টেকসই খাদ্য ব্যবস্থাপনা
সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই খাদ্য ব্যবস্থাপনা চালু করুন: জাতিসংঘের খাদ্য সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী
বিশ্বের দুই বিলিয়ন মানুষ এখনও খাদ্য নিরাপত্তার বাইরে রয়েছে উল্লেখ করে সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই খাদ্য ব্যবস্থাপনা চালু করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ এবং নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার কারণে খাদ্য, সার, জ্বালানি এবং আর্থিক সংকট বিশ্বজুড়ে ক্ষুধা ও অপুষ্টির সমস্যাকে তীব্রতর করেছে। তবে পুষ্টিকর খাদ্য সংগ্রহের অক্ষমতার জন্য কৃষি ও খাদ্যপণ্যের দামই একমাত্র বাধা নয়। ফলে সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই খাদ্য ব্যবস্থাপনার প্রবর্তন প্রয়োজন।’
সোমবার ইতালির রাজধানী রোমে ইউএন ফুড সিস্টেম সামিট+২ স্টকটেকিং মোমেন্ট (ইউএনএফএসএস+২) উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিন দিনব্যাপী সম্মেলনের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘ সাসটেইনেবল ফুড সিস্টেম ফর পিপল, প্লানেট অ্যান্ড প্রসপারিটি: ডাইভার্স পাথওয়ে ইন এ শেয়ার্ড জার্নি।’
এটি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সদর দপ্তরে উদ্বোধন করা হয়।
আরও পড়ুন: স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈচিত্র্য আনতে হবে: শিক্ষাবিদদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বের প্রায় ৬৯ কোটি মানুষ এখনও অপুষ্টিতে ভুগছে। প্রায় দুই বিলিয়ন খাদ্য নিরাপত্তার আওতায় রয়েছে আর প্রায় তিন বিলিয়ন মানুষ সুষম খাদ্য থেকে বঞ্চিত।
তিনি সারা বিশ্বে টেকসই, নিরাপদ এবং পুষ্টিকর খাদ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পাঁচটি প্রস্তাব রাখেন, যার মধ্যে আধুনিক কৃষিতে বিনিয়োগের জন্য বহুপক্ষীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং বেসরকারি উদ্যোক্তাদের বিস্তৃত করা।
প্রধানমন্ত্রী তার প্রথম প্রস্তাবে বলেন, ‘আধুনিক কৃষিতে বিনিয়োগে বহুপাক্ষিক উন্নয়ন ব্যাংক এবং বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আর্থিক প্রণোদনা এবং নীতি সহায়তা প্রদান করা প্রয়োজন।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিব কর্তৃক সূচিত কৃষ্ণ সাগর শস্য চুক্তির কার্যকারিতা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি খাদ্য ও সার রপ্তানির
ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারসহ যেকোনো বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
তৃতীয় প্রস্তাবটি রেখে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক 'খাদ্য ব্যাংক' প্রতিষ্ঠা করতে এগিয়ে আসতে হবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তনে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা করতে হবে।
চতুর্থ প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ন্যানো-টেকনোলজি, বায়ো-ইনফরমেটিক্স এবং উন্নত কৃষি প্রযুক্তি, কৃষি শিক্ষা ও গবেষণায় চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সবার জন্য সহজলভ্য করতে হবে।
তার পঞ্চম প্রস্তাব করে তিনি বলেন, প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের অপচয় রোধ করতে তরুণদের সম্পৃক্ত করে একটি ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
তিনি বলেন, ‘যদি আমরা সম্মিলিতভাবে প্রয়োজনীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারি, তাহলে আমরা টেকসই বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করতে পারব।’
আরও পড়ুন: দেশের অফশোর উইন্ড এনার্জিতে বিনিয়োগের প্রস্তাব ডেনমার্কের
বাংলাদেশের খাদ্য খাতের বিষয় তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার ২০০৮ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে ২ দশমিক ৬ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য ঘাটতি দিয়ে শুরু করে। তারপরে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য ভর্তুকি প্রদান, ১০ টাকায় কৃষকদের জন্য ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, একটি সুশৃঙ্খল সার বিতরণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়।
তিনি বলেন, ‘এর ফলে, আমরা শুধু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতাই অর্জন করিনি, বরং ২০১৩ সালের মধ্যে খাদ্য উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত হয়েছি।’
এফএও-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দশটি খাদ্য উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে একটি।
তিনি বলেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে ৪৯ দশমিক ৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন যা ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ছিল ৩২ দশমিক ৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন।
তিনি বলেন, ‘এখন ধান ও মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয় এবং আলু উৎপাদনে ৬ষ্ঠ।
বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। কিন্তু দেশের প্রায় ৪০ দশমিক ৬ শতাংশ শ্রমশক্তি কৃষিতে নিয়োজিত। জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান ২ দশমিক ৪৩ শতাংশ, যেখানে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১ দশমিক ৯০ শতাংশ।
তিনি বলেন, ‘আমাদের সরকার কৃষি গবেষণা এবং উদ্ভাবনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে…। গত ১৪ বছরে ৬৯০টি উন্নত এবং উচ্চ ফলনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। আমাদের বিজ্ঞানীরা লবণাক্ততা-সহনশীল ধান উদ্ভাবন করেছেন এবং তারা খরা ও জলাবদ্ধতা-সহনশীল ধান উদ্ভাবনে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।’
আরও পড়ুন: দেশের জ্বালানি খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী আরব আমিরাত
শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার ২০১৩ সালে খাদ্য নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করে এবং ২০১৫ সালে বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ গঠন করে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন সরকারি পর্যায়ে খাদ্যশস্যের মজুদ ক্ষমতা প্রায় ২১ লাখ ৫৯ হাজার মেট্রিক টন। দেশে খাদ্যশস্য মজুদের পরিমাণ ১৬ লাখ টনের বেশি, যা ২০০৭ সালে ছিল ১০ লাখ টন। দেশের ১৯টি দুর্যোগপ্রবণ জেলার অধীনে ৬৩টি উপজেলায় প্রায় ৫ লাখ পারিবারিক খাদ্য গুদাম বিতরণ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তার কৃষি উদ্ভাবন ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে আগ্রহ প্রকাশ করছে।
২০টিরও বেশি রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান সহ ১৬০টিরও বেশি দেশ থেকে প্রায় ২ হাজার অংশগ্রহণকারী শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন।
শেখ হাসিনা যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন তখন এফএও সদর দপ্তরের পূর্ণাঙ্গ কক্ষ এবং কয়েকটি হলরুমে বিপুল সংখ্যক দর্শক উপস্থিত ছিলেন।
সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ, নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কামাল দাহাল, সামোয়া ফিয়ামের প্রধানমন্ত্রী নাওমি মাতাফা, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এবং এফএও মহাপরিচালক ডক্টর কু ডংইউ।
আরও পড়ুন: জাতিসংঘের ফুড সিস্টেমস সামিটে যোগ দিতে রোমের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ প্রধানমন্ত্রীর
১ বছর আগে