জামায়াতে ইসলামী নেতা
সাঈদীকে ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার’ বলায় এএইচআরসি প্রতিনিধির সমালোচনা করলেন মুক্তিযোদ্ধারা
জামায়াতে ইসলামী নেতা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর যুদ্ধাপরাধের বিষয়টিকে হালকা করে দেখানোর জন্য এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের (এএইচআরসি) একজন প্রতিনিধির সমালোচনা করেছেন মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদরা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের সবচেয়ে জঘন্যতম মামলার অপরাধীদের রক্ষা করতে এটি উৎসাহিত করে বলেও মন্তব্য করেছেন তারা।
তারা বলেন, দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধী সাঈদীকে 'রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার' হিসেবে চিত্রিত করেছে এইচআরসি। ১৯৭১ সালে তিনি যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন সে সম্পর্কে বিশ্বকে বিভ্রান্ত করার মরিয়া প্রচেষ্টা এটি। একই সঙ্গে তার মৃত্যুর পর জামায়াত-শিবিরের লোকেরা যে সহিংসতা চালিয়েছে সে বিষয়কেও হালকা করা হয়েছে।
তারা আরও বলেন, ২০০৪ সালে মার্কিন সন্ত্রাসী স্ক্রিনিং সেন্টার সাঈদীকে তাদের ‘নো ফ্লাই’ তালিকায় যুক্ত করেছিল। সন্দেহভাজন উগ্রপন্থী ও সন্ত্রাসীদের সে দেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে সেই তালিকায় নাম দেওয়া হয়।
মার্কিন ভিত্তিক লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশনের ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশিদের হত্যাকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা উল্লেখ করে তারা বলেন, এএইচআর-এর বিবৃতিটি এই সমর্থনকে অস্বীকার করে।
এএইচআরসি অ্যান্ড এশিয়ান লিগ্যাল রিসোর্স সেন্টারের পক্ষ থেকে লিয়াজোঁ অফিসার মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে টম ল্যানটোস হিউম্যান রাইটস কমিশন আয়োজিত সাম্প্রতিক এক ব্রিফিংয়ে অংশ নিয়ে এমন 'উদ্দেশ্যপ্রণোদিত' মন্তব্য করেছেন। তার এক বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন বলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও সাঈদীর মতো তাদের দোসরদের হাতে যারা তাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছেন তাদের মানসিক যন্ত্রণাকে উপহাস করেছেন তিনি।
আরও পড়ুন: সাঈদীর মৃত্যুতে ফেসবুকে স্ট্যাটাস: ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছাত্রলীগের ১৭ নেতা-কর্মী বহিষ্কার
টম ল্যান্টোস মানবাধিকার কমিশনের ওয়েবসাইটে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে আশরাফুজ্জামান বলেন, ‘সাঈদী একজন ইসলামিক স্কলার…। শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে আপনি যদি বিরোধী দল বা ভিন্নমতাবলম্বীদের সঙ্গে থাকেন তাহলে, আপনার জানাজা বা সামাজিক স্বীকৃতির অধিকার পাবেন না। এটি কোনো নতুন ঘটনা নয়।’
মুক্তিযোদ্ধা অজয় দাশগুপ্ত বলেন, 'আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপর হামলা, গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, সাঈদীকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে দেখানোর জন্য পাঁচ সাংবাদিকের উপর হামলা, ব্যস্ততম হাসপাতালের সামনে জামায়াত শিবিরের লোকজন রোগীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টিসহ দিনব্যাপী সহিংসতার ঘটনায় নীরব থাকায় তাকে জামায়াতের মুখপাত্র বলে মনে হয়েছে।’
তিনি ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্টসের (আইএফজে) আহ্বানের কথা উল্লেখ করে বলেন, 'এই সাংবাদিকদের উপর নৃশংস হামলার ঘটনার দ্রুত তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে।’
তারপরও, সাঈদীকে তার পৈতৃক বাড়িতে দাফন করা হয়েছিল এবং তার জানাজায় তার অনুসারীরা অংশ নিয়েছিল। অথচ আশরাফ তার দাফনের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে সরকারকে দোষারোপ করেছেন।
অধ্যাপক মেজবাহ কামাল বলেন, এই বিবৃতি পাকবাহিনী ও সাঈদীর দল লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে এবং তাদের ধর্ষণ ও নির্যাতনসহ ভয়াবহ যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণার অভাব প্রকাশ করে।
তিনি আরও বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের 'ভুক্তভোগী' হিসেবে চিত্রিত করে এ ধরনের আখ্যান আগে পশ্চিমা দেশগুলোতে জামায়াতের ভাড়া করা লবিস্টরা প্রচার করেছিল।
আরও পড়ুন: ফেসবুকে সাঈদীর মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করায় ৪ ছাত্রলীগ কর্মী বহিষ্কার
নুরেমবার্গ ও টোকিওর বিচারের সময় যুদ্ধাপরাধের বিচারে পশ্চিমা শক্তিগুলো যে মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে তার উল্লেখ করে তারা বলেন, 'বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে নতুন মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে।’
মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদরা বলেন, পাঁচ দশক ধরে সাঈদীর মতো যুদ্ধাপরাধীদের হাতে স্বজন হারানো লাখ লাখ মানুষের পরিবার ন্যায়বিচার পায়নি। কারণ বিএনপি-জামায়াতের আমলে পরিকল্পিতভাবে এদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।
বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে জামায়াত লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে ব্রিটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যানসহ বেশ কয়েকজন লবিস্ট নিয়োগ করেছে। তারা এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এড়াতে এবং কয়েক দশক ধরে এই অপরাধীদের দায়মুক্তির সংস্কৃতি অব্যাহত রাখতে ভুল তথ্য প্রচারণা চালিয়েছিল বলে জানা গেছে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পিরোজপুরে হত্যা, ধর্ষণ, জোরপূর্বক ধর্মান্তর, অগ্নিসংযোগ ও অপহরণের দায়ে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে তার সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন। ২০১৭ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ আদালত সাঈদীর রিভিউ আবেদন খারিজ করে দণ্ড বহাল রাখেন।
যুদ্ধাপরাধের বিচার চলাকালে পিরোজপুরের গ্রামাঞ্চলে অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন, লুটপাট, জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের দায়ে 'দেলু রাজাকার' উপাধিপ্রাপ্ত সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করেন ট্রাইব্যুনাল।
এর আগে ২০১৫ সালে ল্যান্টোস কমিশন কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিচার নিয়ে প্রশ্ন তোলে, যা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটায়।
আরও পড়ুন: সাঈদীর চিকিৎসককে প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগে গ্রেপ্তার ২
১ বছর আগে