ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার
ই-রিটার্ন: অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করবেন যেভাবে
বিগত করবর্ষের ন্যায় এবারও যথারীতি অনলাইনে ই-রিটার্ন দাখিলের সুবিধা থাকছে। দেশের যেসকল নাগরিকের টিআইএন (ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার) নম্বর আছে, তারা এই সুযোগটি নিতে পারবেন। সুতরাং নথিকরণ, ভিড় এবং সময় ক্ষেপণের বিড়ম্বনা এড়িয়ে এবারও ঘরে বসেই আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া যাবে। সদ্য টিনপ্রাপ্ত থেকে শুরু করে দীর্ঘ দিন যাবত আয়কর প্রদানকারী সব পেশার মানুষকে একটি নির্ভরযোগ্য প্লাটফর্মের আওতাভুক্ত করেছে এই ইলেক্ট্রনিক পরিষেবা। প্রত্যেক ব্যবহারকারীর জন্য পৃথক অ্যাকাউন্ট বা প্রোফাইলের ব্যবস্থা থাকায় প্রতিবার বিগত বছরের হিসেব নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয় না। চলুন, এই পরিষেবাটি ব্যবহারের পূর্বশর্ত এবং পদ্ধতি সম্বন্ধে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
ই-রিটার্ন দাখিলের জন্য কি কি প্রয়োজন
এনবিআর (ন্যাশনাল বোর্ড অফ রেভেনিউ)-এর ইলেক্ট্রনিক ট্যাক্স রিটার্ন সিস্টেমটি ব্যবহারের জন্য দরকার হবে একটি বায়োমেট্রিক করা মোবাইল নাম্বার এবং ই-টিন নম্বর। এখানে মূলত মোবাইল নাম্বারটি জাতীয় পরিচয় পত্র বা এনআইডি কার্ডের সঙ্গে যুক্ত আছে কিনা তা যাচাই করা হয়।
বায়োমেট্রিক যাচাইয়ের জন্য মোবাইল থেকে *১৬০০১# নাম্বারে ডায়াল করতে হবে। এরপরের কাজ হলো এনআইডির সর্বশেষ চারটি সংখ্যা উল্লেখ করে সেন্ড করা। এর কিছুক্ষণ পরেই মোবাইলে ম্যাসেজের মাধ্যমে উল্লেখিত এনআইডি নাম্বারের সঙ্গে সংযুক্ত ফোন নাম্বারগুলোর তালিকা পাঠানো হবে। এই নাম্বারগুলো প্রত্যেকটি বায়োমেট্রিক করা। অন্যথায় এই তালিকা সম্বলিত ম্যাসেজটি আসবে না।
আরো পড়ুন: আয়কর রিটার্ন জমা দেয়ার পদ্ধতি
ই-রিটার্নের সঙ্গে সংযুক্তি হিসেবে আলাদা করে কোনো কাগজপত্র দিতে হয় না। কেবল প্রয়োজনীয় তথ্যাবলি নির্ভুলভাবে দিতে হয়। তবে তথ্যের ত্রুটিহীনতা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট নথিপত্র সঙ্গে থাকা আবশ্যক। তাছাড়া কর অফিস থেকে যাচাইয়ের ক্ষেত্রে প্রতিটি তথ্য-প্রমাণ যেন দেখানো যায় তার জন্যও কাগজপত্র আগে থেকেই প্রস্তুত রাখা বাঞ্ছনীয়।
অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার পদ্ধতি
.
ই-ট্যাক্স এনবিআর সাইটে নিবন্ধন
প্রথমেই সরাসরি চলে যেতে হবে এনবিআর-এর ই-রিটার্ন ওয়েবসাইটে (https://etaxnbr.gov.bd/)। এখানে প্রদত্ত পরিষেবাগুলো থেকে ‘ই-রিটার্ন’ অপশনে গেলে একটি নতুন উইন্ডো আসবে, যেখানে সাইটটিতে নিবন্ধন করা আছে কিনা- তা জানতে চাওয়া হবে।
এখানে ‘আই অ্যাম নট ইয়েট রেজিস্টার্ড’ বাটনে ক্লিক করা হলে নিবন্ধন পেজে নিয়ে যাওয়া হবে।
এই সাইনআপ পেজে ১২ সংখ্যার টিন নাম্বার,বায়োমেট্রিক করা মোবাইল নাম্বার এবং ক্যাপচা সঠিকভাবে পূরণ করে ‘ভেরিফাই’তে ক্লিক করতে হবে।
এরপর উল্লেখিত ফোন নাম্বারে ম্যাসেজের মাধ্যমে ছয় অংকের একটি ওটিপি কোড আসবে। এটি সাইনআপ পেজের নির্দিষ্ট স্থানে বসিয়ে পরপর দুইবার একটি নতুন পাসওয়ার্ড সরবরাহ করতে হবে।
এখানে উল্লেখ্য যে,পাসওয়ার্ডটি অবশ্যই আলফানিউমেরিক তথা অঙ্ক,অক্ষর ও বিভিন্ন চিহ্ন সম্বলিত হতে হবে। সহজ বা ছোট পাসওয়ার্ড গ্রহণযোগ্য নয়। বিধায় নিবন্ধন প্রক্রিয়া সামনের দিকে অগ্রসর হবে না। শক্তিশালী পাসওয়ার্ড দিয়ে সাবমিট করার সঙ্গে সঙ্গেই ই-রিটার্ন অ্যাকাউন্ট তৈরি হয়ে যাবে।
এখানে মনে রাখতে হবে যে,ই-টিন যেহেতু এনআইডি দিয়ে করা হয় তাই এই সিস্টেমে দেওয়া নাম এবং মোবাইল নাম্বারের সঙ্গে বায়োমেট্রিক করা ব্যক্তির নাম একই হতে হবে। অর্থাৎ একজ ন ব্যক্তি তার নিজের বায়োমেট্রিক ভেরিফাই করা ফোন নাম্বার দিয়ে অ্যাকাউন্ট তৈরি করে তা থেকে অন্যজনের রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন না।
নিবন্ধনের পর এবার সেই টিন নাম্বার,পাসওয়ার্ড ও নতুন ক্যাপচা পূরণ করে সাইন ইন করলে ই-রিটার্ন ড্যাশবোর্ডটি দেখা যাবে।
আরো পড়ুন: সঞ্চয়পত্রে যেভাবে বিনিয়োগ করবেন
রিটার্ন জমার ক্যাটাগরি নির্বাচন
ড্যাশবোর্ডে বাম পাশের মেনু বারে ‘সাবমিশন’ মেনুতে রয়েছে দুই ধরনের রিটার্ন পেজ। একটি সিঙ্গেল পেজ ও অপরটি রেগুলার রিটার্ন পেজ।
সিঙ্গেল পেজ রিটার্ন
প্রধানত ৭টি শর্ত পূরণ সাপেক্ষে এক পেজ-এ রিটার্ন জমা দেওয়া যেতে পারে। সেগুলো হলো:
• বার্ষিক করযোগ্য আয় অনূর্ধ্ব পাঁচ লাখ টাকা
• সঞ্চিত সম্পদের পরিমাণ ৫০ লক্ষ টাকার কম
• গণকর্মচারী নন
• মোটরগাড়ির মালিকানা নেই
• সিটি করপোরেশনে কোনো বাড়ির মালিকানা নেই
• বিদেশে কোনো পরিসম্পদ নেই
• কোনো কোম্পানির শেয়ার নেই
এই মাধ্যমে এক পেজের মধ্যেই রিটার্নের যাবতীয় তথ্যাদির খসড়া করা যায়। এর মধ্যে থাকে আয়ের উৎস,মোট আয়,জীবনযাপন ব্যয়,সামগ্রিক পরিসম্পদ,আরোপযোগ্য কর,কর রেয়াত,উৎসে কর্তিত কর, প্রদেয় কর এবং রিটার্নের সঙ্গে দেওয়া কর।
সব তথ্য প্রদান শেষে পেজটি ড্রাফট হিসেবে রাখা যায়,আবার ‘সাবমিট’ বাটনে ক্লিক করে সঙ্গে সঙ্গেই অনলাইন জমা সম্পন্ন করা যায়।
আরো পড়ুন: বন্ডে বিনিয়োগের আগে যেসব বিষয়ে খেয়াল রাখা জরুরি
রেগুলার ই- রিটার্ন
উপরোক্ত ৭ শর্তের বাইরে থাকা প্রত্যেক ব্যক্তিকেই এই বিস্তারিত রিটার্ন পদ্ধতিতে অগ্রসর হতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় কর যাচাই, আয়-ব্যয়,বিনিয়োগ,সম্পদ,ঋণ এবং কর রেয়াতের মতো সনাতন পদ্ধতির বিষয়গুলো বিস্তারিত তথ্যের জন্য পৃথক স্ক্রিনে দেখানো হবে।
কর যাচাইয়ের তথ্য
এ অংশে প্রথমেই রিটার্ন স্কিম ঘরে সেল্ফ,এসেস্মেন্ট বর্ষ ও ইনকাম বর্ষের ঘরে সাল ও তারিখ পূর্ব নির্ধারিত থাকবে। আয় করমুক্ত হলে আয়ের পরিমাণের পাশাপাশি ‘রেসিডেন্ট স্ট্যাটাস’ উল্লেখ করে দিতে হবে।
ডানপাশের হেডস অব ইনকামের নিচে যে অপশনগুলো রিটার্নদাতার জন্য প্রযোজ্য শুধুমাত্র সেগুলোতেই তিনি টিক দেবেন। এই হেডগুলোর মাধ্যমে ব্যক্তির আয়ের উৎস বা খাত নির্ধারিত হয় এবং সে অনুসারে পরের স্ক্রিণগুলো ভিন্ন হয়ে থাকে।
পরবর্তী ধাপে যাওয়ার জন্য একদম নিচের দিকে রয়েছে ‘সেভ অ্যান্ড কন্টিনিউ’ বাটন।
আরো পড়ুন: ২০২৪ সালে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান ১০ মুদ্রা
অতিরিক্ত তথ্য
পূর্বের স্ক্রিণে প্রদত্ত তথ্যে জের ধরে এখানে যাচাইকরণের জন্য আরও বিস্তারিত তথ্য দিতে হয়। যেমন- কাজের স্থান,মুক্তিযোদ্ধা বা প্রতিবন্ধী কিংবা অন্য প্রতিবন্ধীর আইনি অভিভাবক কিনা, বিনিয়োগের জন্য কর রেয়াত,কোনো কোম্পানির শেয়ার আছে কিনা,মোটরগাড়ি বা সিটি করপোরেশনে নিজস্ব বাড়ি ইত্যাদি।
আইটি১০বি
এই সেকশনটির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে আইটি১০বি। যাবতীয় সম্পদের পরিমাণ যদি ৪০ লাখ টাকা বা তার বেশি হয় সেক্ষেত্রে এই হেডটিতে টিক মার্ক দিতে হবে। প্রদত্ত পরিমাণ সম্পদ না থাকলে আর এই অপশনে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে এক্ষেত্রে ব্যক্তির পরিবারের বার্ষিক খরচের হিসেব অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।
এরপর ‘সেভ অ্যান্ড কন্টিনিউ’ দিয়ে পরবর্তী ধাপে যাওয়ার পর একে একে এসেস্মেন্ট,ইনকাম,এক্সপেনডিচার,এসেট্স অ্যান্ড লায়াবিলিটিস এবং ট্যাক্স অ্যান্ড পেমেন্ট ট্যাবগুলোর ভিন্ন ভিন্ন পেজগুলো আসবে।
আরো পড়ুন: ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডে প্রবাসী বাংলাদেশিরা যেভাবে বিনিয়োগ করবেন
আয়ের বিস্তারিত বিবরণ
এখানে রয়েছে বৈদেশিক আয় বা কর-অব্যাহতি এবং বেতন বা করযোগ্য বিনিয়োগ ছাড়া অন্যান্য উৎস থেকে আয়।
‘এনি আদার ইনকাম’ অপশনে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিস্তারিত তথ্যসহ অন্যান্য আয়ের উৎস এবং সংশ্লিষ্ট ব্যয়ের হিসেব যুক্ত হবে। এই তথ্যগুলো নেট আয়ের হিসাবে যুক্ত হবে।
ব্যয়ের খাত
এই বিভাগটিতে সারা কর বছরে মোট আয়ের বিপরীতে প্রতিটি ব্যয়কে একত্রিত করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে গৃহস্থালি ও ইউটিলিটিসহ বাসস্থান, খাদ্য, পোশাক, পরিবহন, বাচ্চাদের স্কুল খরচ এবং অন্যান্য বিবিধ ব্যয়।
সম্পদ, ঋণ ও বিনিয়োগ খাত
এখানে যুক্ত হবে বিমা, ডিপোজিট প্রিমিয়াম সার্ভিস, সঞ্চয়পত্র, প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং স্টক বা শেয়ারসহ যাবতীয় বিনিয়োগগুলো। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি অপশনের সংশ্লিষ্ট স্থানগুলোতে রয়েছে স্পষ্ট ও বিস্তারিত তথ্য প্রদানের জায়গা।
কর ও পরিশোধ
সামগ্রিক রিটার্নে কোনো করযোগ্য আয় বা বকেয়া অথবা অগ্রিম কর থাকলে তার স্বয়ংক্রিয় হিসাব হবে এই অংশে। উৎসে কর্তনকৃত কর এবং অগ্রিম কর প্রদান করা হলে তা নেট হিসেবে বাদ যাবে। আয়ের উপর কোনো কর বকেয়া বা ধার্য না হলে প্রদেয় করের পরিমাণ শূন্য হবে আর এভাবে প্রদান করা রিটার্ন ‘শূন্য রিটার্ন’ নামে পরিচিত।
আরো পড়ুন: পুরনো স্বর্ণ বিক্রির সময় যে কারণে দাম কেটে রাখা হয়
যাবতীয় ডেটা সরবরাহের পর ট্যাক্স পেমেন্ট স্ট্যাটাসে ক্লিক করলে কর হিসাবের একটি সারাংশ দেখানো হবে। অতঃপর কোনো করযোগ্য পরিমাণ উল্লেখ থাকলে এবার তা পরিশোধের পালা।
এর জন্য ‘পে নাউ’ বাটনে ক্লিক করলে অর্থপ্রদানের জন্য কার্ড, অনলাইন ব্যাংকিং এবং মোবাইল ব্যাংকিং-এই তিনটি অপশন প্রদর্শিত হবে। এগুলোর যেকোনোটি নির্বাচন করে অনায়াসে নেট করটি তাৎক্ষণিকভাবে পরিশোধ করা যাবে।
ই-রিটার্ন সনদ সংগ্রহ
রিটার্ন জমা দেওয়ার পর কর প্রদানের রশিদ ও রিটার্ন সনদসহ প্রত্যেকটি ট্যাক্স রেকর্ড সঙ্গে সঙ্গেই প্রস্তুত হয়ে যাবে। এই গুরুত্বপূর্ণ নথিগুলো যেকোনো সময় বিভিন্ন প্রয়োজনে এখান থেকে ডাউনলোড এবং প্রিন্ট করে কাজে লাগানো যাবে।
এতক্ষণ ধরে যে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে তার সবগুলো সহ পুরো রিটার্নটি অ্যাকাউন্টে নিরাপদে সংরক্ষিত অবস্থায় থেকে যায়। এতে করে পরের বছরে নতুন করে পুরোনো হিসাব নিয়ে চিন্তায় পড়তে হয় না।
আরো পড়ুন: সঞ্চয়পত্রের সঙ্গে সংযুক্ত ব্যাংক পরিবর্তন করে অন্য ব্যাংকে স্থানান্তরের উপায়
শেষাংশ
অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিলের এই পদ্ধতি পুরোনো নথিকরণ এবং জটিল হিসেব-নিকেশের বিড়ম্বনা অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। তবে ই-ট্যাক্স এনবিআর সাইটে তথ্য প্রদানের পূর্বে অবশ্যই রিটার্নের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিটি কাগজপত্র যোগাড় করে রাখা উচিত। ই-রিটার্নের সঙ্গে কোনো কাগজ জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা না থাকলেও তথ্য পূরণে ত্রুটিহীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সেগুলো সঙ্গে রাখা জরুরি। অ্যাকাউন্ট খোলা এবং তা যেকোনো সময় ব্যবহারের ক্ষেত্রে বায়োমেট্রিক ভেরিফাইড ফোন নম্বর অপরিবর্তিত রাখার কোনো বিকল্প নেই। প্রদান করা প্রতিটি তথ্য এই অ্যাকাউন্টে সংরক্ষিত থাকে ফলে পরের বছরে জমা দেওয়ার সময় রিটার্নের তথ্যে সামঞ্জস্যতা রাখা যায়।
আরো পড়ুন: সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষে নগদায়ন বা পুনরায় চালু করার উপায়
৩ সপ্তাহ আগে
অনলাইনে ই-টিন সার্টিফিকেট করার পদ্ধতি ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
টি-আই-এন বা ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বারসহ একজন আয়কর যোগ্য নাগরিক কোন কর অঞ্চলের আওতাভুক্ত তার যাবতীয় তথ্য সম্বলিত নথিপত্রটিকে সংক্ষেপে টিন সার্টিফিকেট বলা হয়। প্রাথমিকভাবে নাগরিকটি কর দেয়ার জন্য উপযুক্ত হয়েছেন কিনা তা যাচাইয়ের জন্য সরকারের নিকট ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল করতে হয়। এই রিটার্ন জমা দানের সময় টিন সংখ্যাটির প্রয়োজন হয়। রিটার্নে প্রদানকৃত তথ্যের ভিত্তিতে নাগরিকের উপর কর ধার্য হয়। প্রতি অর্থ বছরে তিনি সেই পরিমাণ কর দিতে বাধ্য থাকেন। অর্থাৎ সামগ্রিক কর ব্যবস্থার মূলে আছে টিন সনদপত্র। বর্তমানে ইন্টারনেট থেকে এর ইলেকট্রনিক সংস্করণও সংগ্রহ করা যায়, যা ই-টিন নামে পরিচিত। এই নিবন্ধটিতে অনলাইনে ই-টিন সার্টিফিকেট করার উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
কাদের জন্য ই-টিন করা জরুরি
যেহেতু আয়করযোগ্য প্রতিটি ব্যক্তিকেই রিটার্ন জমাদানের জন্য টিন করতে হয়, তাই প্রথমেই জেনে নেয়া জরুরি কাদের জন্য আয়কর দেয়া আবশ্যক।
আয়করযোগ্য ব্যক্তি
অনিবাসী বাংলাদেশীদের যাদের স্থায়ী ভিত্তি আছে, হিন্দু যৌথ পরিবার, ব্যক্তি সংঘ, অংশীদারী ফার্ম এবং আইনত সৃষ্ট কৃত্রিম ব্যক্তি, যাদের আয়কৃত টাকার পরিমাণ ২ লাখ ৫০ হাজারের উপরে। তবে এদের মধ্যে
· মহিলা এবং ৬৫ বছর বা তদুর্ধ্ব বয়সের ব্যক্তিদের আয়ের পরিমাণ ৩ লাখ টাকার উপরে হতে হবে
· প্রতিবন্ধিদের আয়ের পরিমাণ ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকার উপরে হতে হবে
· গেজেট ভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের আয়কৃত টাকার পরিমাণ ৪ লাখ ২৫ হাজারের উপরে হতে হবে|
পড়ুন: বাংলাদেশে ই-পাসপোর্ট করার নিয়ম: প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও খরচ
ই-টিন সনদ যাদের জন্য আবশ্যক
· মোটরযানের মালিকানা লাভ করলে
· মূল্য সংযোজন করের অধীনে নিবন্ধিত ক্লাবের সদস্য পদ থাকলে
· ব্যবসা বা পেশা পরিচালনার নিমিত্তে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা কিংবা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্স প্রাপ্ত হলে
· ডাক্তার, দন্ত বিশেষজ্ঞ, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট, আইনজীবী, প্রকৌশলী, স্থপতি বা সার্ভেয়ার বা অন্য কোন অনুরূপ পেশাদার সংস্থার সাথে নিবন্ধিত হলে
· আয়কর অনুশীলনকারী বোর্ডের সাথে নিবন্ধিত হলে
· চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ বা ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন বা সংস্থার সদস্যপদের অধিকারি হলে
· পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন বা সংসদ সদস্যবৃন্দ হলে
· স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, সরকারী বা আধা-সরকারি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত দরপত্রে অংশগ্রহণকারি হলে
· কোম্পানি বা কোম্পানির একটি গ্রুপের পরিচালনা পর্ষদের কর্মকর্তা হলে
· ব্যাংক থেকে প্রাইজ বন্ড বা সেভিং সার্টিফিকেট কিংবা ক্রেডিট কার্ডধারী হলে|
পড়ুন: শিশুদের ই-পাসপোর্টের নিয়ম
ই-টিন সার্টিফিকেট থাকার সুবিধা
· এই শংসাপত্রটি থাকলে যে কেউ ব্যাংক থেকে ২ লাখ বা তার বেশী অঙ্কের টাকার সঞ্চয়পত্র তৈরি করতে পারবে
· ক্রেডিট কার্ড গ্রহণ করতে পারবে
· কমার্শিয়াল ব্যাংক অথবা লিজিং কোম্পানি থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারবে
· সাধারণ বীমার সার্ভেয়ারের লাইসেন্স নিতে পারবে
· কোম্পানি আইন ১৯৯৪-এর আওতায় কোম্পানীর স্পন্সর পরিচালক এবং যে কোন শেয়ারহোল্ডারের সংশ্লিষ্ট কোম্পানীর পরিচালক হতে পারবে
· আমদানি সংক্রান্ত ব্যবসা ক্ষেত্রে আমদানিপত্র নিবন্ধন করতে পারবে
· আবশ্যিক না হলেও ব্যাংকে সেভিংস ও কারেন্ট একাউন্ট পরিচালনা করতে টিনের প্রয়োজন হয়। তবে এই একাউন্টগুলোতে টিন থাকার সুবিধা হলো- অধিক পরিমাণ লেনদেন করা যায়, সুদের উপর কম ট্যাক্স ধার্য হয় প্রভৃতি।
· ব্যাংকে জমাকৃত অর্থের উপর অর্জিত সুদ বা লাভ থেকে বর্তমানে ১৫ শতাংশ ট্যাক্স ধার্য করা হয়। এখানে টিন থাকলে সেই সুদ বা লাভের উপর ধার্যকৃত ট্যাক্স কমে ১০ শতাংশ হয়।
পড়ুন: জন্ম নিবন্ধন ইংরেজি করার ডিজিটাল পদ্ধতি
অনলাইনে ই-টিন সার্টিফিকেট করার উপায়
ই-টিন করতে যা যা প্রয়োজন
অনলাইনে টিন সার্টিফিকেট করার জন্য শুধু এনআইডি (ন্যাশনাল আইডেন্টিটি) কার্ড সাথে থাকলেই হয়। তবে ব্যবসা বা কোম্পানির ক্ষেত্রে আরো কিছু কাগজপত্রের প্রয়োজন পড়ে। যেমন-
· ম্যামোর্যান্ডাম অফ আর্টিকেল (এমওএ)
· আর্টিকেল অফ অ্যাসোসিয়েশন (এওএ)
· ট্রেড লাইসেন্স
· ইনকর্পোরেশন সার্টিফিকেট|
ধাপে ধাপে ই-টিন সার্টিফিকেট করার ডিজিটাল পদ্ধতি
প্রথম ধাপ:
ই-টিন করার জন্য প্রথমে যেতে হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এর ওয়েবসাইটে। এই সাইটের অধীনে নিজের একটি অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য আগে নিবন্ধন করতে হবে। তার জন্য ক্লিক করতে হবে রেজিস্টার বাটনে। এবার একটি নিবন্ধন ফর্ম পাওয়া যাবে, যেখানে মাঝে কোন স্পেস ছাড়াই ইংরেজি ছোট হাতের অক্ষরে একটি আইডি, পাসওয়ার্ড, নিরাপত্তা প্রশ্নোত্তর, দেশ এবং মোবাইল নাম্বার দিতে হবে।
পড়ুন: বয়স্ক ভাতার জন্য আবেদন করার নিয়ম
সবশেষে ক্যাপচা ছবি দেখে ইংরেজি বড় হাতের অক্ষরে ভেরিফিকেশন লেটার লিখার পর রেজিস্টার বাটনে ক্লিক করতে হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফর্মে প্রদানকৃত মোবাইল নাম্বারে একটি যাচাইকরণ কোড আসবে। এই কোডটি নির্ভুলভাবে ফর্মের নির্দিষ্ট স্থানে বসিয়ে সক্রিয় বাটনে চাপ দিতে হবে। আর এর মাধ্যমেই নিবন্ধন প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হবে এবং সেই সাথে প্রার্থীর অ্যাকাউন্টও সক্রিয়ও হয়ে যাবে।
দ্বিতীয় ধাপ:
এখন সেই আইডি ও পাসওয়ার্ড দিয়ে অ্যাকাউন্টে লগইন করতে হবে। তারপর যে ইন্টারফেসটি আসবে তাতে উল্লেখিত এখানে ক্লিক করুন বোতামে ক্লিক করতে হবে। এরপর যে পেজটি আসবে সেখানে
করদাতার অবস্থা, রেজিস্ট্রেশনের ধরন, আয়ের প্রধান উৎস, আয়ের প্রধান উৎসের অবস্থান, প্রার্থীর অবস্থান নির্বাচন করতে হবে। সব তথ্য সঠিক ভাবে প্রদান করে শেষে গো টু নেক্সট বাটনে ক্লিক করতে হবে।
এবার প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য দেয়ার পালা। এখানে এনআইডি অনুসারে প্রার্থীর নাম, লিঙ্গ, এনআইডি কার্ড নাম্বার, জন্ম তারিখ, পিতা-মাতার নাম, স্ত্রীর নাম, মোবাইল নাম্বার, ইমেল এবং বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা প্রতিটি তথ্য নির্ভুল ভাবে প্রদান করতে হবে। এরপর আবার গো টু নেক্সট-এ যেতে হবে।
এখন এতক্ষণ ধরে প্রদানকৃত যাবতীয় তথ্য এনআইডি কার্ডে প্রার্থীর ছবি সহ একবারে দেখানো হবে। সবকিছু ভালো করে যাচাই করে সাবমিট বাটনে ক্লিক করতে হবে। আর এর মাধ্যমে তৈরি হয়ে যাবে ই-টিন সার্টিফিকেট।
পড়ুন: স্মার্ট আইডি কার্ড: জাতীয় পরিচয়পত্রে ভুল থাকলে যেভাবে সংশোধন করবেন
ই-টিন সার্টিফিকেট সংগ্রহ
টিন সার্টিফিকেট দেখুন-এ ক্লিক করে ইলেকট্রনিক টিন সার্টিফিকেটটি দেখা যাবে। এটি এখন বা পরবর্তীতে যে কোন সময় ডাউনলোড করে ফোন বা কম্পিউটারে সংরক্ষণ করা যাবে। এছাড়াও বিভিন্ন কাজে লাগানোর জন্য এটি মুদ্রণ করেও ব্যবহার করা যাবে৷ এমনকি এখান থেকে নিজের বা প্রয়োজনে অন্য কোন ইমেইলেও ই-টিন সনদটি পাঠানো যাবে।
ই-টিন নাম্বার পুনরুদ্ধার করার উপায়
টিন শংসাপত্র হারিয়ে গেলে সাহায্যের জন্য এনবিআর হেল্পলাইন হচ্ছে- ০৯৬১১৭৭৭১১১ বা ৩৩৩। এছাড়া প্রার্থীর জাতীয় পরিচয়পত্রের ১টি অনুলিপি সহ ট্যাক্স অফিসে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওয়েবসাইটে নিবন্ধনকৃত অ্যাকাউন্টের আইডি/ইউজারনেম এবং পাসওয়ার্ড ভুলে গেলে, প্রথমে ইউজার আইডি তারপর পাসওয়ার্ড পুনরুদ্ধার করতে হবে। এর জন্য ই-টিন সার্টিফিকেট করার সাইটে এ আবার যেতে হবে।
পড়ুন: ট্রেড লাইসেন্স করার পদ্ধতি: প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, খরচ ও সময়
সেখানে সরাসরি চলে যেতে হবে ফরগেট পাসওয়ার্ড মেন্যুতে। সেখানে ফরগেট মাই ইউজার নেম বাছাই করে নেক্সট-এ ক্লিক করতে হবে। তারপরের পেজে অ্যাকাউন্ট নিবন্ধনের মুহুর্তে প্রদানকৃত মোবাইল নাম্বারটি দিয়ে ক্যাপচা পূরনের করে নেক্সট-এ ক্লিক করতে হবে। মোবাইল নাম্বার মনে না থাকলে সাম্প্রতিক সময়ে নিজের ব্যবহৃত মোবাইল নাম্বারগুলো দিয়ে চেষ্ঠা করা যেতে পারে।
যে মোবাইল নাম্বারটি টিনের জন্য আগে ব্যবহার করা হয়নি সে নাম্বারের ক্ষেত্রে ইউজার আইডি ইনঅ্যাক্টিভ মেসেজ দেখাবে। কাঙ্ক্ষিত মোবাইল নাম্বারটি পাওয়া গেলে তা প্রদানের পর নিরাপত্তা প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পেজ আসবে। এই অংশটি সাধারণত সবারই মনে থাকে, কারণ নিজের ব্যক্তিগত জীবনের সাথে সম্পর্কিত খুব সহজে মনে থাকে এমন তথ্যই সবাই এখানে দিয়ে রাখে।
প্রশ্নের উত্তর সঠিক দেয়ার পর এবার মোবাইল নাম্বার যাচাই করার জন্য প্রার্থীর মোবাইলে ৪ অঙ্কের একটি যাচাইকরণ কোড যাবে। এই কোডটি লিখে মোবাইল নাম্বারটি পুনরায় টাইপ করে সাবমিটে ক্লিক করতে হবে। এর সাথে সাথেই দেখা যাবে টিন অ্যাকাউন্টের ইউজার আইডিটি।
পড়ুন: মোটর ড্রাইভিং লাইসেন্স করার পদ্ধতি: প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও খরচ
এবার পাসওয়ার্ড বের করার জন্য আবার ফরগেট পাসওয়ার্ড মেন্যুতে যেতে হবে। তারপরের পেজে ফরগেট মাই পাসওয়ার্ড অপশনটি বাছাই করে নেক্সটে যেতে হবে। এবারে সবেমাত্র বের করা ইউজার আইডি দিয়ে ভেরিফিকেশন অক্ষরগুলো লিখে নেক্সটে যাওয়ার সাথে সাথে প্রার্থীর মোবাইলে ৪ অঙ্কের ভেরিফিকেশন কোড যাবে। কোডটি লিখে রিকভার মাই অ্যাকাউন্ট-এ ক্লিক করার পর যে পেজটি আসবে সেখানে কমপক্ষে ৪টি অক্ষর বা সংখ্যা দিয়ে বানিয়ে নেয়া যাবে একটি নতুন পাসওয়ার্ড।
শেষাংশ
অনলাইনে ই-টিন সার্টিফিকেট করার উপায় একদম সহজ এবং ঝামেলামুক্ত, যা ডিজিটাল বাংলাদেশের একটি দারুণ প্রয়াস। টিন গ্রহণকারীদের যে বিষয়টি মনে রাখতে হবে তা হলো- টিন থাকলেই যে আয়কর রিটার্ন দিতে হবে এমনটি নয়। বাংলাদেশে স্থায়ী কোন ভিত্তি নেই এমন অনিবাসি, শুধুমাত্র জমি বিক্রি বা ক্রেডিট কার্ড নেয়ার জন্য টিন নিয়েছেন অথচ করযোগ্য আয় নেই এমন নাগরিকদের টিন থাকা সত্ত্বেও আয়কর রিটার্ন দাখিলের দরকার নেই।
২ বছর আগে