চোখ উঠা রোগের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
চোখ উঠা রোগের লক্ষণ, কারণ, প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
চোখ উঠা হলো কনজাংটিভা বা চোখের স্বচ্ছ ঝিল্লির প্রদাহ বা সংক্রমণ, যা চোখের পাতাকে একসাথে করে চোখের সাদা অংশ বা শ্বেতমন্ডলকে ঢেকে রাখে। যখন কনজাংটিভায় ছোট রক্তনালীগুলো স্ফীত হয়, তখন সেগুলো আরও দৃশ্যমান হয়। এই কারণেই চোখের সাদা অংশ লাল বা গোলাপী দেখায়। চোখ উঠা খুব বিরক্তিকর হলেও দৃষ্টিশক্তির উপর তেমন নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না। কিন্তু এক চোখে হলে সেটা আরেক চোখেও সংক্রমিত হতে পারে। সাধারণত এই অস্বস্তিকর অবস্থা এক কিংবা দুই সপ্তাহের মধ্যেই ঠিক হয়ে যায়। তবে এক সপ্তাহের পরেও অবস্থার উন্নতি না হলে বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। চলুন, চোখ উঠা রোগের লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকারের পাশাপাশি জেনে নেয়া যাক কিভাবে এই রোগ থেকে দূরে থাকবেন।
চোখ উঠা রোগের লক্ষণ
বিভিন্ন কারণের উপর ভিত্তি করে চোখ উঠার লক্ষণগুলোর মধ্যে তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত যে লক্ষণগুলো দেখা যায় সেগুলো হলো-
• চোখের সাদা অংশতে গোলাপি বা লাল বর্ণ হওয়া
• চোখের সাদা অংশ এবং চোখের পাতার ভেতরের অংশে রেখাযুক্ত পাতলা স্তর সৃষ্টি হয়
• চোখের পাতা ফুলে যায়
• ঘন ঘন অশ্রু বের হওয়া
• চোখে ঝাপসা দেখা এবং ঘন ঘন চোখ ঘষার উপক্রম হওয়া
• চোখে চুলকানি ও জ্বালা অনুভূত হওয়া
• চোখ থেকে পুঁজ বা শ্লেষ্মা নিঃসৃত হয়ে চোখের পাপড়ি ও চক্ষুলোম ভিজে যেতে পারে বিশেষ করে সকালে ঘুম থেকে উঠার সময়। ফলে চোখ সম্পূর্ণ মেলে তাকাতে কষ্ট হয়।
পড়ুন: মশা কেন আপনাকেই কামড়ায়?
চোখ উঠা রোগের কারণ
ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়াজনিত
এ ধরনের রোগ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অ্যাডিনোভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট হয়, তবে হার্পিস সিমপ্লেক্স, ভেরিসেলা জোস্টার এবং করোনা ভাইরাস সহ অন্যান্য বিভিন্ন ভাইরাসের কারণেও হতে পারে।
ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়াজনিত উভয় ক্ষেত্রে সর্দি বা শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ ঘটতে পারে। অপরিষ্কার কন্টাক্ট লেন্স থেকেও হতে পারে এই ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ। এ সময় ব্যাকটেরিয়া সংক্রামিত ব্যক্তির চোখ থেকে নিঃসৃত তরলের সাথে ছড়িয়ে পড়ে। তখন একটি বা উভয় চোখই প্রভাবিত হতে পারে।
অ্যালার্জির কারণে
এটি মূলত পোলেন বা পরাগরেণুর মতো অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী পদার্থের প্রতিক্রিয়া। এর ফলে শরীর ইমিউনোগ্লোবুলিন-ই (আইজিই) নামে একটি অ্যান্টিবডি তৈরি করে। এই অ্যান্টিবডি চোখের মিউকাস আস্তরণের এবং শ্বাসনালীতে মাস্ট সেল নামে বিশেষ কোষগুলোকে উদ্দীপিত করে, যা হিস্টামিন সহ প্রদাহজনক পদার্থগুলোর কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। শরীর থেকে শুধুমাত্র এই হিস্টামিন নিঃসরণই যথেষ্ট চোখ উঠা রোগের সব রকম লক্ষণ এবং উপসর্গ দৃশ্যমান করতে। এ সময় তীব্র চুলকানি, চোখ ফেটে যাওয়া এবং প্রদাহ অনুভূত হবে। সেইসাথে হাঁচি এবং অবিরাম সর্দি হতে পারে।
পড়ুন: অ্যান্টিবায়োটিক-এর অপপ্রয়োগ: কেন অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করছে না?
চোখ জ্বালা-পোড়া বা প্রদাহ থেকে
চোখ রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে চোখে জ্বালা-পোড়া ভাব সৃষ্টি হতে পারে। কখনও কখনও এই রাসায়নিক বস্তু থেকে মুক্তির জন্য চোখ ঘষার কারণেও লালভাব এবং জ্বালা সৃষ্টি করে। এর ফলে চোখে পানি জমে থাকা এবং শ্লেষ্মা নির্গত হওয়ার মত পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। অবশ্য এগুলো সাধারণত প্রায় এক দিনের মধ্যে নিজেই পরিষ্কার হয়ে যায়।
যদি তা না হয় বা রাসায়নিক বস্তুটি যদি চোখের সাথে লেগে থাকে, তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাক্তার বা চক্ষু বিশেষজ্ঞের সাথে দেখা করতে হবে। চোখের মধ্যে যে কোন রাসায়নিক বস্তুর উপস্থিতি চোখের স্থায়ী ক্ষতি করতে পারে। ক্রমাগত উপসর্গগুলোর দীর্ঘস্থায়ী হওয়া চোখে রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি প্রমাণ করে। আবার অনেক সময় চোখ জোরে জোরে ঘষার কারণেও কর্নিয়া বা চোখের বলের আবরণে আঁচড় পড়তে পারে।
চোখ উঠা রোগের ঘরোয়া প্রতিকার
ঠান্ডা ভাপ দেয়া
চোখে ঠান্ডা বাপ দেয়া চরম ব্যথা থেকে তাৎক্ষণিক আরাম দিতে পারে। প্রথমে লিনেন কাপড়ের এক বা একাধিক ছোট টুকরা বরফ-ঠান্ডা জলে ডুবিয়ে রাখতে হবে। তারপর কাপড় থেকে বাড়তি পানি ঝরিয়ে চোখে লাগানো যেতে পারে। এটি চোখের মধ্যে প্রবেশ করা রাসায়নিক পদার্থের কারণে চুলকানি এবং ফোলাভাব কমাতে সাহায্য করতে পারে। কমপক্ষে ৫ থেকে ১০ মিনিটের ধরে এটি বেশ কয়েকবার করা যেতে পারে। সংক্রমণ এড়াতে উভয় চোখের জন্য ভিন্ন কাপড়ের টুকরো ব্যবহার করা উত্তম।
পড়ুন: তীব্র গরমে হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচতে করণীয়
লবণ চিকিৎসা
স্যালাইন দ্রবণ দিয়ে চোখ ধোয়া অ্যালার্জির বিরুদ্ধে একটি কার্যকর ঘরোয়া প্রতিকার। এই দ্রবণে থাকে সাধারণ লবণ, যা চোখের জ্বালা কমাতে সক্ষম। তবে খেয়াল রাখতে হবে যে, গরম স্যালাইন দ্রবণ যেন ব্যবহার করা না হয়। এতে চোখের ভালোর চেয়ে ক্ষতিই হয়ে যেতে পারে।
গোলাপ জলের ফোটা
গোলাপ জলে প্রদাহরোধী এবং প্রশান্তিদায়ক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সংক্রামিত চোখে প্রতিদিন কয়েক ফোঁটা গোলাপ জল ২ থেকে ৩ দিনের জন্য চোখের অ্যালার্জি নিরাময়ে সহায়তা করতে পারে। গোলাপজলে ডুবিয়ে তুলোর বলও চোখের ওপর রাখা যেতে পারে। এটি চোখের বিরক্তি লাঘব করবে। গোলাপ জল চোখে শীতলতা প্রদানের পাশাপাশি ধূলিকণা থেকে মুক্তি পেতেও সাহায্য করে।
পড়ুন: এয়ার কন্ডিশনার ছাড়াই গরমে ঘর ঠান্ডা রাখার কার্যকরী উপায়
অ্যালোয়ভেরা জেল ব্যবহার
অ্যালোয়ভেরায় অ্যালোইন এবং ইমোডিনের মতো যৌগ বিদ্যমান, যাতে রয়েছে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টি-ভাইরাল বৈশিষ্ট্য। এই কারণে অ্যালোয়ভেরা জেল চোখের অ্যালার্জি বিরুদ্ধে একটি কার্যকর ঘরোয়া প্রতিকার। অ্যালোয়ভেরা প্রদাহ কমাতেও সাহায্য করে এবং ধূলিকণার কারণে সৃষ্ট অ্যালার্জির বিরুদ্ধে নিরাময় প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। সংক্রামিত এলাকার চারপাশে অ্যালোয়ভেরা জেল প্রয়োগ করা যেতে পারে।
হলুদ জলের উষ্ণ ভাপ
হলুদের গুঁড়ার অনেক নিরাময় বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি হচ্ছে, চোখের এই অ্যালার্জির বিরুদ্ধে কার্যকারিতা। হলুদ চোখের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করতে পারে। এটিতে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা চোখের অন্যান্য যাবতীয় সংক্রমণ প্রতিরোধ করে। সিদ্ধ হলুদ জলের পাত্রে এক টুকরো তুলা বা কাপড় ভিজিয়ে তার উষ্ণ ভাপ ক্ষতিগ্রস্ত চোখে দিলে অনেক উপকার পাওয়া যায়।
পড়ুন: উচ্চ রক্তচাপ (হাই প্রেশার) হলে যা এড়িয়ে চলা উচিত: ক্ষতিকর খাবার, পানীয়, অভ্যাস
চোখ উঠা রোগের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
এই রোগ প্রতিরোধের সর্বোত্তম উপায় হলো এর কারণগুলো খুঁজে বের করে তা থেকে দূরে থাকা।
• যে সময়টিতে বাতাসে পরাগরেণুর সংখ্যা বেশি থাকে সে সময়টিতে যথাসম্ভব দরজা-জানালা বন্ধ রেখে ঘরের ভেতরে থাকতে হবে। সাধারণত মধ্য-সকাল এবং সন্ধ্যার প্রথম দিকে বাতাসে পরাগরেণুর সংখ্যা সর্বোচ্চ হয়।
• অনেক ঘাস, ফুল বা গাছ আছে এমন জংলা এলাকা এড়িয়ে চলতে হবে
• বাইরে থেকে ঘরে ফিরেই গোসল করে পোশাক বদলে ফেলতে হবে
• ধূলাবালি, পরাগরেণু, ময়লার প্রতি বেশি অ্যালার্জি থাকলে অন্য কাউকে দিয়ে ঘরের আঙ্গিনা, কার্পেট, আসবাবপত্র ও বাগান পরিষ্কার করিয়ে নিতে হবে। নিজে পরিষ্কার করলে সাবধানে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার অথবা একটি পরিষ্কার স্যাঁতসেঁতে কাপড় ব্যবহার করতে হবে
• পারফিউম বা নির্দিষ্ট কোন গন্ধে অ্যালার্জি থাকলে গন্ধমুক্ত সাবান এবং ডিটারজেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে
• পোলেন গৃহস্থালি বা ঘরের পোষা বিভিন্ন প্রাণী থেকেও ছড়ায়। তাই যাদের বাড়িতে পোষা কুকুর, বিড়াল আছে তাদেরকে সাবধান হতে হবে। পোষা প্রাণীটিকে রাখতে হবে বেডরুমের বাইরে। কাউকে দিয়ে তাদেরকে নিয়মিত গোসল করাতে হবে। পাশাপাশি সেগুলোর থাকার জায়গাও নিয়মিত ধুয়ে ফেলতে হবে।
• চোখ রক্ষা করতে পুরো চোখ ঢাকা সানগ্লাস ব্যবহার করা যেতে পারে|
পড়ুন: টেক্সট নেক সিন্ড্রোম: অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলাফল
শেষাংশ
চোখ উঠা রোগের লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার জানার মাধ্যমে এই রোগ থেকে সাবধান থাকা যায়। যারা কন্টাক্ট লেন্স পরেন তাদেরকে এ রোগের ক্ষেত্রে সাবধান থাকতে হবে। লক্ষণ শুরু হওয়ার সাথে সাথে কন্টাক্ট লেন্স পরিহার করাই উত্তম। চোখ উঠা রোগের উপর ঋতুগত প্রভাব আছে। ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে ব্যাকটেরিয়াজনিত, গ্রীষ্মের মাসগুলোতে ভাইরাসজনিত এবং অ্যালার্জিজনিত চোখ উঠা পুরো বসন্ত ও গ্রীষ্ম জুড়ে দেখা যায়। তাই প্রতিরোধমুলক ব্যবস্থাগুলো সারা বছর ধরেই নেয়া উচিত।
২ বছর আগে