গায়ক ও অভিনেতা
হিরো আলমের যুদ্ধ চলবেই
হিরো আলম একজন বাজে গায়ক এবং ততোধিক খারাপ অভিনেতা। তিনি তার নিতান্ত ‘অনাকর্ষণীয়’ রূপ নিয়েই সমাজের প্রতিষ্ঠিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে শুরু করেছেন। তার আগেও অল্পকিছু মানুষ এমনটি করার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন।
সমাজের প্রতিষ্ঠিত মানুষেরা তাকে ‘অসৎ, সংস্কৃতি জ্ঞানহীন, নিচু শ্রেণির ও অশিক্ষিত’-বলে সম্বোধন করলেও, তার ভক্তরা এসব বিষয়কে খুব একটা পাত্তা দেয় বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশের শহুরে অভিজাত সুশীল শ্রেণির অনেকেই আলমকে ‘অচ্ছুৎ’ বলে মনে করেন। তার ব্যক্তিত্ব ও কর্মকাণ্ড সবকিছুরই অপব্যাখা করেন তারা। কিন্তু এরপরেও কোনোভাবেই তারা আলমকে আটকাতে পারছে না, এটাই তাদের মূল সমস্যা।
তারা সবচেয়ে খুশি হয়েছিল যখন পুলিশ হিরো আলমকে গ্রেপ্তার করে এবং সেসব গান গাইতে নিষেধ করে; বিশেষত যেগুলো রবীন্দ্র অনুরাগী সুশীলদের ‘সংবেদনশীলতায়’ আঘাত করে।
সেসময় বেশ কয়েকজন শীর্ষ স্থানীয় সুশীল ও কণ্ঠশিল্পী পুলিশের কাছে হিরো আলমের গান গাওয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন।
পরবর্তীতে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রণীত সংগীত আইন মেনে চলার প্রতিশ্রুতিতে তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল।
তবে বলতেই হয় আলম একজন ভাগ্যবান মানুষ, তাই র্যাব তাকে তুলে নিয়ে যায়নি। ভাগ্যিস, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ছিল!
আরও পড়ুন: এবার জরিমানার ফাঁদে হিরো আলম!
গলার কাঁটা
গ্রেপ্তারের বিষয়টি তার জন্য সাপে বর হয়ে যায় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হিরো আলম আরও বেশি আলোচিত হয়ে ওঠেন। এমনকি সেসময় হিরো আলম নিজেও সামাজিক মাধ্যমের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে নিজের অবস্থান ও বিভিন্ন অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছিলেন।
সরকারের পক্ষ থেকে পুলিশকে এ বিষয়ে জড়ানোর কথা বলাটা আসলেই হাস্যকর ছিল।
কারণ, বাজে গান যদি আইন-শৃঙ্খলার জন্য সমস্যা হয়; তবে দেশের অনেক রাজনৈতিক নেতার বক্তব্য ও হাস্যরসাত্মক মন্তব্যের জন্য পুলিশকে প্রতিদিন কয়েক ঘন্টা নষ্ট করতে হবে।
দুঃখজনকভাবে, সুশীলদের জন্য এরপর আরও বড় ধামাকা অপেক্ষা করছিল।
গান গাওয়ার ব্যাপারটা ওখানেই শেষ হলেও, এরপরই শোনা যায় এবার হিরো আলম সংসদ উপনির্বাচনে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন।
অনেক ব্যঙ্গবিদ্রুপের পরে নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর দেখা যায়, হিরো আলমকে মাত্র ১ হাজারেরও কম ভোটে হারানো হয়েছে।
দুঃখজনকভাবে বিজয়ী জাসদের প্রার্থী তানসেন জাতীয় পর্যায়ে পরিচিত মুখ না হওয়ায়, তার জয়ের চেয়ে হিরো আলমের পরাজয়ই বড় খবর হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন: মাইক্রোবাস উপহার নিতে হিরো আলম যাচ্ছেন হবিগঞ্জ
তানসেন যেহেতু আ.লীগ সমর্থিত প্রার্থী ছিলেন, অতীতের নির্বাচনী অভিজ্ঞতার আলোকে স্বভাবতই জনগণ মনে করছে হিরো আলমকে সংসদে যেতে না দেয়ার জন্যই জোর করে তাকে হারানো হয়েছে।
ইসি অবশ্য নির্বাচনে কারচুপির কথা অস্বীকার করেন এবং এ বিষয়ে হিরো আলমের তোলা অভিযোগ প্রত্যাখান করেন।
তবে সংশ্লিষ্ট সবার মাথাব্যাথা আরও বেড়ে যায় তখন, যখন মানুষ ইসির কথা না বিশ্বাস করে হিরো আলমের কথাই বিশ্বাস করে।
তবে এখন মনে হচ্ছে এই মানুষটিকে (হিরো আলম) ঘিরে অনেক কিছু চলছে এবং গান গাওয়া ও ভোট দেয়ার বাইরেও তার আরও অনেক বড় বড় ‘শত্রু’ হয়ে গেছে।
আলো ঝলমলে ঢাকা থেকে অনেক দূরের কোনও এক গ্রামীণ পশ্চাৎপদ পরিবেশ থেকে উঠে আসা ‘একগুঁয়ে' মানুষটির একটি অনিশ্চিত পেশা, কিছু নোংরা প্রেমের সম্পর্ক এবং জনগণের মনোযোগ আকর্ষণের দক্ষতা; সমাজের প্রতিষ্ঠিত মানুষদেরকে বিভ্রান্ত ও হতবুদ্ধি করে তুলেছে।
শুধু তাই নয়, একজন তাকে একটি মাইক্রোবাস উপহার দিল এবং কেউ যা করে না আলম তাই করলো; সেটি দান করে দিলেন। আর এ বিষয়টি এতটাই আলোচিত হয়ে উঠল, যে সংসদেও এসব নিয়ে আলোচনা উঠল।
সুশীলদের ওপর ফের আঘাত
ইউএনবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায় যাওয়ার পথে হিরো আলমকে ২৫০০ টাকা জরিমানা করে হাইওয়ে পুলিশ। ওই উপজেলার নরপতি গ্রামের আব্দুল জব্বার গাউছিয়া একাডেমির প্রিন্সিপাল এম মখলিছুর রহমানের কাছ থেকে উপহারের মাইক্রোবাস আনতে গিয়েছিলেন তিনি।
কারণ মখলিছুর সম্প্রতি ফেসবুক লাইভে ওয়াদা করেছিলেন যে বগুড়া দুই আসনে উপনির্বাচনে জিতলে বা হারলে হিরো আলমকে তিনি গাড়ি উপহার দেবেন। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে হিরো আলম গাড়িটি গ্রহণ করেন এবং তারপর লাশ বহনের অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে ব্যবহার করার জন্য এটি দান করেন।
আরও পড়ুন: যারা হিরোকে জিরো বানাতে চায় তারাই জিরো হয়ে গেছে: হিরো আলম
আলমকে জরিমানা করা পুলিশের এই পদক্ষেপটিতে কি কিছুটা প্রতিহিংসার গন্ধ ছিল! যে দেশে মন্ত্রীরা ঢাকার ব্যস্ত সড়কে জাতীয় পতাকা লাগানো তাদের সরকারি গাড়ি নিয়ে রংসাইড দিয়ে যাওয়া দোষের কিছু মনে করেন না, মোটরসাইকেলগুলো ফুটপাতকে সাব-রোড হিসেবে ব্যবহার করে, ফুটপাতে পার্ক করা গাড়ির জ্বালায় জনগণের হাঁটা দুষ্কর এবং এমনকি ‘ট্রাফিক নিয়ম লঙ্ঘন’- বলে যে কিছু আছে, অনেকে তা জানেই না। সেখানে আলমকে নিয়ে সরকারি বাহিনীর এত উদ্বেগ কিসের?
নিম্নশ্রেণির উত্থান
হিরো আলম ব্যক্তিগতভাবে ও সাংস্কৃতিকভাবে নিম্নশ্রেণির মানুষের উত্থানের প্রতিনিধিত্ব করছেন। শিল্পের মানদণ্ড কি তা নির্ধারণ করে রেখে সুশীলরা এতদিন যে একচেটিয়া সুবিধা ভোগ করছে, প্রথমেই তা হুমকির মুখে পড়েছিল গ্রামীণ ধর্মীয় সংস্কৃতির উত্থানের ফলে।
রাজনীতি ছাড়াও, হেফাজতের ঢাকা অবরোধের মধ্যদিয়ে দেখা যায় যে, জেগে উঠলে মুহূর্তে তারা ব্যক্তিগত ও সামাজিক যে কোনও বাধা অতিক্রম করতে পারে।
‘আধুনিক ও ধর্মনিরপেক্ষ’ সুশীল সংস্কৃতির জন্য ওয়াজ মাহফিল বা হেফাজত ও তাবলিগ সংস্কৃতিকে প্রত্যাখান করা সহজ, কারণ তারা একটি রাজনৈতিক ও বিশেষ গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে।
কিন্তু এখানেই হিরো আলম তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলছে।
সারা বাংলাদেশের শহুরে অভিজাত বা সুশীলদের চর্চিত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড আর হিরো আলমের কর্মকাণ্ড তো একই।
হিরো আলম হয়তো ভালোভাবে কাজগুলো করতে পারে না, তবে অভিজাত বা সুশীলরা তাদের কমন স্পেসে যা করে সেও ঠিক তাই করে ।
আলম তাদেরই মতো গান করেন, তাদের মতো বিভিন্ন নায়ক ও আইকনদের নকল করেন এবং এমনকি তাদের অনেকের মতো নারীও সাজেন।
কেউ তাকে অপছন্দ করতেই পারে, যেমনটি অধিকাংশ সুশীলই তা করেন। তবে কেউ তার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে বন্ধ করতে পারে না, কারণ সুশীল অভিজাতরাও ঠিক এ কাজগুলোই করে।
হিরো আলম ও তার সমগোত্রীয়রা ক্রমে উঠে আসছে এবং শিগগিরই সুশীলদের একচেটিয়া দখলদারিত্বের ভিত্তি নড়িয়ে দিতে পারে তারা। মূলত এ ভয়েই তারা এত উদ্বিগ্ন।
কিন্তু ইতিহাস বলে, এ শ্রেণির মানুষেরা আজীবনই অপ্রতিরোধ্য। নিম্নশ্রেণির মানুষেরাই হয়তো একদিন শখের গায়ক ও তথাকথিত সৌন্দর্য্য সর্বস্ব শ্রেণির মানুষের ওপর আধিপত্য বিস্তার করবে।
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
আরও পড়ুন: হিরো আলমকে তাচ্ছিল্য করে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের বক্তব্য শিষ্ঠাচার বহির্ভূত ও বৈষম্যমূলক: টিআইবি
১ বছর আগে