অমর একুশে বই মেলা
একুশে বইমেলার শিকড়ের সন্ধান
বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা সবসময়ই অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখেছে। অমর একুশে বইমেলা বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলা হয়।
এটি দেশের বৃহত্তম বইমেলা, যেখানে প্রকাশকরা বিভিন্ন ধারায় লেখা মুদ্রিত বই প্রদর্শন ও বিক্রি করেন।
এই মেলা পাঠকদের জন্য তাদের প্রিয় লেখক, কবি, ঔপন্যাসিক ও প্রকাশকদের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা করার দুর্দান্ত সুযোগ করে দেয়। পাঠকদের বই পড়তে ও কিনতে উৎসাহিত করার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পরিবেশন করার পাশাপাশি বইমেলা মাসব্যাপী একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করে– যা বাংলাদেশের বৈচিত্র্যকে তুলে ধরে।
অমর একুশে বইমেলার ইতিহাসের শিকড় অনুসন্ধান করা যাক-
চিত্তরঞ্জন সাহা
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি মাঠ থেকে বইমেলা শুরু হয়। চিত্তরঞ্জন সাহা ১৯২৭ সালে নোয়াখালী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকার বাংলাবাজারে অবস্থিত তার প্রকাশনা সংস্থা পুঁথিঘর প্রকাশনী ১৯৭১ সালে পুড়িয়ে দেয়া হয়। চিত্তরঞ্জন সাহা ২৬ মার্চের পর ঢাকা ছেড়ে যান। তিনি আগরতলায় আশ্রয় নেন এবং তারপরে মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় চলে আসেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের অনেক বিশিষ্ট লেখক, শিল্পী, সাংবাদিককে শরণার্থী হিসেবে কলকাতায় থাকতে হয়েছিল।
সেই সময়কালে চিত্তরঞ্জন কলকাতায় বসবাসরত কয়েকজন বিশিষ্ট সাহিত্যিকের সঙ্গে একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করেন। তারা বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ওপর হওয়া অন্যায় ও যুদ্ধ নিয়ে লেখার ও তা প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেন। এভাবেই মুক্তধারার জন্ম হয়।
১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমি ভবনের সামনে গাছের নিচে একটি মাদুর বিছিয়ে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে প্রায় ৩২টি (কিছু সূত্র অনুসারে ৩৩টি) বই প্রদর্শন করেন।
যদিও চিত্তরঞ্জন সাহা প্রথমদিককার উদ্যোক্তা হিসেবে বইমেলার সূচনা করেছিলেন, তবে কিছু সূত্র অনুসারে তিনিই প্রথম ব্যক্তি নন যিনি ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বই বিক্রি শুরু করেছিলেন। স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সের রুহুল আমিন নিজামী রাশিয়ান বই প্রদর্শন শুরু করেন। এই বইগুলো তাদের সমৃদ্ধ বিষয়বস্তু এবং সাশ্রয়ী মূল্যের জন্য সেসময়ে খুব জনপ্রিয় ছিল।
আরও পড়ুন: দুই বছর পর ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন শুরু হচ্ছে বইমেলা
বাংলাদেশে প্রথম বইমেলার পেছনের ইতিহাস
চিত্তরঞ্জন সাহা একুশের বইমেলার প্রবর্তক হিসেবে স্বীকৃত হলেও বইমেলার শিকড় আরও গভীরে প্রোথিত।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬৫ সালে।
উদ্যোগটি নিয়েছিলেন সরদার জয়েনউদ্দীন। তিনি ১৯১৮ সালে পাবনায় জন্মগ্রহণ করেন।১৯৬৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) গ্রন্থাগারের নিচতলায় কিছু শিশুতোষ বই প্রদর্শন শুরু করেন। তখন তিনি শিশুদের বই নিয়ে ইউনেস্কোর একটি প্রকল্পে কাজ করছিলেন।
১৯৭০ সালে জয়েনউদ্দীন নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জে একটি বইমেলার আয়োজন করেন।
ইউনেস্কো ১৯৭২ সালকে ‘আন্তর্জাতিক বই বর্ষ’ ঘোষণা করায়, ডিসেম্বরে জয়েনউদ্দীন বাংলা একাডেমিতে বইমেলার আয়োজনের উদ্যোগ নেন। এরপর থেকে বাংলা একাডেমি বইমেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়।
একুশে বইমেলার যাত্রা
চিত্তরঞ্জন সাহা আরও কয়েক বছর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বই প্রদর্শন ও বিক্রি চালিয়ে যান। ১৯৭৬ সালে বই বিক্রির এই ধারণা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অন্যান্য প্রকাশকরা একত্র হন এবং এতে যোগ দেন। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমি এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয়।
আশরাফ সিদ্দিকী সে সময় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন এবং বইমেলার সঙ্গে একাডেমির যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল। এরপর ধীরে ধীরে বাংলা একাডেমির আয়োজক সমিতি বইমেলাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে।
১৯৭৯ সালে বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে ‘বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি’ (চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত) এবং বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় একটি বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়।
আরও পড়ুন: এবার একুশে বইমেলায় সাড়ে ৫২ কোটি টাকার বই বিক্রি
১ বছর আগে