ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন
ইসরো চন্দ্রযান-৩: ভারতের চন্দ্র বিজয়ে নারী বিজ্ঞানীদের সাফল্য
শুধুমাত্র কায়িক শ্রমে গড়া অবকাঠামোতে নয়; নারীদের মস্তিষ্ক প্রসূত সভ্যতা বিকাশেরও সাক্ষী হয়ে আছে চির পরিবর্তনশীল মহাকাল। বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে তাদের অবদান যেমন ভেদ করেছে সুগভীর পাতাল, তেমনি ছাড়িয়ে গেছে আকাশের মেঘের স্তর। মহাকাশের শূন্যতাকে প্রথম নারীর অস্তিত্বে সমৃদ্ধ করেছিলেন ভ্যালেন্তিনা তেরেস্কোভা। তার পথ ধরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মহাকাশ গবেষণায় নারীদের সম্পৃক্ততা বেড়েছে দ্রুতগতিতে। এমনকি এই সাফল্যের আলোর মশাল জ্বলে উঠেছে ভারতীয় উপমহাদেশেও। গত ২৩ আগস্ট ভারতের চন্দ্র বিজয়ে নারী বিজ্ঞানীদের সাফল্য যেন তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। চলুন, জেনে নেই সেই যুগান্তকারী অভিযানের ঘটনা। সেইসঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক ভারতের চন্দ্রযান-৩ মিশনের নেপথ্যে থাকা নারী মহাকাশ বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের সঙ্গে।
চন্দ্রযান-৩ উপাখ্যান
নাসার ভারতীয় সংস্করণ ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন; সংক্ষেপে আইএসআরও বা ইসরো। চাঁদের পৃষ্ঠে অবতরণ করে সেখানকার প্রকৃতি পর্যালোচনার উদ্দেশ্য নিয়ে এরা শুরু করেছিলো চন্দ্রযান নামের প্রজেক্টটি। পর পর দুটি অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পর চন্দ্রযান-৩ গত ২৩ আগস্ট নিরাপদে অবতরণ করতে সক্ষম হয় চন্দ্রপৃষ্ঠে।
যাত্রা শুরু হয়েছিলো ১৪ জুলাই; সর্বজনীন সমন্বিত সময় বা কোঅর্ডিনেটেড ইউনিভার্সাল টাইম (ইউটিসি) অনুযায়ী সময় ৯ টা ৫ মিনিট। রকেটের উৎক্ষেপণ হয় ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের শ্রীহরিকোটায় সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টারের দ্বিতীয় লঞ্চ প্যাড থেকে।টানা কয়েকবার চেষ্টার পর ৫ আগস্ট চাঁদের কক্ষপথে ঢুকতে সক্ষম হয় মহাকাশযান চন্দ্রযান-৩।
পুরো মহাকাশযানটি মূলত ল্যান্ডার, রোভার ও প্রোপালশান মডিউল- এই তিন ভাগে বিভক্ত। ল্যান্ডারের কাজ হলো যানটিকে নিরাপদে অবতরণ করানো। এর নাম দেওয়া হয়েছে বিক্রম। অবতরণের জন্য এর নিবেদিত চারটি পায়ে রয়েছে চারটি শক্তিশালী ইঞ্জিন। অন্যদিকে, রোভার হচ্ছে ছয় চাকার একটি গাড়ি, যার উদ্দেশ্য পুরো যানটিকে নিয়ে নির্বিঘ্নে চন্দ্রপৃষ্ঠে ঘুরে বেড়ানো। এই অংশের নাম হচ্ছে প্রজ্ঞা।আর এই বিক্রম ও প্রজ্ঞাকে চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব হচ্ছে প্রোপালশান মডিউলের। ১৭ আগস্ট এই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে বিক্রম ও প্রজ্ঞা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় প্রোপালশান মডিউল।
২৩ আগস্ট কক্ষপথের একদম শেষ বিন্দুর কাছাকাছি আসার সঙ্গে সঙ্গে একসাথে গর্জে উঠে বিক্রমের চারটি ইঞ্জিন। এরপর ঠিক সাড়ে ১১ মিনিট পর বিক্রম নেমে আসে চাঁদের ভূপৃষ্ঠ থেকে ৭.২ কিলোমিটার উচ্চতায়। এ অবস্থায় প্রায় ১০ সেকেন্ড ভেসে থেকে এটি ভূপৃষ্ঠের সঙ্গে উল্লম্ব দিকে ঘুরে যায়। কিছুক্ষণ পর নেমে যায় আরও প্রায় ১৫০ মিটার। এই উচ্চতায় থেকেই বিশ্ববাসীর স্তম্ভিত দৃষ্টির সামনে প্রায় ৩০ সেকেন্ড ঘুরে বেড়ায় বিক্রম ও প্রজ্ঞা। অতঃপর ইউটিসি সময় ঠিক ১২ টা ৩২ মিনিটে চাঁদের মাটি স্পর্শ করে ভারতের চন্দ্রযান-৩।
আরও পড়ুন: চাঁদে ভারতের চন্দ্রযানের সফল অবতরণ উপলক্ষে নরেন্দ্র মোদিকে শেখ হাসিনার অভিনন্দন
চন্দ্রযান-৩-এর অভিযানের নেপথ্যে থাকা নারী বিজ্ঞানীরা
ইসরো চন্দ্রযান-৩ কে পরিচালনায় সরাসরি কাজ করেছেন প্রায় ৫৪ জন নারী প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানী। তাদের মধ্যে থেকে যাদের নাম ওতপ্রোতভাবে এই চন্দ্রাভিযানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তারা হলেন:
ঋতু কাড়িধাল শ্রীভাস্তাভ
৪৮ বছর বয়সী ঋতু কাড়িধাল ভারতবাসীর কাছে পরিচিত ‘রকেট উইমেন’ হিসেবে। ইসরোর সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা ১৯৯৭ সাল থেকে। সেই থেকে তিনি মার্স অরবিটার মিশন (এমওএম) বা মম ও চন্দ্রযান প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছেন। তিনি মম মিশনের ডেপুটি অপারেশন্স ডিরেক্টরও ছিলেন।
মুথাইয়া বনিতা
এই ৫৯ বছর বয়সী ইলেকট্রনিক্স সিস্টেম প্রকৌশলী নেতৃত্ব দিয়েছেন ইসরোর বিভিন্ন উপগ্রহের প্রকল্পগুলোতে। তিনি ইসরোর চন্দ্রযান-২-এর প্রকল্প পরিচালক ছিলেন।
ইসরোর সঙ্গে তার শুরুটা ছিল শুধুমাত্র হার্ডওয়্যার নিরীক্ষণ কাজের মধ্য দিয়ে। পরবর্তীতে তিনি ইসরো স্যাটেলাইট সেন্টারের ডিজিটাল সিস্টেম গ্রুপে টেলিমেট্রি এবং টেলিকমান্ড বিভাগের পরিচালক পদে অধীষ্ঠিত হন। ২০১৩-এর সফল মঙ্গলযান মিশনেও যুক্ত ছিলেন তিনি।
তিনিই ছিলেন ইসরোতে আন্তঃগ্রহ মিশনে নেতৃত্ব দেওয়া প্রথম নারী। চন্দ্রযান-২ মিশনের সহযোগী পরিচালক থেকে তাকে প্রকল্প পরিচালক পদে উন্নীত করা হয়েছিলো। এর মাধ্যমে তিনি ইসরোর প্রথম নারী প্রকল্প পরিচালক হওয়ার সম্মান অর্জন করেন।
আরও পড়ুন: অগমেন্টেড রিয়েলিটি প্রযুক্তির ‘ভিশন প্রো’ হেডসেট নিয়ে এলো অ্যাপল
বনিতা ২০০৬ সালে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার সেরা নারী বিজ্ঞানীর পুরস্কার পেয়েছিলেন।
মিশন মঙ্গল ছিল ইসরোর অন্যতম সেরা সাফল্য। এর মাধ্যমে ভারত চতুর্থ দেশ হিসেবে মঙ্গল গ্রহে অবতরণের মর্যাদা লাভ করে।
সেই ধারাবাহিকতায় ঋতু কাড়িধাল মিশন ডিরেক্টর হিসেবে চন্দ্রযান-২-এর মিশনের তত্ত্বাবধান করেন।
কাড়িধাল ২০০৭ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি এ.পি.জে. আব্দুল কালামের কাছ থেকে ইসরোর তরুণ বিজ্ঞানীর পুরস্কার পান।
কল্পনা কালাহাস্তি
ইসরোর সঙ্গে ৪৩ বছর বয়সী এই মহাকাশ প্রকৌশলীর যাত্রা শুরু হয় ২০০৩ সাল থেকে। তার দায়িত্ব ছিল স্যাটেলাইটের অবস্থান সুনির্দিষ্ট করার জন্য প্রপালশান সিস্টেম তৈরি করা। এছাড়াও তার বিশেষত্ব ছিল পৃথিবীর পরিষ্কার ছবি তোলার জন্য উন্নত ইমেজিং সরঞ্জামের নকশা প্রণয়নে। তিনি ধীরে ধীরে মম এবং চন্দ্রযান-২-এর মত যুগান্তকারী প্রকল্পগুলোর অংশ হয়ে ওঠেন।
২০১৯ সালে তাকে চন্দ্রযান-৩ মিশনের ডেপুটি প্রজেক্ট ডিরেক্টর হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তিনি বিক্রমের সিস্টেমের নকশা তৈরি ও এর কর্মকাণ্ড সুস্পষ্ট করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
আরও পড়ুন: মোবাইল ফোন হ্যাকিং প্রতিরোধে করণীয়
১ বছর আগে