মরিয়ম আওরঙ্গজেব
ইমরান খানকে মুক্তির নির্দেশ পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের
পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট বৃহস্পতিবার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আদালত জানিয়েছেন, খানকে গ্রেপ্তারের পর থেকে গত দুই দিনে দেশজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। তাই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি উমর আতা বন্দিয়াল ইমরান খানকে তার সমর্থকদের শান্তিপূর্ণ থাকার আহ্বান জানাতে বলেছেন।
এদিন তার মুক্তি উদযাপন করতে আদালত ভবনের কাছে খানের সমর্থকদের নাচতে দেখা গেছে।
আইন প্রণেতাদের অনাস্থা ভোটে ক্ষমতা থেকে অপসারিত হওয়ার পর, খান পাকিস্তানি আদালতে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগের সম্মুখীন হন।
পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে হেফাজতে নেওয়ার পর থেকেই সহিংসতা শুরু হয়। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে তার সমর্থকদের সংঘর্ষে বহু মানুষ আহত হয় এবং রাতারাতি অভিযানে কয়েকশ’ মানুষকে আটক করা হয়।
সামরিক দখল, রাজনৈতিক সঙ্কট ও সহিংসতায় অভ্যস্ত এই জাতির জন্য এই ধরনের সহিংসতার ঘটনা নজিরবিহীন। এটি রাওয়ালপিন্ডির গ্যারিসন সিটিতে একটি নির্বাচনী সমাবেশে ২০০৭ সালে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোকে হত্যার পরে সৃষ্ট পরিস্থিতির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। সে সময় তার সমর্থকরা, তার হত্যাকাণ্ডে বিক্ষুব্ধ হয়ে সারা পাকিস্তানে কয়েকদিন ধরে তাণ্ডব চালিয়েছিল।
মঙ্গলবার খানের নাটকীয় গ্রেপ্তারের পর থেকে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে তার অন্তত ১০ জন সমর্থক নিহত এবং কয়েক ডজন আহত হয়েছে। পাশাপাশি ২০০ জনেরও বেশি পুলিশ আহত হয়েছে।
আরও পড়ুন: ইমরান খান গ্রেপ্তার: বিক্ষোভকারী-পুলিশ সংঘর্ষে নিহত ১০
বুধবার রাতে রাজধানী ইসলামাবাদের উপকণ্ঠে একটি রেলস্টেশন পুড়িয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। বৃহস্পতিবার, তারা পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর লাহোরের আশেপাশের এলাকায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, একটি পুলিশের গাড়িতে আগুন দেয় এবং একটি ট্রেন অবরোধ করে।
পুলিশ বৃহস্পতিবার বলেছে যে ইমরান খানের প্রায় এক হাজার ৬০০ সমর্থককে সারাদেশে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি এবং সামরিক স্থাপনায় হামলার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ফলে মঙ্গলবার থেকে আটককৃতদের সংখ্যা বেড়ে দুই হাজার ৩০০ জনে পৌঁছেছে।
বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় ট্রাক, গাড়ি ও পুলিশের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে এবং মহাসড়ক অবরোধ করে সরকারি ও সামরিক ভবনে হামলার পর তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
খানের গ্রেপ্তারের কয়েক ঘন্টা পরে মঙ্গলবার লাহোরে একজন শীর্ষ সেনা কমান্ডারের বাসভবনে উত্তেজিত জনতা আগুন ধরিয়ে দেয়।
সার্বিক দিক বিবেচনায় দেশটির সরকার সহিংস এলাকাগুলোতে বুধবার থেকে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে।
খানকে ইসলামাবাদের একটি আদালত কক্ষ থেকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে তিনি মঙ্গলবার দুর্নীতির অভিযোগের মুখোমুখি হন।
তাকে এখন ইসলামাবাদের একটি পুলিশ কম্পাউন্ডে রাখা হয়েছে। যেখানে একটি অস্থায়ী আদালতে বুধবার একজন বিচারক ৭০ বছর বয়সী খানকে কমপক্ষে আরও আট দিনের জন্য আটক রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
খানের আইনজীবীর কাছ থেকে একটি আবেদনের সংক্ষিপ্ত শুনানির পর, বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট খানকে যেভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে এবং কর্তৃপক্ষকে তাকে এক ঘন্টার মধ্যে হাজির করার নির্দেশ দিয়েছে। এতে ধারণা করা হয় এবার খানকে মুক্তি দেওয়া হবে।
খানের গ্রেপ্তারকে বেআইনি বলে যুক্তি দিয়ে তার আইনজীবীরা তার মুক্তি চেয়েছিলেন।
পুলিশ বৃহস্পতিবার খানকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে নিয়ে গেলে, সরকার তাকে হেফাজতে রাখার দাবি জানায়।
শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ্য করে তথ্যমন্ত্রী মরিয়ম আওরঙ্গজেব এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আপনারা যদি তাকে কোনো ছাড় দেন তাহলে এটা অন্যায় হবে।’
তিনি খানের অনুসারীদের করা সহিংসতার দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে মুক্তি দিলে আদালত ‘সবাইকে হত্যা করার লাইসেন্স’ দেবে।
অন্যদিকে বৃহস্পতিবার পুলিশ জনতাকে সহিংসতায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে খান এবং তার পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে নতুন করে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ দায়ের করেছে।
আরও পড়ুন: পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পর অস্থিরতা থামাতে সেনা মোতায়েন
বুধবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ বলেন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর অনুসারীদের অস্থিরতা ‘সংবেদনশীল সরকারি ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির ক্ষতি করেছে।’
মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর শরীফ বলেন, ‘এ ধরনের দৃশ্য পাকিস্তানের জনগণ কখনো দেখেনি। এমনকি রোগীদের অ্যাম্বুলেন্স থেকে বের করে এনে অ্যাম্বুলেন্সে আগুন দেওয়া হয়েছে।’
শরীফ হামলাকে ‘শাস্তিযোগ্য’ বলে অভিহিত করেছেন এবং সতর্ক করেছেন যে সহিংসতায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, খানকে দুর্নীতিতে জড়িত থাকার কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং এই অভিযোগগুলোর স্বপক্ষে প্রমাণ রয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি বৃহস্পতিবার খানের অনুসারীদের সহিংসতা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
তবে তিনি বলেছেন, তাদের (খানের সমর্থকদের) শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করার অধিকার আছে।
তিনি আরও বলেন, ‘যা হয়েছে, হয়েছে। নিজের জন্য বিষয়গুলোকে আরও কঠিন করবেন না।’
সহিংসতার পরে সরকার পাঞ্জাব এবং উত্তর-পশ্চিম খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়। কেননা সেখানে খানের ব্যাপক সমর্থক রয়েছে এবং সেখানেই বেশিরভাগ সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে।
এ পর্যন্ত অন্তত সাতজন বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে খাইবার পাখতুনখোয়ায় এবং দুইজন পাঞ্জাবের রাজধানী লাহোরে এবং একজন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর কোয়েটায়।
সরকার দেশের বিভিন্ন স্থানে ইন্টারনেট পরিষেবা স্থগিত করেছে।
পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী মহসন নকভি বলেছেন, ‘যারা আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত করেছে আমরা তাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করব।’
কর্মকর্তারা বলছেন যে খানের সমর্থকরা বিশেষ করে সামরিক স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করেছে, কারণ তিনি তার ২০২২ সালের ক্ষমতাচ্যুতির জন্য সামরিক বাহিনীকে দোষারোপ করেছেন।
আরও পড়ুন: ৮ দিনের রিমান্ডে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান
পাশাপাশি খান দাবি করেছেন যে এটি ওয়াশিংটন এবং শরীফের সরকারের একটি ষড়যন্ত্র ছিল।
তবে এ অভিযোগগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং শরীফ উভয়ই অস্বীকার করেছেন।
সামরিক বাহিনীও বলেছে যে তারা খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা পালন করেনি।
সহিংসতার মধ্যে খানের সমর্থকরা রাওয়ালপিন্ডিতে সামরিক সদর দপ্তর এবং উত্তর-পশ্চিমে নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা চালিয়েছে, আফগানিস্তানের সীমান্তে নিরাপত্তা চাকদারা দুর্গে আগুন দিয়েছে।
মঙ্গলবার রাতে লাহোরে, বিক্ষোভকারীরা আঞ্চলিক কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল সালমান ফাইয়াজ গনির বাসভবন ভাঙচুর করে ও পুড়িয়ে দেয়।
বুধবার সেনাবাহিনী পূর্ণ শক্তি দিয়ে বিক্ষোভকারীদের আক্রমণের জবাব দেওয়ার অঙ্গীকার করে।
তারা বলেছে, তাদের স্থাপনাগুলোতে আক্রমণগুলো একটি সাজানো পরিকল্পনা অনুসারে করা হয়েছে এবং এই সহিংসতা দেশের ইতিহাসে একটি ‘কালো অধ্যায়’।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে দেশটি স্বাধীনতা লাভের পর থেকে সামরিক বাহিনী ৭৫ বছরের অর্ধেকেরও বেশি সময় ধরে সরাসরি পাকিস্তান শাসন করেছে এবং বেসামরিক সরকারগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করে রাখে।
১ বছর আগে