গন্ধেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনে। ম্যালেরিয়া সৃষ্টিকারী পরজীবী প্লাজমোডিয়াম ফ্যালসিপ্যারাম দ্বারা সংক্রমিত ব্যক্তিরা রোগের বাহক অ্যানোফিলিস মশার জন্য প্রিয় পোষক দেহ।
এই পরজীবিটি মশার রক্ত-সন্ধান, রক্ত চোষা এবং সংক্রমণের সংবেদনশীলতাকে প্রভাবিত করে। বিশেষ করে মানুষের লোহিত রক্ত কণিকাকে সক্রিয় করার মাধ্যমে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, অ্যালডিহাইড এবং মনোটারপিনের নির্গমন বাড়িয়ে তোলে। এতে পুরো শরীরটা মশা কামড়ানোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধে দুর্বল হয়ে পড়ে। ম্যালেরিয়া ছাড়াও এই পরজীবী অ্যানোফিলিস ও এডিস প্রজাতির মশাকে তীব্র ভাবে আকর্ষণ করে।
পড়ুন: হঠাৎ প্রেসার কমে গেলে করণীয়
শেষাংশ
আপনার দেহের উপর উপরোক্ত কারণগুলোর প্রভাব পৃথকভাবে যাচাই না করে সবগুলো একসাথে মিলিয়ে বা কয়েকটি একসাথে পর্যবেক্ষণ করুন। তবেই মশা কেন কামড়ায়- তার সঠিক উত্তরটি আপনি পেয়ে যাবেন। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে-এমনো কিছু লোক আছেন যারা অস্বাস্থ্যকর জায়গা বা উপদ্রবের সময়ের বাইরে স্বাভাবিক অবস্থায় মশার উৎপাতের বাইরে থাকেন। এদেরকে আসলে মশা কামড়ের প্রতি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা যায় না। ঘন ঘন না চুলকানোর কারণে এদের শরীরে ফোলা ফোলা ভাব বা যখম হয়ে যায় না। এই মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারটির বাইরেও ভালো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে মশার কামড় সাধারণত এদের উপর তেমন কোন নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে না।
২ বছর আগে