৩৫০ কোটি টাকা
এবি ব্যাংকে ৩৫০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদনে অনিয়ম, অনুসন্ধানের নির্দেশ হাইকোর্টের
এবি ব্যাংকের বিরুদ্ধে ওঠা নামসর্বস্ব কোম্পানির নামে ৩৫০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদনের অভিযোগ অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া তিন মাসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দিতে বলেছেন আদালত।
বুধবার (২৪ মে) একটি জাতীয় দৈনিকে ‘খেলাপির তথ্য লুকিয়ে আরও বড় জালিয়াতি’- শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন নজরে নিয়ে বিচারপতি মো. নজরুর ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন।
আরও পড়ুন: হিন্দু নারীদের অধিকার প্রশ্নে হাইকোর্টের রুল
এই ঋণ অনুমোদেনের অভিযোগের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না এবং জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে।
দুদক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সচিব, বিএফআইইউ, সিআিইডি, এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) দুই সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
আদেশের আগে স্বপ্রণোদিত রুল ও নির্দেশনার বিরোধিতা করেন উপস্থিত আইনজীবী আহসানুল করিম, মাহবুব শফিক ও মইনুল ইসলাম।
রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সাইফুদ্দিন খালেদ, দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী হাসান এম এস আজিম।
আইনজীবী আহসানুল করিম শুনানিতে বলেন, এ ঋণের বিষয়টি জানতে পেরে এরই মধ্যে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিএফআইইউ আটকে দিয়েছে।
যেহেতু ঋণটি আটকে দেওয়া হয়েছে, এ অবস্থায় রুল জারির প্রয়োজন দেখছি না। রুল, আদেশ হলে ব্যাংকটির আমানতকারীদের মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়বে, তাদের মধ্যে ভীতি তৈরি হবে।
আদেশ হলে ব্যাংকটির শেয়ারের দাম সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যাবে। যে কারণে বলছি, স্বপ্রণোদিত রুল-আদেশ সবসময় মঙ্গলজনক নাও হতে পারে।
আইনজীবী মাহবুব শফিক বলেন, রুলসহ আদেশ দেওয়ার আগে প্রতিবেদনটির সত্যতা যাচাই করার জন্য এক সপ্তাহ সময় নেওয়া যেতে পারে। প্রতিবেদনটির বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করা জরুরি।
দেখা যাক, এবি ব্যাংক এই প্রতিবেদনের বিষয়ে কোনো প্রতিবাদ দেয় কি না। আদেশের জন্য এক সপ্তাহ অপেক্ষা করা যেতে পারে।
আইনজীবী মইনুল ইসলাম বলেন, এমনিতেই ব্যাংকিং খাতের অবস্থা টালমাটাল। এ অবস্থায় রুল আদেশ দিলে এ পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। সারা বিশ্বেই ব্যাংকিং খাতে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। বিভিন্ন দেশে অনেক ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে।
এসময় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সাইফুদ্দিন খালেদ তার বক্তব্যে আপত্তি জানিয়ে আলোচ্য বিষয় অর্থাৎ ৩৫০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদনের বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকতে বলেন।
তবে আইন কর্মকর্তা রুল জারি বা অন্তবর্তী আদেশ দেওয়া না দেওয়ার বিষয়ে কিছু বলেননি এরপর আদালত রুলসহ আদেশ দেন।
যে কোম্পানির অনুকূলে ৩৫০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করেছে এবি ব্যাংক তার মালিকানায় দুই জনের নাম উল্লেখ থাকলেও প্রকৃতপক্ষে এর সুবিধা নিতে যাচ্ছিলেন ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী হায়দার রতন।
যিনি কিছুদিন আগে ন্যাশনাল ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে রাতে ঋণের টাকা তুলে আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন।
যদিও জালিয়াতির এই ঋণের তথ্য জানতে পেরে এরই মধ্যে তা আটকে দিয়েছে বাংলাদেশ ফিইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
আরও পড়ুন: মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রীকে পদাধিকার বলে জামুকা'র চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ কেন বাতিল নয়: হাইকোর্ট
কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ অনুমোদনের বিষয়ে এবি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ব্যাখ্যা চেয়েছে তারা।
জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আলী হায়দার রতনের নামে পাঁচ ব্যাংকে বর্তমানে ৫৫৯ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। বিভিন্ন সরকারি কাজের কার্যাদেশের বিপরীতে সন্দেহজনক উপায়ে নেওয়া এসব ঋণ এখন খেলাপি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্র্যান্ডশেয়ার ট্রেডিংয়ের নামে একটি নামসর্বস্ব কোম্পানির নামে ৩৫০ কোটি টাকার ঋণ সম্প্রতি অনুমোদন করে এবি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। গত ১০ জানুয়ারি ব্যাংকটির গুলশান শাখায় ঋণের আবেদন আসে।
আবেদনে প্রতিষ্ঠানটির মালিক দেখানো হয় মোহাম্মদ আতাউর রহমান ও মো. মামুন রশিদকে। তবে এর ঠিকানা দেওয়া হয়েছে রতনের মালিকানাধীন ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশনের, যার কার্যালয় ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে। আর আবেদনপত্রের প্যাডে যে ই-মেইল ও ওয়েবসাইট ব্যবহার করা হয়েছে তা-ও তারই মালিকানার ব্র্যান্ডউইন নামে আরেকটি কোম্পানির।
এ কোম্পানির নামে দ্রুত ঋণ ছাড় করতে আবেদনের দিনই এবি ব্যাংকের গুলশান শাখা ব্যবস্থাপকসহ তিন কর্মকর্তা গ্রাহকের ধানমন্ডির অফিস ও বাড়ির ঠিকানা পরিদর্শন করে একটি পরিদর্শন প্রতিবেদন দেন।
গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের নামে কখনও কোনো আমদানি না হলেও ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রাহক প্রচুর পরিমাণে জ্বালানি, নির্মাণসামগ্রী, রাসায়নিক পদার্থ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য আমদানি করেন।
বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমদানি তো দূরে থাক, কোম্পানিটির নিবন্ধন নেওয়া হয় গত বছরের জুনে। এরপর গত নভেম্বরে ১০ হাজার টাকা জমা দিয়ে এবি ব্যাংকের গুলশান শাখায় একটি হিসাব খোলা হয়।
এর বাইরে কোনো লেনদেনও নেই। অথচ ভুয়া পরিদর্শন প্রতিবেদন দিয়ে একেবারে নতুন নিবন্ধিত কোম্পানিকে বড় কোম্পানি দেখানো হয়। পরদিন ঋণপ্রস্তাবটি শাখা থেকে প্রধান কার্যালয়ের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটিতে পাঠানো হয়। আবেদনের এক মাস পর গত ৯ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকের ৭৫৫তম পর্ষদ সভায় ব্যবস্থাপনা পরিচালকের জোর চেষ্টায় তা অনুমোদন হয়।
আবার ব্র্যান্ডশেয়ার ট্রেডিংয়ের নামে ঋণ অনুমোদন হলেও সব ধরনের ব্যাংকিং রীতিনীতি অমান্য করে ইনফ্রাটেকের অনুকূলে ১৬ কোটি ১৩ লাখ টাকার গ্যারান্টি ইস্যু করে ব্যাংক।
জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে পাঁচ ব্যাংক থেকে নেওয়া রতনের ঋণের বেশিরভাগই এখন খেলাপি। যে কোনো খেলাপিকে নতুন করে ঋণ দিতে পারে না ব্যাংক।
যে কারণে ভিন্ন কৌশলে আলী হায়দার রতনকে ৩৫০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার চেষ্টা করে এবি ব্যাংক। আগের সব ঋণই নেওয়া হয় সরকারি রাস্তার কার্যাদেশের বিপরীতে।
সরকারি কার্যাদেশের বিপরীতে নেওয়া ঋণ সরাসরি ব্যাংকের হিসাবে জমা হয়। সেখান থেকে ব্যাংক টাকা কেটে লাভের অংশ গ্রাহককে পরিশোধ করে।
তবে ন্যাশনাল, ইউসিবিএল, এসআইবিএল, জনতা ও বেসিক ব্যাংক থেকে নেওয়া ৬০৯ কোটি টাকার কোনো বিল সরাসরি ব্যাংক হিসাবে জমা হয়নি। ফলে এসব ঋণ এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
এছাড়া আদৌ কার্যাদেশ পেয়েছেন কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ব্যাংকগুলোতে। যদিও এ নিয়ে কেউ কিছু বলতে রাজি হননি।
আরও পড়ুন: প্লট বরাদ্দ বাতিলের নথি না দেওয়ায় রাজউক চেয়ারম্যানকে হাইকোর্টে তলব
১ বছর আগে