রোহিঙ্গা গণহত্যার ৬ বছর
রোহিঙ্গা গণহত্যার ৬ বছর: সহিংসতায় জড়িতদের জবাবদিহি দাবি জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞের
মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর গণহত্যার ৬ বছর পূর্ণ হয়েছে। এ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার (২৪ আগস্ট) জাতিসংঘের একজন বিশেষজ্ঞ বিশ্ব নেতাদের উদাসীনতার অবসান ঘটাতে এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুতদের সহায়তা করার আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে এই সহিংসতার মূলে থাকা ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
জেনেভা থেকে জারি হওয়া এক বিবৃতিতে মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার টম অ্যান্ড্রুজ বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ন্যায়বিচার ও জবাবদিহির সমর্থনে নীতিগত ও সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ ছাড়া আমরা আর একটি বছরও পার হতে দিতে পারি না।’
তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের অপরিসীম দুর্ভোগের জন্য দেশটির শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা দায়ি। গণহত্যা অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়া মিন অং হ্লাইং এখন একটি অবৈধ সামরিক জান্তার প্রধান। এই সামরিক জান্তা মিয়ানমারজুড়ে বেসামরিক জনগণের উপর হামলা চালাচ্ছে। তাকে অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে এবং তার অপরাধের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।’
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী উত্তর রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে তাদের মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করতে ব্যাপক আক্রমণ শুরু করে।
আরও পড়ুন: রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে আন্তর্জাতিক সমর্থনের জন্য ওআইসি-ইউএনএইচসিআরের প্রতি আহ্বান বাংলাদেশের
পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে সৈন্যরা বেসামরিক রোহিঙ্গা নাগরিকদের হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন করে এবং ওই অঞ্চলে রোহিঙ্গা গ্রামগুলো পুড়িয়ে দেয়।
৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। যদিও সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, তাদের 'ক্লিয়ারেন্স অপারেশন' রোহিঙ্গা জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের লক্ষ্য করে পরিচালিত হয়েছিল। তবে, তাদের নৃশংস ও নিরবচ্ছিন্ন আক্রমণের প্রাথমিক লক্ষ্যবস্তু ছিল রোহিঙ্গা বেসামরিক নাগরিকরা।
৬ বছর আগে রোহিঙ্গাদের উপর হামলা মানবতার বিরুদ্ধে ও গণহত্যার এমন অপরাধ যা বিশ্ববিবেককে হতবাক করেছে এবং আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের দাবি রাখে।
যে সহিংসতা তাদের মাতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ করেছে, পরিবারগুলোকে ছত্রভঙ্গ করেছে, হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে এবং আরও অনেককে ক্ষত-বিক্ষত করেছে, তার জন্য রোহিঙ্গাদের ন্যায়বিচার প্রাপ্য।
২০১২ ও ২০১৬ সালে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর ব্যাপক ও নৃশংস হামলাসহ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে কয়েক দশক ধরে সহিংসতা ও নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে।
আরও পড়ুন: রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে গ্রহণ করতে মার্কিন কংগ্রেসম্যানদের পরামর্শকে না বলেছে বাংলাদেশ: মোমেন
১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বর্তমানে বাংলাদেশের বিশাল শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে। রাখাইন রাজ্যে আনুমানিক ৬ লাখ মানুষ এখনও রয়ে গেছেন। যেখানে তারা অধিকারবিষয়ক কঠোর বিধিনিষেধ এবং আরও সহিংসতার হুমকির সম্মুখীন হচ্ছেন।
জাতিসংঘের এই বিশেষজ্ঞ বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রয়োজনের সময়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও তাদের পর্যাপ্ত সহায়তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অপরাধের দায় সম্পূর্ণভাবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হলেও, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত এসব মানুষের প্রতি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে।
৬ বছর পরেও নিরাপত্তা পরিষদ নৃশংস অপরাধের অপ্রতিরোধ্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও মিয়ানমারের পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে পাঠায়নি।
জেনেভার জারি করা বিবৃতি অনুসারে, রোহিঙ্গাদের আক্রমণ ও হত্যা করা দেশটির সামরিক বাহিনীর কাছে কিছু দেশ অস্ত্র বিক্রি অব্যাহত রেখেছে এবং তারা এখন সারা দেশে বেসামরিক জনগণের উপর বন্দুক চালাচ্ছে।
আরও পড়ুন: রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ৬ বছর: প্রত্যাবাসন চায় বাংলাদেশ, একীভূতকরণে চাপ দিচ্ছে কিছু দেশ
যেসব দেশ মানবাধিকারকে সমর্থন করে, তারা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে তাদের হামলা চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ, অস্ত্র ও বৈধতা থেকে বঞ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও রোহিঙ্গাদের তাদের প্রয়োজনের সময়ে পর্যাপ্ত সহায়তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর আর্থিক অনুদান কমে যাওয়ায় বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে রেশন কমিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছে।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করার আগে বাংলাদেশ থেকে তাদের প্রত্যাবাসনের একটি অদূরদর্শী পরিকল্পনাকে সমর্থন করছে কিছু সরকার।
প্রতিশ্রুতিহীনতায় ক্লান্ত রোহিঙ্গারা। তাদের সন্তানরা তো আর রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরপূর্ণ উক্তি বা জাতিসংঘের রেজুলেশন খেতে পায় না।
বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার বলেন, উদাসীনতার মারাত্মক অসাড়তার অবসান ঘটানোর জন্য বৈশ্বিক সমর্থন তাদের প্রয়োজন এবং যা তাদের প্রাপ্য। গণহত্যার জন্য দায়ীদের জবাবদিহি করতে এবং মিয়ানমারের সীমানার অভ্যন্তরে ও তার বাইরে থাকা রোহিঙ্গাদের জীবন বাঁচাতে এবং দুর্ভোগের অবসান ঘটাতে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
আরও পড়ুন: রোহিঙ্গাদের পরীক্ষামূলক প্রত্যাবাসনে বাধা দেওয়া উচিত নয়: শাহরিয়ার
১ বছর আগে