কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট
কুকি-চিনের উত্থান বনাম বান্দরবানের পর্যটন: ক্ষতির পাহাড়
মেঘ, পাহাড়, নদী ও ঝর্ণার মিলনে অপরূপ জেলা বান্দরবান। এসব নান্দনিক দৃশ্যে চোখ জুড়াতে সারা দেশ থেকে পর্যটক আসেন এখানে। কিন্তু পাহাড়ে নতুন সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) উত্থানের কারণে নিরাপত্তা শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে দীর্ঘদিন কয়েক দফায় পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হয়েছে। ফলে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে পর্যটন শিল্প-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
দেশের তিনটি পার্বত্য জেলার মধ্যে একটি বান্দরবান। জেলাটির দক্ষিণ-পশ্চিমে কক্সবাজার, উত্তর-পশ্চিমে চট্টগ্রাম জেলা, উত্তরে রাঙামাটি ও পূর্বে মিয়ানমার।
নিষেধাজ্ঞার টাইমলাইন
২০২০ থেকে ২১ সাল পর্যন্ত কোভিড-১৯ মহামারির ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আগেই কেএনএফের তৎপরতার কারণে ২০২২ সালের ১৮ অক্টোবর থেকে রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে স্থানীয় প্রশাসন।
এরপর ধারাবাহিকভাবে থানচি ও আলীকদম উপজেলাও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে দফায় দফায় উপজেলাভিত্তিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও পুনরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে প্রশাসন। নিষেধাজ্ঞা বাড়ানোও হয়েছে কয়েক দফায়।
এরপর ২০২৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলার ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছিল। তবে, সে বছরের ১৬ মার্চ সে নিষেধাজ্ঞা আবারও জারি করা হয়। পরে, আবারও ২০২৪ সালের ৮ অক্টোবর বান্দরবান ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এরপর ৬ নভেম্বর জেলার সাতটি উপজেলার মধ্যে চার উপজেলায় ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলেও তিন উপজেলা—রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচিতে নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখা হয়।
আরও পড়ুন: পার্বত্য চট্টগ্রামে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের তৎপরতা উদ্বেগ বাড়াচ্ছে
চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি রোয়াংছড়ির দেবতাখুম থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় পর্যটকেরা বর্তমানে সেখানে ভ্রমণ করতে পারছেন। ২০২৩ সালের ১৬ মার্চ থেকে দুই বছরেরও বেশি সময় বন্ধ থাকার পর চলতি ৬ জুন থেকে রুমায় বগা লেক পর্যন্ত এবং থানচিতে তুমাতুঙ্গি ও তিন্দু পর্যন্ত ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে, নির্দেশিত স্থানের বাইরে কোথাও যেতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
কেএনএফের উত্থান যেভাবে
বান্দরবানের রুমা উপজেলায় কেএনএফ সংগঠনটি গড়ে উঠেছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী নাথান বম সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো এমন তথ্যই দিয়েছে।
প্রথমে ২০১২ সালে কুকি-চিন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন্স (কেএনডিও) নামে সংগঠন করেন তিনি। পরে ২০১৮ সালে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে সংগঠনটি আত্মপ্রকাশ করে, যদিও সংগঠনটির লোগোতে প্রতিষ্ঠাকাল উল্লেখ করা আছে ২০০৮ সাল।
শুরুতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমার জেএসএস ও ইউপিডিএফ-এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রতিবাদ করত তারা। এ ছাড়া বম, লুসাই, পাংখো, খিয়াংসহ পিছিয়ে পড়া নৃগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে পার্বত্য অঞ্চলের চাকমা ও মারমাদের ব্যাপক বৈষম্যের প্রতিবাদ করছিল সংগঠনটি। তবে, কিছুদিন পর কেএনএফ আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে যায়।
একপর্যায়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে তারা। রাঙামাটি ও বান্দরবান অঞ্চলের ছয়টি জাতিগোষ্ঠী—বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, ম্রো ও খুমিদের প্রতিনিধিত্ব করছে বলে নিজেদের ফেসবুক পেজে দাবি করে তারা।
গোষ্ঠীটি বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম এবং রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি—মোট ৯টি উপজেলা নিয়ে আলাদা রাজ্যের দাবি করে। এমনকি, কল্পিত রাজ্যটির মানচিত্রও তাদের পেজে আপলোড দেয় তারা।
কেএনএফের দাবি, তাদের সামরিক শাখার শতাধিক সদস্য গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য মিয়ানমারের কাচিন প্রদেশে পাড়ি জমান বছর তিনেক আগে। ২০২১ সালে প্রশিক্ষণ শেষে একটি দল ফিরে এসে আত্মগোপনে চলে যায়। তবে তখন হয়তো ১৫ থেকে ২০ জনের মতো সদস্য ছিল বলে জানা গেছে। পরবর্তীতে তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
আরও পড়ুন: বান্দরবানে কুকি-চিন সন্ত্রাসীদের হামলায় ২ সেনাসদস্য নিহত, আহত ২: আইএসপিআর
কেএনএফ শুরুতে তাদের ফেসবুক পেজে সরকারের কোনো দপ্তর বা প্রতিষ্ঠানের ওপর নয়, বরং সব ক্ষোভ আঞ্চলিক পরিষদ, জেএসএস ও চাকমাদের ওপর চাপায়। এমনকি, বিভিন্ন মহল্লায় হামলা চালিয়ে চাকমাদের বিরুদ্ধে ‘প্রতিশোধ’ নেওয়ার নানা বার্তা দেয় তারা। এ সময়, তারা রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নের একটি ত্রিপুরা গ্রামে দুজন জুম চাষিকে হত্যাও করে।
শুরুতে পাহাড়ে নতুন রাজ্যের দাবি করলেও বর্তমানে সেই অবস্থান থেকে সরে এসে স্বায়ত্বশাসন চাচ্ছে কেএনএফ। তবে, জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), আঞ্চলিক পরিষদ ও চাকমাবিদ্বেষের ক্ষেত্রে তাদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাদের মতে, পাহাড়ে ‘চাকমা কর্তৃত্ব’ চলমান রয়েছে।
কেএনএফের তৎপরতা
ফেসবুকে পেজে ঘোষণা দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল কেএনএফ। এরপর থেকে চাঁদাবাজি ও গুম-খুন অপহরণের মাধ্যমে পাহাড়কে অস্থিতিশীল করে তোলার অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে।
একপর্যায়ে অভিযোগ পাওয়া যায়, দুর্গম পাহাড়ে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) গোপন আস্তানায় প্রশিক্ষণশিবির স্থাপন করেছে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার জঙ্গিরা।
এই তথ্যের ভিত্তিতে ২০২২ সালের ৩ অক্টোবর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যৌথ অভিযান শুরু হয়। এরপর একই বছরের ১৭ অক্টোবর থেকে পর্যটক ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
পরে সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় বসার কথা থাকলেও ২০২৪ সালে বান্দরবানের দুই উপজেলায় ১৭ ঘণ্টার ব্যবধানে দুই ব্যাংকের তিনটি শাখায় ডাকাতি করে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে সশস্ত্র গোষ্ঠীটি।
আত্মপ্রকাশের পর থেকে অন্তত নয়টি বড় ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটিয়েছে কেএনএফ। একই বছর পাহাড়ের আরেক সশস্ত্র গোষ্ঠী ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) সঙ্গে সংঘর্ষে রোয়াংছড়ি উপজেলার খামতাংপাড়া এলাকায় ৮ জন ও রুমা উপজেলার মুয়ালপিপাড়া একজন নিহত হন।
এ ছাড়া, ২০২৩ সালের ৮ মে রোয়াংছড়ি উপজেলা পাইংখিয়ংপাড়া এলাকায় আওয়ামী লীগের একজন নেতাসহ বম জনগোষ্ঠীর তিনজন এবং ২০২৩ সালের ২২ মার্চ একই উপজেলার রামথারপাড়ায় থংচুল বম নামের এক কারবারিকে (পাড়াপ্রধান) গুলি করে হত্যা করা হয়।
আরও পড়ুন: বান্দরবানে কুকি-চিন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের গুলিতে সেনা ওয়ারেন্ট অফিসার নিহত
২০২২ সালের ২১ জুন রাঙামাটির বিলাইছড়ির বড়থলি ইউনিয়নের সাইজাম পাড়ায় তিন ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে তারা।
জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযানের সময় কেএনএফের অনেক সদস্য সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের মিজোরামে চলে যান। এতে বম জাতিগোষ্ঠীর সাধারণ মানুষ পড়েন বিপাকে। এর সুযোগ নেয় কেএনএফ। তখন নতুন করে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর যুবকদের তারা দলে ভেড়ায় বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
২০২৩ সালে পাহাড়ে যৌথ অভিযানের সময় কেএনএফের ২ সদস্য ও কেএনএফের গুলিতে সশস্ত্র গ্রুপ মগ পার্টির ৩ জন নিহত হন। একই বছরের ১২ মার্চ দুপুরে কেএনএফের সশস্ত্র সদস্যদের গুলিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান এবং দুজন সেনা সদস্য আহত হন। তার একদিন আগে থানচি থেকে কেএনএফ ১২ জন নির্মাণ শ্রমিককে অপহরণ করে। তাদের মধ্যে একজন শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হন এবং বাকিদের জিম্মি করে রাখা হয়।
২০২৪ সালের ৩ ও ৪ এপ্রিল রুমা ও থানচিতে তিনটি ব্যাংকে ডাকাতি করে কেএনএফ। তারপর ৬ এপ্রিল থেকে সন্ত্রাস দমনে নিরাপত্তা বাহিনী অভিযান শুরু করে।
বান্দরবান পুলিশ সুপার কার্যালয়ের তথ্য অনুসারে, কেএনএফের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ২৮টিরও বেশি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে রুমা থানায় ১৮টি, থানচিতে ৬টি, রোয়াংছড়িতে ৩টি ও সদর থানায় একটি মামলা হয়েছে।
এ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে রুমায় ১১ জন, রোয়াংছড়িতে ৫ জন, বান্দরবান সদরে ২ জন ও থানচিতে ১ জনসহ মোট ১৯ জন কেএনএফ সদস্য নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া, পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে এখন পর্যন্ত ২৬টি অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে।
কয়েক বছরেও ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা সম্ভব না!
বান্দরবান হোটেল-মোটেল মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, বান্দরবান সদরে ৭৪টিসহ মোট দেড় শতাধিক হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট-কটেজ রয়েছে। নিরাপত্তাজনিত কারণে দীর্ঘদিন বান্দরবানে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা থাকায় ক্ষতির মুখে পড়েছে সেখানকার পর্যটন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো।
বান্দরবান হোটেল মালিক সমিতির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম ইউএনবিকে বলেন, ‘করোনা ও এরপর পাহাড়ের অভ্যন্তরীণ কিছু গ্রুপ, বিশেষ করে কেএনএফের কারণে আমাদের অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। আমরা কয়েক বছরেও এ ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারব না।’
তিনি বলেন, ‘তবে, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে পর্যটক আসতে না পারায় এবারের কোরবানি ছুটিতে প্রচুর পর্যটক এসেছে।’
কুকি-চিন নিয়ে নিরাপত্তা হুমকি নেই জানিয়ে পর্যটকদের বান্দরবান ভ্রমণে যাওয়ার আমন্ত্রণও জানিয়েছেন এ ব্যবসায়ী।
বর্তমান পরিস্থিতি
চলতি বছরের ২ জুন কেএনএফের ইউনিফর্ম তৈরির জন্য কাপড় সরবরাহের অভিযোগে চট্টগ্রামে ওয়েল কম্পোজিট নিট নামের একটি ফেব্রিক্স কারখানায় অভিযান চালিয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরিকুল ইসলামসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এর আগে, গত ১৭ মে নয়াহাটের রিংভো অ্যাপারেলস থেকে ২০ হাজার ৩০০ পিস এবং পরের দিন একটি গোডাউন থেকে ১১ হাজার ৭৮৫ পিস কেএনএফ ইউনিফর্ম জব্দ করা হয়। সর্বশেষ ২৮ মে পাহাড়তলীর নূর ফ্যাশন কারখানা থেকে আরও ১৫ হাজার পিস ইউনিফর্ম জব্দ করা হয়।
এ পর্যন্ত কেএনএফের ৪৭ হাজারের বেশি ইউনিফর্ম জব্দ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত এক মাসে কেএনএফের এক হাজার ৯৭৯ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তারদের সংখ্যা ১৪ হাজার ছাড়িয়েছে। গত ২৬ মে সেনাসদরে আয়োজিত বিশেষ ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানানো হয়।
আরও পড়ুন: বান্দরবানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে কুকি চিনের সংঘর্ষ, নিহত ১
বান্দরবানে পর্যটন নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক শামীম আরা রিনি বলেন, ‘দর্শনীয় স্থানগুলোতে এখন কোনো পর্যটন নিষেধাজ্ঞা নেই। যেসব জায়গা পর্যটকদের জন্য খোলা হয়েছে, সেসব জায়গায় নিরাপত্তাজনিত কোনো শঙ্কাও নেই।’
সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যৌথ অভিযান এখনো চলমান রয়েছে।’
১৫৭ দিন আগে
পার্বত্য চট্টগ্রামে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের তৎপরতা উদ্বেগ বাড়াচ্ছে
চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে একটি ক্রমবর্ধমান শক্তি হয়ে উঠেছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। কুকি-চিন নৃগোষ্ঠীর জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহ্বানও জানিয়েছে তারা।
নাথান বমের নেতৃত্বে ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত কেএনডিও মূলত বান্দরবান ও রাঙামাটির পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত ছয়টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বম, পাংখুয়া, লুসাই, ঘুমি, মো ও খিয়াংয়ের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে কাজ করে।
সরকারি সূত্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটির প্রাথমিক প্রচেষ্টা ছিল বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে শান্তি, সম্প্রীতি এবং ওই এলাকায় অসন্তোষের সমাধান করা।
তবে, বছরের পর বছর তাদের দাবি পূর্ণ না হওয়ায় কেএনডিও ২০১৬ সালে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টে রূপান্তরিত হয়। তার সশস্ত্র শাখা কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) গঠনের মাধ্যমে আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে তাদের কার্যক্রম।
কর্মকর্তাদের মতে, কেএনএফ এখন কুকিল্যান্ড নামে একটি পৃথক কুকি-চিন রাজ্য গঠন করতে চায় এবং তাদের পূর্বপুরুষের জমি পুনরুদ্ধার করতে চায়। ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এবং জেএসএসকে ‘সশস্ত্র সন্ত্রাসী’ উল্লেখ করে তাদের এই অঞ্চল থেকে দূর করতে চায়।
বেশ কয়েক বছর ধরে এই গোষ্ঠীর তৎপরতা বেড়েছে, যা আদর্শিক প্রচার থেকে সশস্ত্র সংঘাতে রূপ নিয়েছে।
আরও পড়ুন: বান্দরবানে কেএনএফের ২ সদস্য নিহত
কেএনএফের প্রধান লক্ষ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে ইনার লাইন পারমিট (আইএলপি) ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা, যা ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের একটি ধারা। এই ব্যবস্থায় আদিবাসী ছাড়া অন্য জনগোষ্ঠীর চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে প্রবেশের জন্য বিশেষ অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল।
আইএলপিকে আদিবাসী জনগোষ্ঠী এবং তাদের ভূমির জন্য প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে দেখা হতো।
কেএনএফ তাদের বক্তব্যে প্রায়ই তাদের সংগ্রামকে এই অঞ্চলগুলোর পুনরুদ্ধার এবং বাস্তুচ্যুত কুকি-চিন জনগণের পুনর্বাসন হিসেবে তুলে ধরে। এরা ব্রিটিশ শাসনের সময় মিজোরাম (ভারত) এবং চিন রাজ্যের (মিয়ানমার) মতো এলাকায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে কেএনএফ ক্রমবর্ধমান সহিংস সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। ২০২৪ সালের ২ এপ্রিল বান্দরবানের রুমা বাজারে সোনালী ব্যাংকের একটি শাখায় দুঃসাহসিক হামলা চালায় কেএনএফের ২০ থেকে ৩০ জনের একটি দল।
সশস্ত্র ঘাতকরা শুধু বিপুল পরিমাণ টাকা (প্রায় ১৫-২০ লাখ টাকা) লুটপাটই করেনি, রাইফেল ও এসএমজিসহ আগ্নেয়াস্ত্রও চুরি করেছে এবং ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণ করে। এই হামলার পরের দিন আরও একটি ব্যাংক ডাকাতি হয়েছিল। সেখানে হামলাকারীরা মোবাইল ফোন এবং আরও অর্থ নিয়ে পালিয়ে যায়।
কেএনএফের সামরিক তৎপরতার কারণে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষ হয়েছে। চলতি বছরের ৩ এপ্রিল এবং ৬ আগস্ট রুমা জোনে কেএনএ এবং সেনাবাহিনীর টহল দলের মধ্যে ঝুরবারং পাড়া ও পলি প্রংসাপাড়ার মতো এলাকায় ব্যাপক গোলাগুলির ঘটনা ঘটে।
এই সংঘর্ষের ফলে একজন সেনা জওয়ান নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হন।
এই অঞ্চলে কেএনএফ তাদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করছে। তাদের দাবি, তাদের বাহিনীতে ৩,০০০-এর বেশি সদস্য রয়েছে। যদিও প্রকৃত সংখ্যা আনুমানিক ৫০ থেকে ৬০ জন বলে ধারণা করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক স্নাতক ও রাজনৈতিক প্রার্থী প্রেসিডেন্ট নাথান বম এবং চিফ অব স্টাফ উপা ভানচুং কেএনএফের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তারা একটি পৃথক কুকি-চীন আঞ্চলিক রাষ্ট্রের জন্য তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছে। গোষ্ঠীটির কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ‘হেড-হান্টার্স’ নামে একটি এলিট কমান্ডো ইউনিট। এটি সহিংস সংঘর্ষের জন্য কুখ্যাত।
চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে আদিবাসী কুকি-চিন সম্প্রদায়ের উপস্থিতি প্রায়ই বৃহত্তর বাঙালিশাসিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের আড়ালে চাপা পড়ে গেছে।
কেএনএফের দাবি, তাদের কর্মকাণ্ডকে বছরের পর বছর অবহেলা করেছে সরকার। একই সঙ্গে তাদের প্রান্তিকীকরণ করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের দাবিগুলো পূরণ করা হয়নি। জাতিগত বৈচিত্র্যের জন্য পরিচিত এই অঞ্চলটি দীর্ঘ সময় ধরে আদিবাসী সম্প্রদায় এবং বাংলাদেশি রাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে রয়েছে।
সংঘাত যত গভীর হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভবিষ্যৎ ততই অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। সরকার ক্রমবর্ধমান সহিংসতা এবং এই অঞ্চল অস্থিতিশীল হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট তার লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। স্বায়ত্তশাসন ও কুকিল্যান্ড প্রতিষ্ঠায় কেএনএফের তৎপরতা যত বাড়বে, ওই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা তত দূরে চলে যাবে।
কুকি ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা সম্পর্কে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আবদুল হামিদ বলেন, কেএনএফ ইস্যু জাতীয় সীমানা অতিক্রম করেছে।
তিনি বলেন, এই গ্রুপ ভারত, মিয়ানমার, চীন ও বাংলাদেশে সক্রিয় বলে জানা গেছে। বাংলাদেশের বান্দরবান অঞ্চলে সাম্প্রতিক অপারেশন ছাড়াও তারা ভারতের মণিপুর রাজ্যে হামলা চালিয়েছে, যার ফলে জীবন ও সম্পদের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে।
এছাড়াও কেএনএফ স্বাধীন কুকি রাষ্ট্রের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছে বলেও জানা গেছে। এটিকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হামিদ বিশ্বশক্তির প্রভাবিত বৃহত্তর আঞ্চলিক গতিশীলতার প্রতিফলন বলে মনে করছেন।
তিনি বলেন, বিষয়টি সমাধান করতে সমন্বিত কৌশলের প্রয়োজন, যা ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, উদীয়মান প্রবণতা এবং সম্ভাব্য পরিস্থিতি বিবেচনায় নেবে।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হামিদ রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, এনজিও এবং বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে একযোগে কাজ করার মাধ্যমে নমনীয় ও কঠোর শক্তি ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
কুকি-চিন জনগণের বাস্তুচ্যুতি সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা কমানোর জন্য বিশেষত ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা করে সক্রিয় কূটনীতি অবলম্বনের গুরুত্বও তুলে ধরেন তিনি।
আরও পড়ুন: বান্দরবানে সেনা অভিযানে ৩ কেএনএফ সদস্য নিহত
৩৭৪ দিন আগে
বান্দরবানে কেএনএফের সদর দপ্তর দখল, ১ সেনা সদস্য নিহত
সেনাবাহিনীর একটি টহল দল বান্দরবানের রুমা উপজেলার থেপি পাড়া এলাকায় কেএনএফ (কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট) এর সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের সদর দপ্তরসহ একটি গোপন প্রশিক্ষণ ক্যাম্প দখল করেছে। এই অভিযানে ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইসে (আইইডি) বিস্ফোরণে সেনাবাহিনীর এক সদস্য নিহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কেএনএফের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প এলাকার আশেপাশে বসবাসরত স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে রুমা সেনা জোনের একটি টহল দল গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ওই ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। কেএনএফ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের কাছাকাছি পৌঁছালে কেএনএফ সশস্ত্র সন্ত্রাসী দলটি পালিয়ে যায়। তবে ওই সময় কেএনএফের পুতে রাখা আইইডি বিস্ফোরণে সৈনিক তুজাম (৩০) আহত হন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় হেলিকপ্টার দিয়ে তাকে চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
সাধারণ জনগণের নিরাপত্তার জন্য সেনাবাহিনীর বিশেষায়িত দল এই ধরনের সম্ভাব্য আইইডি চিহ্নিত করে নিষ্ক্রিয় করছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ সৈনিকের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন এবং তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে কেএনএফ সন্ত্রাসীরা বান্দরবানের রুমা, রোয়ানছড়ি ও থানচি উপজেলার পাহাড়ি জনপদে ক্রমাগত হত্যা, অপহরণ, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এই ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধে কাজ করছে।
আরও পড়ুন: বান্দরবানে আইইডি বিস্ফোরণে এক শ্রমিক নিহত
বান্দরবানে কেএনএফ নেতা গ্রেপ্তার
৯১৭ দিন আগে