বহুতল ভবন নির্মাণ
বিল্ডিং কোড অমান্য করে বহুতল ভবন নির্মাণ, অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম না থাকায় বাড়ছে উদ্বেগ
ইলিশের বাড়ি নামে প্রসিদ্ধ চাঁদপুর। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশ এগিয়ে আছে এই শহর। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নত হতে থাকলেও শহরে ঘটছে রেকর্ডসংখ্যক অগ্নিদুর্ঘটনা। পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম না থাকায় ক্ষতির পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে কয়েক গুণ।
গত জানুয়ারি থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত সাড়ে নয় মাসে ৩২১টিরও বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে চাঁদপুরে। প্রায় প্রতি মাসেই গড়ে ২৪-৪৫টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে।
এসব ঘটনায় নিহত না হলেও আহতাবস্থায় জীবনযাপন করছেন অনেকে। পুড়ে ছাই হয়েছে কোটি টাকার সম্পদ। নিঃস্ব হয়েছেন হাজারো মানুষ।
এ সময়ে সড়ক দুর্ঘটনা, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট ও অন্যান্য দুর্ঘটনা ঘটেছে ৮৪টি। এতে মারা গেছে ৩৯ জন, আহত হয়েছেন শতাধিক।
চাঁদপুর জেলা শহরে ৩টিসহ জেলায় ১০টি ফায়ার স্টেশন রয়েছে। নৌপথের যানবাহনে অগ্নিকাণ্ড ও নৌদুর্ঘটনা রোধে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চাঁদপুর নৌ ফায়ার স্টেশনও।
১০টি ফায়ার সার্ভিস থাকলেও একটিতেও নেই প্রয়োজনীয় অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম।
কয়েক দশক ধরে চাঁদপুর জেলা সদরসহ উপজেলার ফায়ার স্টেশনগুলো কোনোটাতেই ৫ তলার উপরে যাওয়ার মতো কোনো মই নেই।
কয়েক মাস আগেও হাজীগঞ্জে একটি বহুতল ভবনে আগুন লাগলে সংকটময় পরিস্থিতিতে পড়েন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
চাঁদপুর শহরের একটি বহুতল ভবনের বাসিন্দারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, আগুন লাগলে কী অবস্থা হবে, কীভাবে উদ্ধার পাব তা নিয়ে আমরা শঙ্কিত। ধোঁয়ায় সব অন্ধকার হয়ে যায়। এ অবস্থায় তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি দিয়ে নামাও যায় না। আবার ছাদেও যাওয়া যায় না কারণ বেশির ভাগ ভবনেরই ছাদের গেটে থাকে তালা দেওয়া থাকে।
এসব আকাশছোঁয়া ভবনে অগ্নিদুর্ঘটনায় বিপদে পড়েন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
আরও পড়ুন: অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে নারায়ণগঞ্জের বাণিজ্যিক কেন্দ্র নয়ামাটি
চাঁদপুর পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী এম শামসুদ্দোহা বলেন, ‘আমাদের পৌরসভায় সাত তলার উপরে ভবন নির্মাণের কোনো অনুমতি নেই। তবুও অনেকে নিয়ম ভঙ্গ করে ৮-৯-১০ তলা ভবন নির্মাণ করেছেন বা করছেন- যা আইনের লঙ্ঘন। আমরা শিগগিরই এ ব্যাপারে অ্যাকশনে যাব।’
অগ্নিনির্বাপণের সরঞ্জাম সংকটের পাশাপাশি তীব্র হয়ে উঠেছে পানির সংকট। জেলা শহরের শতাধিক বড়-মাঝারি পুকুর, দীঘি, ডোবা, দীঘি-নালা ও জলাভূমি ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে বহুতল ভবন। যে কারণে কোথাও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে কাছাকাছি পানির উৎস খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
জেলা শহরের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত প্রাচীনতম শহরের বর্জ্য অপসারণের লাইফলাইন হিসেবে পরিচিত প্রায় ৩ কিলোমিটারব্যাপী এস বি খাল। শহরের শতশত বাসাবাড়ি, দোকানপাট, ক্লিনিকের বর্জ্য এই খাল দিয়ে ডাকাতিয়া নদীতে যায়। একসময় অগ্নিদুর্ঘটনায় পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে এই জলাধারটি বেশ উপকারে আসত। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে সংস্কারের অভাবে এ খালটিও এখন মৃতপ্রায়। ময়লা-আর্বজনা ও দখলের রাজত্বে সংকীর্ণ হয়ে আসছে খালটি। প্রায় ৫০-৬০ বছর আগেও এ খাল দিয়ে পণ্যবাহী নৌকা চলত। আর এখন এই খাল থেকে পানি নেওয়ার মতোও অবস্থা নেই।
এভাবে দখল ও ভরাট চলতে থাকলে আর কয়েক বছর পর জেলা শহরে কোনো জলাধারই থাকবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন শহরের অন্যতম প্রবীণ প্রকৌশলী আব্দুর রব, অধ্যাপক মাছুম বিল্লাহ, পরিবেশবাদী মাসুদ আলমও সমাজসচেতন ব্যক্তিরা।
চাঁদপুর সিভিল ডিফেন্স ও ফায়ার স্টেশনের সহকারী উপপরিচালক মোরশেদ হোসেন ইউএনবিকে বলেন, ‘জেলার ১০টি ফায়ার স্টেশনে ১৪০ জন ফায়ার ফাইটার কর্মরত আছেন। আছে লজিস্টিক সাপোর্টও। তবে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয় উঁচু মইয়ের অভাবে। বড় বড় ভবনে আগুন লাগলে ৫ তলার উপরে উঠা যায় না। আগুন নেভাতে ও উদ্ধার কাজে বিঘ্ন ঘটে।’
সংকটময় পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কুমিল্লা ফায়ার স্টেশনের সহযোগিতা নিতে হয় বলে জানান এই উপপরিচালক।
আরও পড়ুন: জাহাজে অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে: নৌপরিবহন উপদেষ্টা
১ মাস আগে
অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত ছাড়াই চলছে বহুতল ভবন নির্মাণ
ঢাকাসহ সারা দেশের সব নগর কেন্দ্রে অগ্নি নিরাপত্তা পরিকল্পনা উপেক্ষা এবং বিল্ডিং কোড না মেনে ১০ থেকে ১২ তলা পর্যন্ত উঁচু ভবন নির্মাণ করায় অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে।
এছাড়া সংকীর্ণ রাস্তার ঠিক পাশে উঁচু ভবন নির্মাণ আগুনের ঝুঁকি বাড়ায়।
জরুরি পরিস্থিতিতে ভারী যন্ত্রপাতিসহ ফায়ার সার্ভিসের যানবাহনের যাতায়াত বা প্রবেশকে সীমাবদ্ধ করার ফলে আরও বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটে এবং ধ্বংস হয়।
আরও পড়ুন: ভবন নির্মাতা ও ব্যবহারকারীদের অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে: প্রধানমন্ত্রী
এ বিষয়ে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান ইউএনবিকে বলেন, ঢাকাসহ সারাদেশে বহুতল ভবনের নির্মাণের ক্ষেত্রেও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা এবং অগ্নি নিরাপত্তা সংক্রান্ত আইন সমূহকে অবজ্ঞা করে বহুতল ভবনের নির্মাণ ও ব্যবহার চলছে।
এছাড়া এ সকল ভবনে অগ্নিসহ বিভিন্ন দুর্যোগে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে ঢাকাসহ সারা দেশের নগর এলাকায় ব্যবসায়ীক লাভকে বাড়ানোর অসদুদ্দেশ্য বিকল্প সিড়ি ও নির্গমন পথ, ফায়ার লিফট, ফায়ার ডোর, ফায়ার ডিটেক্টর, ফায়ার স্প্রিংক্লার, ফায়ার সাপ্রেশন সিস্টেম প্রভৃতি অগ্নি নির্বাপণ সিস্টেমের যথাযথ ব্যবস্থা না করেই বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে।
পরবর্তীতে কোন ধরনের অকুপেন্সি সনদ ছাড়াই এই ভবনগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সারা দেশের ভবন নির্মানে যথাযথ মানদণ্ড ও অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড এর প্রস্তাবনা অনুযায়ী বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি অনতিবিলম্বে গঠন করে তার কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
এছাড়া মানুষের জীবনকে প্রাধান্য দিয়ে বহুতল ভবনসহ নগরে অগ্নি ও দুর্যোগজনিত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ডেভেলপার ও ভবন মালিকদের দায়বদ্ধতায় নিয়ে আসবার পাশাপাশি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ সকল নগর সংস্থাসমুহকে জবাবদিহিতায় আনা প্রয়োজন।
এর পাশাপাশি বহুতল ভবনের সংজ্ঞায়নে অগ্নি নিরাপত্তা সংক্রান্ত ফায়ার সার্ভিসের আইনকে প্রাধান্য দিয়ে ইমারত ও নির্মাণ সংক্রান্ত বিধিমালাসমূহের প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা দরকার।
আদিল বলেন, পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডের বর্ষপূর্তির সময়ই গুলশান এলাকার বহুতল আবাসিক ভবনের ভয়ংকর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আমাদের নগর এলাকায় অগ্নিদুর্যোগে প্রাণহানি ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কার বিপরীতে আমাদের ভবনসমূহের অভ্যন্তরীণ অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থার সীমাহীন দুর্বলতা ও নগর সংস্থাসমুহের সার্বিক পরিকল্পনা, প্রস্তুতি, নজরদারি ও আইনের প্রয়োগের দুর্বলতার বিষয়টি গুরত্ব সহকারে দেখতে হবে।
তিনি বলেন, রাজধানীর বনানীতে এফআর টাওয়ার অগ্নিকাণ্ডের পর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সরেজমিন তদন্তের পরে বহুতল ভবনে অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ভবন মালিক ও ডেভেলপারদের যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল সেগুলোর বাস্তবায়ন সঠিকভাবে করা হয়েছিল কিনা সেটাও নিশ্চিত করা যায়নি।
আরও পড়ুন: উঁচু ভবনে অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন: প্রধানমন্ত্রী
তিনি আরও বলেন, ঢাকাসহ সারাদেশের নগর এলাকাতেই অত্যন্ত সরু রাস্তার পাশেই ১০ থেকে ১২ তলা বা ততোধিক উচ্চতার বহুতল ভবন নির্মাণ মানদণ্ড বা অগ্নি নিরাপত্তা ব্যতিরেকেই গড়ে উঠছে। এমনকি সম্প্রতি ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা প্রণয়ন এর সময়েও ছোট রাস্তার পাশে, যেখানে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ী প্রবেশে অক্ষম, সেসব রাস্তায় বহুতল ভবনের নির্মাণ অনুমোদনের দাবীতে অনেক গোষ্ঠী ও মহলকে সরকারের ওপর প্রবল চাপ তৈরি করতে দেখা গেছে। এমনকি ফায়ার সংক্রান্ত দেশের বিদ্যমান আইনে সাততলা ভবনকে বহুতল ভবন হিসাবে বিবেচনা করা হলেও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ২০০৮ এবং বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড, ২০২০ -এ ১০ তলা ভবনকে বহুতল হিসেবে বিবেচনা করবার ফলে সাততলার ওপর অনেক ভবনেই অগ্নি নিরাপত্তা ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
তুরস্ক-সিরিয়ার সাম্প্রতিক ভয়াবহ ভূমিকম্প দুর্যোগে ব্যাপক প্রাণহানির কারণে আমাদের নগরসমূহের ভূমিকম্পসহ সার্বিক দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুতির ব্যাপক ঘাটতির বিষয়গুলো সাম্প্রতিক সময়ে জোরালোভাবে আলোচিত হচ্ছে।
অগ্নিকাণ্ড সহ অতীতের নগর দুর্যোগের ফলে গঠিত তদন্ত কমিটির সমূহের সুপারিশ সমূহ আমরা কেন বাস্তবায়ন করতে পারিনি, সেই বিশ্লেষণ অত্যন্ত গুরুত্ববহ।
এছাড়া নগরে মানুষের জীবনের নিরাপত্তাকে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দেয়ার নীতিমালা থাকলেও অদৃশ্য কারণে সেই প্রস্তাবনাসমূহের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না বলে আমি মনে করি।
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন ইউএনবিকে বলেন, ভবন নির্মাণ করতে সবাই চাই কিন্তু নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কেউ টাকা খরচ করতে চায় না। নিরাপত্তায় বিনিয়োগ করতে হবে। আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ফায়ার সেফটি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। শিশু বয়স থেকে ফায়ার সেফটির বিষয়ে সচেতনতা তৈরির বিনিয়োগ করতে হবে।
এছাড়া কারিকুলামে এ বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে। ফায়ার সেফটির বিষয়ে প্রশিক্ষণাগার তৈরি করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, প্রতিটি ভবন নির্মাণের সময় গৃহীত ফায়ার সেফটি প্ল্যানের শর্ত বাস্তবায়ন করা। ভবনের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট প্রদানের আগে অগ্নিনিরাপত্তা শর্ত মানা হয়েছে কি না, এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের মতামত গ্রহণ এবং শহরজুড়ে হাইড্রেন্ট ব্যবস্থা স্থাপন নিশ্চিত করতে হবে।
আরও পড়ুন: সিউলে অগ্নিকাণ্ডে ৬০টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত
এছাড়া ফায়ার সেফটি নিশ্চিত করে ভবন নির্মাণ করলে ঝুঁকি কম থাকবে।
রাজউক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা ইউএনবিকে বলেন, ফায়ার সেফটি ছাড়া কোনো ভবন নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয় না। রাজউক থেকে ভবন নির্মাণের অনুমতি নিয়েও অনেকে বিল্ডিং বিধিমালা মানছে না ফলে অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এ বিষয়ে আমরা রাজউক থেকে অভিযান অব্যাহত রেখেছি। আমাদের মনিটরিং ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হবে।
এছাড়া রাজউক থেকে অনুমোদনের পর এখন থেকে যে ভবনগুলো হবে সেগুলোতে ফায়ার সেফটি নিশ্চিত করতে হবে।
১ বছর আগে